প্রতিদিনই মরে ভেসে উঠছে কার্প জাতীয় মা মাছ

9

হাটহাজারী প্রতিনিধি

দেশের অন্যতম মিঠা পানির জোয়ার-ভাটার প্রাকৃৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ চট্টগ্রামের হালদা নদী শুধুই একটি নদী নয়, এটি একটি রূপালি সম্পদের খনি যা অনেকাংশে একটি স্বর্ণ প্রসবিনী হাঁসের মতো অনেক মূল্যবান এবং দামী। বিগত বছর দু-তিনেক আগেও কিছু লোভী, দুর্বৃত্ত, ভূমিদস্যু, নিষিদ্ধ যান্ত্রিকযানের অত্যাচার ও মৎস্য শিকারীরা অবলীলায় হামলে পড়েছিল বেচারা হালদার ওপর।
সাম্প্রতিক সময়ে এসব অসাধু চক্রের তৎপরতা দৃশ্যমানভাবে কমলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন- মানবসৃষ্ট ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডে বিপর্যস্ত হালদার পরিবেশ-প্রকৃতি, কার্প জাতীয় মা-মাছ ও জীববৈচিত্র। হুমকির মুখে মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদার মা-মাছের বিচরণ ক্ষেত্রও। এর কান্না শোনার কেউ নেই। গত এক সপ্তাহ ধরে এই নদীর করুণ অবস্থা আর আহাজারি নিয়ে জাতীয় ও আঞ্চলিক গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। তাতেও প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের টনক নড়েনি। সরকারের নীতি নির্ধারণী মহলেরও ঘুম ভেঙেছে বলে প্রতীয়মান হয়নি। তাইতো আজ এ হালদার এমন দৈন্যদশা। এমন দৈন্যদশা রোধে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দ্রæত একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে কারণ উদ্ঘাটনের দাবি বিশেষজ্ঞদের।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতিদিন হালদা নদীর কোথাও না কোথাও মরে ভেসে উঠছে মা-মাছ। বিগত এক সপ্তাহে নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে চারটি মা-মাছ (তিনটি কাতলা ও একটি রুই) ও একটি ডলফিন মরে পচে ভেসে উঠেছিল। গতকাল শুক্রবার সকালে হাটহাজারী উপজেলার উত্তর মাদার্শার আমতোয়া এলাকায় স্থানীয়রা মৃত দু’টি কাতলা মা-মাছ ভেসে থাকতে দেখে উদ্ধার করে হালদা নদীর পারে নিয়ে আসে। প্রথমটি (দৈর্ঘ্য ৯৮ সে.মি. ও ওজন প্রায় ১২ কেজি ৫শ গ্রাম) উক্ত এলাকার কুমারখালি ঘাট এবং অন্যটির (দৈর্ঘ্য ৮৫ সে.মি. ও ওজন প্রায় ১০ কেজি) কুমারখালী ঘাটের সামনে ফুলজান বাপের ঘাট এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়। এরমধ্যে ১২ কেজি ৫শ গ্রাম ওজনের কাতলা মাছটির কানকোর নিচে বড়শির আঘাতের চিহ্ন দেখা যায় এবং ১০ কেজি মাছটি পচে গলে যাওয়ায় আঘাতের চিহ্ন লক্ষ্য করা যায়নি। তবুও, মৃত্যুর কারণ বিশ্লেষণের জন্য ১২ কেজি ৫শ গ্রাম ওজনের কাতলা মাছটি হাটহাজারীর সিনিয়র উপজেলা মৎস্য অফিসার মোহাম্মদ ফারুক ময়েদুজ্জামানের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে সংরক্ষণ করা হয়।
এর আগে গত বুধবার দুপুরে দুই ফুটের বেশি দৈর্ঘ্যরে একটি রুই মাছ (ওজন প্রায় ১০ কেজি) হালদা নদীর রাউজান অংশের উরকিরচর বাকর আলী চৌধুরীঘাট ৪নং ওয়ার্ড এলাকা থেকে এবং মঙ্গলবার দুপুরে সাত ফুট দৈর্ঘ্যরে দূর্লভ প্রজাতির একটি ডলফিন (ওজন প্রায় ৯০ কেজি) হাটহাজারী উপজেলার গড়দুয়ারা ইউনিয়নের নয়াহাট এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়। আরও কয়েকদিন আগে উরকিরচর বাকর আলী চৌধুরীঘাট ৪নং ওয়ার্ড এলাকায় ১২ কেজি ওজনের একটি কাতলা মাছ মরে পঁচে বেসে উঠেছিল।
বিষয়টি নিশ্চিত করেন ১০নং উত্তর মাদার্শার মাছুয়াঘোণা এলাকার হালদা ডিমসংগ্রহকারী সমিতির সভাপতি মো. শফিউল আলম। তিনি জানান, বছর দু-তিনেক আগেও কিছু লোভী, দুর্বৃত্ত, ভ‚মিদস্যু, নিষিদ্ধ যান্ত্রিকযানের অত্যাচার অনেকটা কমলেও মৎস্য শিকারীরা মা-মাছ শিকার অব্যাহত রেখেছে। বর্তমানে হালদা নদী পাহারাবিহীন এবং পুরোপুরি অরক্ষিত। এ সুযোগে মৎস্য শিকারীরা সিন্ডিকেট করে কখনও বড়শি, কখনও বিষ প্রয়োগে মা-মাছ শিকার করে যাচ্ছে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্টরা তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। স্থানীয়রা মৎস্য শিকারীদের চিনলেও কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। প্রয়োজনে গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে মৎস্য শিকারীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে হালদাকে