পুলিশ স্বামীর অবৈধ অর্থে ৫ জাহাজের মালিক সায়মা

17

তুষার দেব

দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা-বাণিজ্যের সাথে সম্পৃক্ত নন পুলিশের এডিসি কামরুল হাসানের স্ত্রী সায়মা বেগম। বৈধ আয়ের কোনো উৎস ছাড়াই তিনি কয়েক কোটি টাকা দামের পাঁচটি জাহাজের (বার্জ) মালিক। মূলত পুলিশ কর্মকর্তা কামরুল হাসান নিজের উপার্জিত অবৈধ অর্থেই এসব জাহাজ স্ত্রীর নামে কিনেছেন বলে দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
দুদক সূত্র জানায়, সংস্থাটির অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসা কামরুল হাসান দম্পতির অবৈধ সম্পদের মধ্যে স্ত্রীকে পাঁচটি বার্জ কিনে দেওয়ার বিবরণও রয়েছে। ওই পাঁচ জাহাজের মধ্যে চারটি হলো- এমভি প্যাসিফিক রাইডার, এমভি পানামা ফরেস্ট-১, এমভি রাইসা তারাননুম, বার্জ আল বাইয়েত। কাগজে-কলমে জাহাজগুলোতে দেড় কোটি টাকার বিনিয়োগ দেখানো হয়েছে সায়মা বেগমের। প্রকৃতপক্ষে এসব জাহাজে বিনিয়োগের পরিমাণ তিন থেকে চারগুণ বেশি হতে পারে।
এসব জাহাজ ছাড়াও স্ত্রী সায়মা বেগমের নামে ‘সওদাগর নেভিগেশন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে দিয়েছেন পুলিশের এডিসি কামরুল হাসান। নগরীর আগ্রাবাদের পোর্টল্যান্ড সাত্তার টাওয়ারের চতুর্থ তলায় প্রতিষ্ঠানটির অফিস। পাঁচটি বার্জের এক তৃতীয়াংশের মালিক সওদাগর নেভিগেশন।
দৃশ্যমান আয়ের কোনো উৎস না থাকলেও ২ কোটি ৫৩ হাজার ২৪০ টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন কামরুল হাসানের স্ত্রী সায়মা বেগম। এরমধ্যে ১ কোটি ২৫ লাখ টাকার স্থাবর সম্পদ ও ১ কোটি ৯৯ লাখ ২৮ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদ রয়েছে। একই সময়ে সায়মা বেগমের মোট ৩১ লাখ ৩৬ হাজার ৬৫৫ টাকা পারিবারিক ও অন্যান্য ব্যয়ের তথ্য পাওয়া যায়। অর্থাৎ পারিবারিক ও অন্যান্য ব্যয়সহ তার মোট অর্জিত সম্পদের পরিমাণ ২ কোটি ২ লাখ ৯৯ হাজার ৬২১ টাকা। এসব সম্পদ অর্জনের বিপরীতে তার বৈধ ও গ্রহণযোগ্য আয়ের উৎস পাওয়া যায় ৪০ লাখ ১৪ হাজার ৪৩৩ টাকার। অর্থাৎ তার নামে ১ কোটি ৬২ লাখ ৮৫ হাজার ১৮৮ টাকার জ্ঞাত আয়ের উৎস বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের তথ্য পাওয়া গেছে। এর বাইরে নগরীর হালিশহরে ৪০ শতক নাল জমি রয়েছে সায়মা বেগমের। যেগুলোর ক্রয়মূল্য ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা দেখানো হলেও বর্তমানে এই জমির বাজারমূল্য ১২ থেকে ১৫ কোটি টাকা। এছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংকে ৪৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র রয়েছে তার।
দুদকের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রামে পুলিশের সাবেক ও বর্তমান আরও অন্তত ৪০ জন কর্মকর্তার অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য রয়েছে। মীর নজরুল ইসলাম, শাহ আলম, আবুল কাশেম চৌধুরী, এবিএম শাহাদাত হোসেন মজুমদার, সুমন কুমার দে, আবুল হাশেম, প্রদীপ কুমার দাশ, রেফায়েত উল্যাহ চৌধুরী, মোহাম্মদ শাহজাহানের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদক মামলা করেছে। এরা সকলেই পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে কর্মরত ছিলেন।
