পৌরসভার কাউন্সিলরদের এড়িয়ে চলছেন প্রশাসকরা

33

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর পৌর মেয়রদের অপসারণ করে সব পৌরসভায় প্রশাসক নিয়োগ করে সরকার। চট্টগ্রামের ১৫টি পৌরসভার দায়িত্ব এখন প্রশাসকদের হাতে। ইতোমধ্যে প্রশাসকরা পৌরসভার যাবতীয় কর্মকান্ডে অংশ নিচ্ছেন। পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে নিয়ে প্রশাসনিক কার্যক্রম চালালেও এখনই সঙ্গে নিচ্ছেন না পৌর কাউন্সিলরদের। চট্টগ্রামের নির্বাচিত ১৪ পৌরসভার ১৬৮ কাউন্সিলরকে এড়িয়ে চলছেন সরকার নিযুক্ত প্রশাসকরা। আপাতত নাগরিক সেবার বাইরে অন্য কোন কাজে সম্পৃক্ত হচ্ছেন না প্রশাসকরা। কাউন্সিলরদের সম্পৃক্ত করার মতো নির্দেশনাও সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন প্রশাসকরা। এখনও পৌর কার্যক্রমে অংশ নেয়া নিয়ে সুস্পষ্ট কোন নির্দেশনা না পাওয়ায় উদ্বেগ-উৎকন্ঠায় আছেন কাউন্সিলররা।
চারটি পৌরসভার ১৫ জন কাউন্সিলর জানান, সরকার নিযুক্ত প্রশাসকদের কেউ কেউ ইতোমধ্যে পৌরসভার দায়িত্ব বুঝে নিয়েছেন। কেউ কেউ পূর্বের কর্মস্থলে থেকেই কার্যক্রম চালাচ্ছেন। দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে এখনো কাউন্সিলরদের সাথে কোনরূপ সভা করেননি প্রশাসকরা। পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে যোগাযোগ রেখে কার্যক্রম সামলাচ্ছেন। বর্তমানে পৌরসভার সকল ধরনের উন্নয়ন কর্মকান্ড বন্ধ। কাউন্সিলরদের এভাবে এড়িয়ে চলায় অনেকের মধ্যে অপসারণ ভীতি কাজ করছে। পদে থেকেও যেন কোন কাজ নেই অবস্থা কাউন্সিলরদের। সুস্পষ্ট কোন নির্দেশনা না পাওয়ায় সকলের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা বিরাজ করছে।
চট্টগ্রাম স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ও পটিয়া পৌরসভার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসক মো. সাদি উর রহিম জাদিদ পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমি গত সপ্তাহে দায়িত্ব নিয়েছি। দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে রুটিন ওয়ার্কগুলো নিয়মিত পালন করছি। নাগরিক সেবাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। বিশেষ করে জন্ম নিবন্ধনসহ অন্যান্য সেবা দেয়ার মতো কাজগুলোই করছি। বাকি কোনকিছুতে যাচ্ছি না। এখনো কাউন্সিলর ও মেম্বার কারো সাথে বসছি না। এরকম কোন নির্দেশনাও আমরা পাইনি।’
এদিকে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রশাসকরাও হিমশিম খাচ্ছেন। অনেকেই পৌরসভায় নিয়মিত না যাওয়ায় নাগরিক সেবা পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ। কয়েকটি পৌরসভায় এখনও প্রশাসকরা দায়িত্ব বুঝে নেননি। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথেও যোগাযোগ করেননি। দক্ষিণ চট্টগ্রামের একটি পৌরসভার কর্মচারীরা বলেন, ‘আমাদের পৌরসভায় প্রশাসক নিয়োগ দিলেও উনার সাক্ষাৎ পাইনি। আমরা গত বৃহস্পতিবার নিজেরা গিয়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। রবিবারে (আজ) আবার যেতে বলেছেন। এতে পৌরসভার সবধরনের কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। প্রশাসকের স্বাক্ষর না থাকায় প্রচুর মানুষের সনদ বিতরণ বন্ধ রয়েছে।’
গত ১৯ আগস্ট সারাদেশের মতো চট্টগ্রামের বারৈয়ারহাট, মিরসরাই, ফটিকছড়ি, নাজিরহাট, স›দ্বীপ, সীতাকুÐ, হাটহাজারী, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, বোয়ালখালী, পটিয়া, চন্দনাইশ, দোহাজারি, সাতকানিয়া, বাঁশখালী পৌরসভার মেয়রদের অপসারণ করা হয়। এসব পৌরসভায় দায়িত্ব দেয়া হয় সরকারের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের। এরমধ্যে হাটহাজারী ছাড়া বাকিসব পৌরসভায় নির্বাচিত মেয়র ছিলেন। যেখানে মেয়রদের সাথে প্রতি পৌরসভায় ১২ জন করে ১৬৮ জন কাউন্সিলর দায়িত্ব পালন করতেন।
