পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণ ও তাঁদের উপর নাযিলকৃত আসমানী কিতাবে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরিচিতি ও প্রশংসা

8

সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আযহারী

সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী হলেন আমাদেও প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম। তিনি যে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী হিসেবে দুনিয়ায় শুভাগমন করবেন সেটা পূর্বাপর সকল ধর্মীয়গ্রন্থ ও জ্ঞানতাপসদের কাছে জানা ছিল এবং তাঁদের লিখনিতেও তা বিদ্যমান। যদিওবা তাঁর আগমনের পরে সত্য জানা সত্তে¡ও অনেকে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লামকে সত্য নবী হিসেবে মেনে নেয়নি।
আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়্যতের সত্যতার অন্যতম প্রমাণ হলো; পূর্ববর্তী প্রত্যেক নবী-রাসূল নিজ নিজ যুগে তাঁদের উম্মতদেরকে আমাদের প্রিয়নবী’র আবির্ভাবের সুসংবাদ দিয়ে গেছেন এবং তাঁর উপর ঈমান আনায়নের ওয়াদা নিয়েছেন। আল্লাহ তাআ’লা কোরআন পাকে এরশাদ করেনঃ “হে প্রিয় রাসুল! আপনি স্মরণ করুন ঐ দিনের কথা, যখন আল্লাহ তা’আলা নবীগন থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন এ মর্মে যে, যখন আমি তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমত দিয়ে দুনিয়ায় প্রেরন করবো; তারপর তোমাদের কাছে এক মহান রাসুল আসবেন এবং তোমাদের নব্য়ুত ও কিতাবের সত্যতার সাক্ষ্য প্রদান করবেন, তখন তোমরা অবশ্য অবশ্যই তাঁর উপর ঈমান আনবে এবং অবশ্যই তাঁকে সাহায্য করবে। অতপর (আল্লাহ) বলেন, তোমরা কি এ সব কথার উপর অঙ্গীকার করছো এবং এই শর্তে আমার ওয়াদা গ্রহন করে নিয়েছো? (তখন) তাঁরা সকলেই সমস্বরে বলেছিলেন, আমরা অঙ্গীকার করছি। তিনি (আল্লাহ) বললেন, তাহলে এবার তোমরা একে অপরের সাক্ষী থাকো। আর আমিও তোমাদের সাথে মহাসাক্ষী রইলাম। অতঃপর যে লোক এই ওয়াদা থেকে ফিরে দাঁড়াবে, সেই হবে নাফরমান। (আল ইমরান ৮১-৮২)
তাই হযরত আদম, হযরত ইব্রাহীম, হযরত ঈসাসহ সকল নবী-রাসূল আলাইহিমুস সালাম তাঁদের উম্মতদেরকে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিষয়ে বিশেষ গুরুত্বসহকারে উপদেশ ও নসীহত করে গেছেন। (জুরকানি শরীফ ২/২৩৮, খাসায়েস আল কুবরা: সুয়ূতী ১/১২-১৩)।
অনুরূপভাবে তাওরাত ও ইঞ্জিলেও বিদ্যমান ছিল এ শুভসংবাদসহ প্রিয় নবিজীর বিশেষ গুনাবলীর বর্র্ণনা। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, “সে সমস্ত লোক, যারা আনুগত্য অবলম্বন করে এ রসূলের, যিনি উম্মী (আসল) নবী, যাঁর সম্পর্কে তারা নিজেদের কাছে রক্ষিত তওরাত ও ইঞ্জিলে লেখা দেখতে পায়, তিনি তাদেরকে নির্দেশ দেন সৎকর্মের, বারণ করেন অসৎকর্ম থেকে; তাদের জন্য যাবতীয় পবিত্র বস্তু হালাল ঘোষনা করেন ও নিষিদ্ধ করেন হারাম বস্তুসমূহ এবং তাদের উপর থেকে সে বোঝা নামিয়ে দেন এবং বন্দীত্ব অপসারণ করেন যা তাদের উপর বিদ্যমান ছিল। সুতরাং যেসব লোক তাঁর উপর ঈমান এনেছে, তাঁর সাহচর্য অবলম্বন করেছে, তাঁকে সাহায্য করেছে এবং সে নূরের অনুসরণ করেছে যা তাঁর সাথে অবতীর্ণ করা হয়েছে, শুধুমাত্র তারাই নিজেদের উদ্দেশ্য সফলতা অর্জন করতে পেরেছে।” (আ’রাফঃ ১৫৭)
হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস্ সালাম : হযরত ইব্রাহীম এবং হযরত ইসমাইল আলাইহিমাস্ সালাম যখন আল্লাহর ঘর বায়তুল্লাহ শরীফ তৈরী করছিলেন, তখন তিনি আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করেন, “হে আমার রব ! তুমি (এই আরব ভূমিতে আমার ইসমাইলের বংশে) তাদের মধ্য হতেই সেই মহান রাসুলকে প্রেরণ করো- যিনি তোমার আয়াতসমুহ তাদের কাছে পাঠ করে শুনাবেন, তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেবেন এবং অপবিত্রতা থেকে তাদের পবিত্র করবেন।” (সুরা আল বাকারা ১২৯ আয়াত।
হযরত ঈসা আলাইহিস্ সালাম : হযরত ঈসা আলাইহিস্ সালামও নিজ উম্মত বনী ইসরাইলকে শেষ নবীর সুসংবাদ দিয়ে গেছেন। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, “স্মরণ করুন ঐ সময়ের কথা, যখন মরিয়ম তনয় ঈসা বলেছিল, হে বনী ইসরাইল, আমি তোমাদের কাছে রাসুল হয়ে প্রেরিত হয়েছি। আমি আমার পুর্ববর্তী তওরাত কিতাবের সত্যতার সাক্ষ্য দিচ্ছি এবং এমন এক মহান রাসুলের সুসংবাদ দিচ্ছি; যিনি আমার পরে আগমন করবেন এবং তাঁর নাম হবে ‘আহমদ’।” (আছ্ছফ-৬।)
এ প্রসঙ্গে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, “আমি হযরত ইব্রহীম আলাইহিস্ সালামের দোয়ার ফসল, হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের সুসংবাদ এবং আমার মা’র শুভদৃশ্য যখন আমাকে তিনি প্রসব করেন তখন দেখতে পেলেন যে তাঁর থেকে এমন একটি নূর প্রকাশিত হল যা তাঁর সামনে সিরীয়ার বুসরা শহরের প্রাসাদগুলো সুস্পষ্টভাবে উদ্ভাসিত করে দিল। (মুসতাদরাক, হা-৪১১১)
আহলে কিতাবরা আশা করত তারা হবে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের উপর প্রথম ঈমান আনায়নকারী, যেহেতু তারা তাঁকে এমনভাবে জানত ও চিনত যেভাবে তারা নিজেদের সন্তানদেরকে জানত ও চিনত। আল্লাহ তাআ’লা তাদের সম্পর্কে এরশাদ করেন, “আমি যাদেরকে কিতাব দান করেছি, তারা তাঁকে চেনে, যেমন করে চেনে নিজেদের পুত্রদেরকে। আর নিশ্চয়ই তাদের একটি স¤প্রদায় জেনে শুনে সত্যকে গোপন করে।” (বাকারাঃ ১৪৬)
আল্লাহ তাআ’লা আরও এরশাদ করেন, “যখন তাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন রসূল আগমন করলেন যিনি ঐ কিতাবের সত্যায়ন করেন যা তাদের কাছে রয়েছে; তখন তাদের (আহলে কিতাব) একদল আল্লাহর গ্রন্থকে পশ্চাতে নিক্ষেপ করল যেন তারা জানেই না।” (বাকারাঃ ১০১)
