পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম দ্রæত শুরু করা জরুরি

3

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন

সরকারের এক নির্দেশনা অনুযায়ী গত ১৮ আগস্ট, ২০২৪ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়সহ (!) বাংলাদেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার কথা। সে অনুযায়ী আমরা ধরে নিতে পারি, দীর্ঘদিন থেকে স্থবির হয়ে থাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রম ১৮ আগস্ট থেকেই শুরু হয়েছে। শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন দমন করতে গিয়ে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের দমন-পীড়নের হাত ধরে এই আন্দোলন সহিংস রূপ ধারণ করায় বাংলাদেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান প্রক্রিয়া অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের বিপুল বিক্ষোভকে সামাল দিতে ১৮ জুলাই থেকে বাংলাদেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন পরবর্তীতে দেশব্যাপী ছাত্র-জনতার যে ব্যাপক ও তীব্র আন্দোলনে পরিণত হয়, তার সূত্র ধরে কার্যত বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা এক ধরনের স্থবির বা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে আছে। এমনকি তারও আগে বিশেষ করে বাংলাদেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সর্বজনীন পেনশন স্কিম প্রত্যয় থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বাদ দেওয়ার দাবিতে জুলাইয়ের এক তারিখ থেকে বাংলাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস, পরীক্ষা ও প্রশাসনিক কাজ বর্জনের ডাক দিয়ে সর্বাত্মক আন্দোলন শুরু করায় কার্যত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম রীতিমতো বন্ধ হয়ে আছে।
জুলাইয়ের ১ তারিখ থেকে হিসাবে নিলে প্রায় দেড়-দুই মাস বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধই আছে। কিন্তু এরইমধ্যে সৃষ্টি হয় নতুন ইতিহাস। সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন পরবর্তীতে ছাত্র-জনতার সম্মিলিত সরকার পতনের আন্দোলনে পরিণত হয়। ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে আগস্টের ৫ তারিখ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন হয়। এরপর ৮ আগস্ট একটি অন্তর্বতীকালীন সরকারের যাত্রা শুরু হয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরে ১৭ জন উপদেষ্টার সমন্বয়ে এই সরকার রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম শুরু করলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় কোনও বিশেষ উপদেষ্টার হাতে না রেখে প্রধান উপদেষ্টার অধীনে রাখায় এ বিষয়ে আমরা তেমন কোনও ত্বরিত সিদ্ধান্ত দেখতে পাইনি। ফলে অন্যান্য ক্ষেত্রে এরইমধ্যে অস্থির ও অস্থিতিশীল বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গ কাজ করতে শুরু করলেও শিক্ষাক্ষেত্রে স্বাভাবিকতা ফিরে এসেছে মোটাদাগে আজ থেকে। কেননা, আজকে থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়সহ (!) সব প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এরকম একটা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আজ থেকে খুললেও নিজস্ব অপারেশন মডিউলের কারণে বাংলাদেশের কোনও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে পারার কথা নয়। অথচ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দেওয়া বা খোলার ব্যবস্থা করা অধিকতর জরুরি বলে আমি মনে করি। এমনকি কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণে স্থগিতকৃত এইচএসসি পরীক্ষাও আগামী ১১ সেপ্টেম্বর থেকে নতুন করে শুরু করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে যাওয়া কথা, কিন্তু সবচেয়ে বেশি জরুরি যেটা, সেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খোলা সম্ভব হয়নি। তাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যাপারে দ্রæত সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি বলে মনে করি। কেননা, শুধু ঘোষণার মাধ্যমে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দেওয়া টেকনিক্যালি সম্ভব না। আমরা সবাই জানি ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপাচার্য, প্রক্টোরিয়াল বডি এবং বিভিন্ন হলের প্রাধ্যক্ষরা গণহারে পদত্যাগ করেছেন। ফলে, বর্তমানে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রীতিমতো অভিভাবকহীন অবস্থায় আছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম শুরু করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়।
বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু হয়। অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট বা রিজেন্ট বোর্ডের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য বা উপ-উপাচার্য না থাকায় সিন্ডিকেটের সভা ডাকার কোনও সুযোগ নেই। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো খুলে দেওয়া না হলে, শিক্ষার্থীরা হলে এসে উঠতে না পারলে, শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা রীতিমতো অসম্ভব। তাই বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খোলার প্রক্রিয়া হচ্ছে প্রথমত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, রেজিস্ট্রার (যেখানে প্রয়োজন) এবং ট্রেজারার (যেখানে প্রয়োজন) নিয়োগ দিতে হবে। উপাচার্য (অন্যান্য পদে নিয়োগ না-হলেও!) নিয়োগ পাওয়ার পর তিনি বিভিন্ন আবাসিক হলের প্রাধ্যক্ষদের এবং হলের হাউজটিউটর নিয়োগ দিয়ে হল প্রশাসন গঠন করবেন। হল প্রশাসন পুনর্গঠনের পর বৈধ শিক্ষার্থীদের মধ্যে আসন-বরাদ্দ দিয়ে, আসন বণ্টন করে হলে বৈধ শিক্ষার্থীদের তোলার ব্যবস্থা করতে হবে। হল প্রশাসন পুনর্গঠনের পাশাপাশি ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রক্টোরিয়াল বডি নিয়োগ দিতে হবে। এবং এই পুরো প্রক্রিয়াটা সম্পন্ন না করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দেওয়া সম্ভব নয়। অথচ এখনও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য এবং উপ-উপাচার্য নিয়োগ দেওয়ার কোনও প্রক্রিয়া পর্যন্ত আমরা লক্ষ করছি না। কিন্তু আমি মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে খুলে দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।
যেসব শিক্ষার্থী এই আন্দোলন করেছে তার নেতৃস্থানীয় বেশিরভাগ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ইতোমধ্যে প্রায় দেড়-দুই মাস তাদের শিক্ষা কার্যক্রম পিছিয়ে গেছে এবং সেটা দ্রæততম সময়ে পুষিয়ে দিতে হলে দ্রæততম সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দেওয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে হবে। শুধু সরকারের একটা প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দেওয়া সম্ভব নয়। যেহেতু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চালু করা অনেক আনুষঙ্গিক আইনগত ও পদ্ধতিগত বিষয়ের সঙ্গে জড়িত, সেহেতু জরুরি এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কীভাবে খোলা যায় এবং স্বাভাবিক অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক কাজকর্ম শুরু করা যায়, সেদিকে এখনই নজর দেওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। আশার কথা, ইতোমধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হয়েছেন প্রফেসর ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি নিজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। সুতরাং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কীভাবে অপারেট করে তা তিনি খুব ভালো করে জানেন। তিনি অত্যন্ত সজ্জন, মেধাবী, প্রাজ্ঞ এবং অভিজ্ঞ লোক। প্রফেসর ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা, তিনি যোগ্য লোকদের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং উপ-উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেবেন। শিক্ষার্থীদের রাষ্ট্র সংস্কারের দর্শন মাথায় রেখে যোগ্য, অভিজ্ঞ, অ্যাকাডেমিক এবং ভিশনারি কোনও সিনিয়র অধ্যাপককে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবকের দায়িত্ব দেবেন, যাতে আজকের যে নতুন বাংলাদেশ আমাদের শিক্ষার্থীরা হাজির করেছে, সেটি নির্মাণের লক্ষ্যে এসব উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য এবং অন্য পদধারীরা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতে পারে। আমি নিশ্চিত তিনি যোগ্য লোকদের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের চেয়ারে বসাবেন। এই কাজটা যেন দ্রæত হয় সেই প্রত্যাশা আমাদের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অপেক্ষা করছেন নতুন বাংলাদেশে নতুন দর্শনে, নতুন চিন্তায়, নতুন করে নতুন প্রজন্মকে নির্মাণ করতে নিজেদের উজাড় করে দেওয়ার জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে উঠবে সত্যিকারের মানবসম্পদ উন্নয়নের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই গড়ে তুলবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, যারা নির্মাণ করবে সুন্দর স্বপ্নের সোনালি ও সমৃদ্ধ আগামী।

লেখক: নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চ.বি.