বাঁচানো সম্ভব হবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মনুষ্যসৃষ্ট ধ্বংসাত্মক কর্মকাÐে বিপর্যস্ত হালদার পরিবেশ-প্রকৃতি, কার্প জাতীয় মা-মাছ ও জীববৈচিত্র। হুমকির মুখে মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদার কার্প জাতীয় (রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাউস) মা-মাছের বিচরণ আজ মারাত্মক হুমকিতে। বিভিন্ন উৎস থেকে শাখা খালের মাধ্যমে পোল্ট্রি, গৃহস্থালি, মানববর্জ্য, শিল্প-কলকারখানার ইত্যাদি বিষাক্ত বর্জ্য পদার্থ কঠিন ও তরলাকারে টানা বৃষ্টি এবং পাহাড়ি ঢলের পানির স্রোতে প্রতিনিয়ত হালদা নদীতে পড়ছে। এতে হালদা নদীর পানির বিভিন্ন ভৌত-রাসায়নিক গুণাবলি পরিবর্তন হয়ে দূষিত করছে জলজ পরিবেশকে।
ফলে হালদা নদীর ওপর নির্ভরশীল জেলে পরিবারগুলোসহ হাজারও লোকের জীবন-জীবিকা আজ মানবসৃষ্ট দুর্যোগের কারণে হুমকির মুখে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, হালদায় মা-মাছের নিরাপদ প্রজনন কেন্দ্র এই হালদা নদী মানুষের লোভের কারণে তার স্বাভাবিক অবস্থা হারিয়েছে। সঠিক পদক্ষেপ ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে মহাসংকট যেন হালদার চারপাশে। পাশাপাশি মা-মাছ শিকার, নদীর বালু উত্তোলন ও নদী দখল ও দূষণ ইত্যাদি চলছে অবাধে।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, কতিপয় লোভী মৎস্যজীবী খালের মধ্যে বিষ প্রয়োগ করছে। অথচ হালদা নদীর একটি মা-মাছ বছরে ৪ কোটি টাকার অবদান রাখে বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
হালদা পারের হাটহাজারী উপজেলার গড়দুয়ারা ইউনিয়নের প্রবীণ ডিমসংগ্রহকারী কামাল উদ্দিন সওদাগর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, স¤প্রতি বিভিন্ন কল কারখানার নিষ্কাশিত বর্জ্য, নদী দখল, নালা-নর্দমার দূষিত পানির সংমিশ্রণ এবং মনুষ্যসৃষ্ট দূষণের কারণে হালদার পরিবেশ মারাত্মকভাবে বিঘিœত হচ্ছে। ধারণা করছি, এ কারণে মা-মাছ মরে ভেসে উঠার দৃশ্য এখন নিত্য ঘটনা। যদিও এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট মৎস্য বিভাগ ও পরিবেশ বিভাগের এখনও পর্যন্ত তেমন কোনো দৃম্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে অচিরেই প্রকৃতি প্রদত্ত এ সম্পদ ধ্বংস হয়ে যাবে বলে মনে করছেন ওই প্রবীণ ডিমসংগ্রহকারী।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শ্রীবাস চন্দ্র চন্দ জানান, ২০২২ সালের নভেম্বরের পর এমন কোনো পরিস্থিতি হালদায় সৃষ্টি হয়নি। বিষয়টি বেশ উদ্বেগজনক। ইতোমধ্যে আমার অফিসের একটি টিম উদ্ধারকৃত মৃত কাতলা মা-মাছের ময়না তদন্তের জন্য এখনও হালদায় কাজ করছে। পাশাপাশি আজকের ঘটনায় (মৃত দুইটি কাতলা মাছ মারা যাওয়া) একটি তদন্ত কমিটির গঠন করা হবে। আসলে দূষণ রোধে আমরা কাজ করছি। তবুও, যেসব অভিযুক্ত মিল কল-কারখানায় এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট-ইটিপি নেই তাদের তালিকা তৈরী করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এদিকে চবি’র প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির কো-অর্ডিনেটরের দায়িত্বে থাকা হালদা গবেষক ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া জানান, হালদা নদীতে প্রায় বিগত দুই বছর পরে কয়েকদিনের মধ্যে চারটি ব্রুড মাছ (কার্প জাতীয় মা-মাছ) এবং একটি ডলফিনের মৃত্যু অবশ্যই একটি অস্বাভাবিক ঘটনা। আরও একটি হতাশাজনক বিষয়- বিগত ২০১৬ সালের পর হালদা নদীতে এবছর সবচেয়ে কম পরিমাণ ডিম দিয়েছে যা পরিমাণে নমুনা ডিমের চেয়ে একটু বেশি।
এছাড়া শাখা খালসমূহের মানবসৃষ্ট ধ্বংসাত্মক দূষণের কারণে পরিবেশগত বিপর্যয় এবং বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে মৎস্যদস্যুদের মা-মাছ মারার প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়া প্রাথমিকভাবে অন্যতম কারণ বলে মনে করি। তবে, হালদা নদীর ঐতিহ্য তথা হালদাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে বিষয়টিকে হালকাভাবে নেয়ার কোনো সুযোগ নাই। এই বিপর্যয় রোধে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দ্রুত উচ্চ পর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে কারণ উদ্ঘাটনের জন্য জোর দাবি জানান এই বিশেষজ্ঞ।