এই কাউন্সিলরদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগ সমর্থিত হওয়ায় গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর থেকে তারা গা ঢাকা দিয়েছেন। অনেকেই মামলা খেয়ে স্বাভাবিক কার্যক্রম থেকে দূরে রয়েছেন। অনেকেই পৌর কার্যক্রমে যুক্ত হতে না পেরে হতাশ হয়েছেন। বিশেষ করে দোহাজারি, ফটিকছড়ি ও নাজিরহাট পৌরসভার কাউন্সিলররা অল্প কিছুদিন দায়িত্ব পালন করার পর এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ায় মুষড়ে পড়েছেন। কাউন্সিলররা ধারণা করেছিল, প্রশাসক নিয়োগের পর তাঁদের যেহেতু অপসারণ করা হয়নি পৌরসভার নিয়মিত কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। কিন্তু প্রশাসকরা দায়িত্ব নেয়ার পরেও তাঁদের সাথে কোন সভা না করায় অপসারণ ও মামলা আতঙ্কে দিনাতিপাত করছেন কাউন্সিলরা। অনেক কাউন্সিলর পরিস্থিতি বুঝে পৌর অফিসে গেলেও স্বাভাবিক কার্যক্রম থেকে বিরত রয়েছেন।
ফটিকছড়ি পৌরসভার প্যানেল মেয়র গোলাপ মাওলা পূর্বদেশকে বলেন, ‘পৌরসভায় কোন কাজ হচ্ছে না। সকল উন্নয়ন কাজ বন্ধ। সকল ধরনের সার্টিফিকেট, ট্রেড লাইসেন্স দেয়া হচ্ছে না। নিযুক্ত প্রশাসক অফিস স্টাফদের সাথে বসে, আমাদেরকে ডাকে না। হ্যাঁ, না কিছুই বলছে না। মেয়র অপসারণ করেছে, আমাদের দোষ কি? পৌরসভার অফিস না চললে তো মানুষ ট্যাক্স দিবে না।’
পটিয়া পৌরসভার সংরক্ষিত কাউন্সিলর ফেরদৌস বেগম পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমি অফিস করি। এখনো কোন ঝামেলা হয়নি। বাকিদের কথা আমি বলতে পারবো না। যে প্রশাসক নিয়োগ করা হয়েছে উনার আমাদের সাথে কোন দেখা হয়নি। স্টাফদের সাথে যোগাযোগ করেন। পৌরসভার অধিকাংশ কার্যক্রম বন্ধ।’
সরকারি প্রজ্ঞাপনে জানা যায়, পটিয়ায় চট্টগ্রাম স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক, বারৈয়ারহাটে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক), সীতাকুন্ডে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব), সাতকানিয়ায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এলএ), বাঁশখালীতে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। চন্দনাইশ, রাউজান, মিরসরাই, রাঙ্গুনিয়া, সন্দ্বীপ, ফটিকছড়ি ও বোয়ালখালীতে উপজেলার সহকারি কমিশনার (ভূমি) প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। নাজিরহাটে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার সিনিয়র সহকারি কমিশনার ও দোহাজারিতে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের আরএম শাখার সিনিয়র সহকারি কমিশনার প্রশাসক পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। হাটহাজারিতে উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করছেন।
সর্বশেষ ২০২০ সালের ২৮ ডিসেম্বর প্রথম ধাপে সীতাকুন্ডে, ২০২১ সালের ১৬ জানুয়ারি সন্দ্বীপ, বাঁশখালী, ২০২১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর বোয়ালখালী, ২০২১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পটিয়া, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, ২৮ ফেব্রুয়ারি বারৈয়ারহাট, মিরসরাই, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, ২০২২ সালের ২ নভেম্বর ফটিকছড়ি, ২০২৩ সালের ১৭ জুলাই দোহাজারি, ২০২৩ সালের ১৬ মার্চ নাজিরহাট পৌরসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। হাটহাজারীকে ২০১২ সালে পৌরসভা ঘোষণা করা হলেও সেখানে এখনো নির্বাচন হয়নি। প্রশাসক নিয়োগ করেই এ পৌরসভার কার্যক্রম চলছিল।