দুদকের আইনজীবী কাজী সানোয়ার আহমেদ লাভলু বলেন, পুলিশ কর্মকর্তা কামরুল হাসানের ৯ কোটি ৭৩ লাখ ২২ হাজার ৪৪ টাকার এবং তার স্ত্রী সায়মা বেগমের ১ কোটি ৬২ লাখ ৮৫ হাজার ১৮৮ টাকার সম্পদের কোনো বৈধ উৎস পাওয়া যায়নি। চলতি বছরের গত ১৩ মে এ বিষয়ে কমিশন বরাবর প্রতিবেদন দাখিল করেন দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তা। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই পুলিশ কর্মকর্তার সম্পদ ক্রোকের জন্য আদালতে আবেদন দাখিলের অনুমতি দেয় কমিশন। গত ৭ জুলাই দুদক চট্টগ্রাম জেলা সমন্বিত কার্যালয়-১ এর সহকারী পরিচালক ও অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদ এমরান হোসেন আদালতের কাছে পুলিশ কর্মকর্তা কামরুল হাসানের সম্পদ ক্রোকের আবেদন করলে আদালত সেই আবেদন মঞ্জুর করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৮৯ সালের ১০ জানুয়ারি এসআই পদে পুলিশে যোগ দেন মোহাম্মদ কামরুল হাসান। বর্তমানে তিনি পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি)। ৩৫ বছরের চাকরিজীবনে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন এডিসি কামরুল হাসান। বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলায়। পুলিশে উপ-পরিদর্শক থেকে পরিদর্শক পদে পদোন্নতি পেয়ে চট্টগ্রামের কয়েকটি থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। মূলত ঐ সময়েই ‘বেহিসেবি অর্থ’ উপার্জন করেন তিনি। এছাড়া, নগর পুলিশের প্রসিকিউশন শাখার এডিসি থাকাকালে আসামিদের খাবারের অর্থ ভুয়া বিল বানিয়ে লোপাটের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। পুলিশের করা অভ্যন্তরীণ তদন্তেও এ অভিযোগের সত্যতা মিলেছে।
দুদকের অনুসন্ধানে এডিসি কামরুল হাসানের ১২ কোটি ৭২ লাখ ৯২ হাজার ৬৯৫ টাকার স্থাবর ও ১ কোটি ২৩ লাখ ৩৯ হাজার ২১৬ টাকার অস্থাবর সম্পদের তথ্য উঠে এসেছে। এছাড়া একই সময়ে তার মোট ৭০ লাখ ২৮ হাজার ২৪১ টাকা পারিবারিক ও অন্যান্য ব্যয়ের তথ্য পাওয়া যায়। অর্থাৎ পারিবারিক ও অন্যান্য ব্যয়সহ কামরুল হাসানের মোট অর্জিত সম্পদের পরিমাণ ১৪ কোটি ৬৬ লাখ ৬০ হাজার ১৫২ টাকার। এসব সম্পদ অর্জনের বিপরীতে তার গ্রহণযোগ্য আয়ের উৎস পাওয়া গেছে ৪ কোটি ৮০ লাখ ৩২ হাজার ৮৭ টাকার। সে হিসেবে অর্জিত সম্পদের চেয়ে বৈধ আয়ের উৎস ৯ কোটি ৮৬ লাখ ২৮ হাজার ৬৫ টাকা কম।
নগরীর অভিজাত খুলশী আবাসিক এলাকায় ‘ফয়জুন ভিস্তা’ অ্যাপার্টমেন্টের অষ্টম তলায় ২ হাজার ৫৭০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট ও ১৩৬ বর্গফুটের গাড়ি পার্কিং রয়েছে কামরুল হাসানের। সোয়া ৭ লাখ টাকায় ফ্ল্যাট ও ২৫ হাজার টাকায় পার্কিং স্পেস কিনেছেন বলে আয়কর নথিতে কামরুল হাসান দাবি করলেও ওই এলাকায় আড়াই হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাটের বর্তমান বাজারমূল্য ৩ কোটি টাকারও বেশি। এছাড়া নগরের পশ্চিম নাসিরাবাদ এলাকায় ৭ শতক জমির ওপর চারতলা বাড়ি করেছেন কামরুল হাসান। জমিসহ ঐ বাড়ি নির্মাণে ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা খরচ দেখানো হলেও নাসিরাবাদ এলাকায় এক শতক জমির মূল্যই এক কোটি টাকার বেশি। সে হিসেবে কামরুল হাসানের সেই ভ‚মি ও ভবনের মূল্য কমপক্ষে ৮ কোটি টাকা।
চট্টগ্রামের বাইরে ঢাকায়ও সম্পদ গড়ে তুলেছেন কামরুল হাসান। ঢাকার সাভারে ১০৭ শতক জমির ওপর ‘সাভার সিটি সেন্টার’ নামে ১২ তলা ভবনের চারজন অংশীদারের একজন তিনি। সেখানে কাগজ-কলমে ৭ কোটি ৫২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন কামরুল হাসান। ভবনটির বেজমেন্টে ৯০টি, প্রথম তলায় ১৪০টি, দ্বিতীয় তলায় ১৪৬টি, তৃতীয় তলায় ৮৯টি ও চতুর্থ তলায় ১০৩টি দোকান এবং পাঁচ হাজার বর্গফুটের ফুডকোর্ট, পঞ্চম তলায় অফিস ও ষষ্ঠ তলায় ৬৭টি ফ্ল্যাট রয়েছে। বাজারমূল্যে এ সম্পদের মূল্য শতকোটি টাকারও বেশি। সেটি ছাড়াও সাভার সিটি টাওয়ার নামে একটি ১০ তলা আবাসিক ভবনেরও অংশীদার কামরুল হাসান। সেখানে ৫৪টি ফ্ল্যাট রয়েছে।