ইহুদী পÐিতরা অকপটে স্বীকার করতো যে, হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর নবী। তাদের কেউ কেউ ইসলামও গ্রহণ করেছে। হযরত আবূ হুরাইরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, একবার নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইয়াহুদীদের বাইতুল মিদরাস (যে ঘরে তারা তাওরাত ইত্যাদি পড়ে শোনাতো) এ গেলেন এবং বললেন, তোমাদের সর্বাপেক্ষা বড় আলেমকে নিয়ে আস। তারা আব্দুল্লাহ বিন সুরিয়াকে নিয়ে আসল। তিনি তাকে নিরালায় নিয়ে গ্রষ্টার কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি জানেন আমি আল্লাহর রাসূল? উত্তরে বললো, হ্যাঁ, অবশ্যই জানি, আর আমাদের সকলেই আমার মতোই জানে। আপনার গুণাবলি তাওরাতে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু আমাদের লোকেরা প্রতিহিংসাবশত তা মানতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আপনার ইসলাম গ্রহণ করতে বাঁধা কোথায়? সে বলল, আমি গোত্রীয় লোকদের বিরুদ্ধে চলা পছন্দ করি না। আমি আশাবাদী তারা আপনার কথা মেনে নিয়ে ইসলাম গ্রহণ করবে আর তখন আমিও ইসলাম গ্রহণ করব।’ (আল ওয়াফা: ১/১০৩, আশশিফা: ১/৩৬৩, সীরাতে ইবনে হিশাম: ২/৫১৮)
আল্লাহ তায়া’লা অন্যত্র এরশাদ করেন, “আল্লাহ ঈমানদারদের উপর অনুগ্রহ করেছেন যে, তাদের মাঝে তাদের নিজেদের মধ্য থেকে নবী পাঠিয়েছেন। তিনি তাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করেন। তাদেরকে পরিশোধন করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমতের শিক্ষা দেন। বস্তুতঃ তারা ছিল পূর্ব থেকেই পথভ্রষ্ট।” (আ-ল ইমরান-১৬৪)
পূর্ববর্তী উম্মতগণের আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের ওসীলায় দুআ ও সাহায্য প্রার্থনা :
এরই ধারাবাহিকতায় পূর্ববর্তী উম্মতগন বিভন্ন যুদ্ধ-বিগ্রহ ও বিপর্যয়কালে আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওসীলা নিয়ে দোয়া করত এবং এতে তারা সফলও হত। আল্লাহ তাআ’লা এরশাদ করেন, “যখন তাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে কিতাব আসল, যা সে বিষয়ের সত্যায়ন করে; যা তাদের কাছে রয়েছে এবং যাঁর ওসীলায় তারা পূর্বে কাফিরদের উপর বিজয় প্রার্থনা করত। অবশেষে যখন তাদের কাছে পৌঁছলেন তিনি যাঁকে তারা চিনত, তখন তারা তাঁকে চেনার পরও চিনতে পারেনি এবং তারা অস্বীকার করে বসল। অতএব, অস্বীকারকারীদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত।” (বাক্বরা: ৮৯)
আল্লাহ তাআ’লা আরও এরশাদ করেন, ‘আমি যাদেরকে কিতাব দিয়েছি (ইয়াহুদী-খ্রিস্টান) তারা তাঁকে চিনে; যেমনভাবে চিনে আপন সন্তানদেরকে’। (সূরা বাকারা: ১৪৬)
মহাগ্রন্থ আল কোরআন সে সুসংবাদের দিকে ইশারা দিয়ে আল্লাহ তাআ’লা বলেন, “কাফেররা বলেঃ “আপনি প্রেরিত ব্যক্তি নন। আপনি বলে দিন, আমার ও তোমাদের মধ্যে প্রকৃষ্ট সাক্ষী হচ্ছেন আল্লাহ এবং ঐ ব্যক্তি, যার কাছে গ্রন্থের জ্ঞান আছে।” (রা’দঃ ৪৩)
তিনি সে রাসুল যাঁর আগমনের বার্তা পূর্ববর্তীরা দিয়েছেন। কিন্তু আহলে কিতাবদের কতিপয় এ সত্য গোপন করেছে, তাদের পবিত্র গ্রন্থে যা ছিল তা অস্বীকার করল, একে তারা পশ্চাতে নিক্ষেপ করল, যেন তারা জানেই না।

লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়,
খতীব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