নৈরাজ্যে জিম্মি পতেঙ্গা সৈকত

39

মনিরুল ইসলাম মুন্না

পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত এখন আর আগের রূপে নেই। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার সম্পদ এখন কতিপয় নেতা ও প্রভাবশালীদের দখলে। প্রতিটি দোকান, রাইড, হকার, ভাসমান দোকান দখল এবং ভাড়া দিচ্ছে একটি সিন্ডিকেট। তারা সৈকতের পাড়ে লাগানো গাছ কেটে এবং গাছের তলায় একের পর এক দোকান নির্মাণ করে যাচ্ছে। এমন সব নৈরাজ্যে জিম্মি হয়ে পড়েছে দেশের অন্যতম সৌন্দর্যের এই পর্যটন স্পটটি।
পুরো সৈকত এলাকায় ৭শ’ থেকে ৮শ’ দোকান হয়ে গেলেও নীরব বিচ ম্যানেজম্যান্ট কমিটি, পুলিশ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা সিডিএ। গতকাল শুক্রবার পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত এলাকায় গেলে স্থানীয় দোকানি, হকার ও রাইডারদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া যায়।
দুপুর তিনটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত এলাকায় অবস্থানকালে দেখা গেছে, পুরো পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত এলাকার দৈর্ঘ্য দুই কিলোমিটার। দূর-দূরান্তের পর্যটকরা আসেন সমুদ্রের দেখতে। কিন্তু সমুদ্রের আর দেখা হয় না। পতেঙ্গা সি-বিচ অংশ থেকে বে টার্মিনাল পর্যন্ত সমুদ্রে পার্কিং করে রাখা হয়েছে বাল্ক জাহাজ এবং লাইটারেজ জাহাজ। আর সমুদ্রের পাড়ে সৈকত দখল করে আট শতাধিক দোকান ও রাইড নিয়ে বাণিজ্য করছে একটি সিন্ডিকেট।
দোকানিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, গাড়ি ও মোটর সাইকেল পার্কিং, বিচ বাইক চালক, ঘোড়ার রাইডার, ক্যামেরাম্যান, স্থানীয় দোকানি থেকে চাঁদা আদায় এবং স্পিডবোট থেকে চাঁদা আদায় করেন সিন্ডিকেটের সদস্যরা। মাসে এখান থেকে চাঁদা ওঠে ৫০ লাখেরও বেশি।
মুমিনুল ইসলাম নামে এক পর্যটক বলেন, ‘জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, ভোক্তা অধিকার, নিরাপদ খাদ্য ও স্যানিটারি কর্মকর্তারা আজ কোথায়? কি সুন্দর বিচ ছিল, এখন কি হয়ে গেলো। অবৈধ দোকানদার আর গলাকাটা বাণিজ্যকারীদের এক-দুইজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলে, আজ এমন অবস্থা দেখতে হতো না।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা সমুদ্র সৈকত এটি। দেশের দূর-দূরান্ত থেকে একটুখানি প্রশান্তির খোঁজে পর্যটকরা সৈকতপাড়ে আসলেও সৌন্দর্যের বিপরীতে রয়েছে নোংরা পরিবেশ, অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা। এছাড়া স্থানীয় দোকানি ও ব্যবসায়ীদের গলাকাটা বাণিজ্যে অসহায় তারা।
পতেঙ্গা সি বিচ দোকান মালিক সমিতির নেতৃত্বে থাকা ওয়াহিদুল আলম বলেন, ‘আমি এবং আমার কমিটি আজ অসহায়। অথচ আমাদের পরিচয়পত্র থেকে শুরু করে যাবতীয় সব ডকুমেন্টস রয়েছে। থানা, ট্যুরিস্ট ও কমিউনিটি পুলিশ সবাই এখানে দায়সারা। এখানে পাবলিকের কথা কি বলবো, পুলিশও দোকান দিয়ে বসেছে। ট্যুরিস্ট পুলিশের পরিচালিত দুটি দোকান ছাড়াও সরকারি সংস্থার কয়েকটি ভ্রাম্যমাণ দোকানও আছে এখানে। আমাকে একটা গ্রæপের লিডার বানিয়ে আমাকেও তারা চাঁদাবাজ বানিয়ে দিয়েছে। এখানে সবকিছুর নেতৃত্বে রয়েছে মাসুদ করিম। তাকে টাকার বিনিময়ে থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের কমিটির নেতা বানানো হয়েছে। সব সি বিচের টাকা। আপনি দেখেন- এখানে নাগরদোলা ছিল একটা, এখন আটটা। সি বিচের সবকিছু নুর মোহাম্মদ ও তার ছেলে মাসুদের হাতে জিম্মি।
জানা গেছে, পতেঙ্গা সৈকতে গড়ে ওঠা প্রায় আট শতাধিক স্থাপনার প্রতিটি থেকে প্রাথমিকভাবে এককালীন চাঁদা নেয় স্থানীয় একটি সিন্ডিকেট। প্রতিটি দোকান বা স্থাপনা থেকে এ চাঁদার পরিমাণ দাঁড়ায় দোকানভেদে ১০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এ হিসেবে এককালীন চাঁদা তোলার পরিমাণ কোটি টাকারও বেশি। এছাড়া প্রতিটি স্থাপনা থেকে দৈনিক ১০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা তোলা হয়। এ হিসাবে মাসে চাঁদা ওঠে ৩০ লাখ টাকার মত। চাঁদার এই টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা হয়।
পরিচয় গোপন রেখে কয়েকজন দোকানির সাথে কথা বলেন প্রতিবেদক। তারা জানান, প্রত্যেক দোকানদার অসহায়। কারণ তাদের নিজস্ব একটা পরিবার আছে। ধরুন, সৈকত এলাকায় দৈনিক এক হাজার টাকা বিক্রি হলে ২০০ টাকা চাঁদা দিয়ে দিই। কিছু দোকানে তা আরও বেশি। যা আয় হয় তার কিছু টাকা বাড়ি নিতে পারি, বাকি সব চাঁদাবাজদের দিয়ে দিতে হয়। একদিন টাকা না দিলে নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করেন ওই সিন্ডিকেট। এখানে কে কার বিরুদ্ধে বলবে? সবাই তো একই ঘরানার। থানা পুলিশকে বিচার দিলেও কোন কাজ হয় না। কারণ থানা পুলিশের দায়িত্বে থাকা এসআই কিরন ভাসমান দোকান ও হকারদের কাছ থেকে দৈনিক ৩০০ টাকা করে নেন। ট্যুরিস্ট পুলিশ দোলনা, চরকা, ট্রেন রাইডসহ প্রতিটি দোকান থেকে ১০০ টাকা করে তোলেন। সুতরাং, চাঁদা না দিয়ে দোকান করতে পারে না কেউ।
কথা হয় পতেঙ্গা থানাধীন সি বিচের দায়িত্বে থাকা এসআই কিরনের সাথে। তিনি পূর্বদেশকে বলেন, ‘এখানে জেলা প্রশাসন, সিডিএ এবং বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি কাজ করে। ট্যুরিস্ট পুলিশও আছে। আমরা দোকান ওঠাই, বসাই না। আমি মাত্র এক সপ্তাহ আগে যোগদান করেছি। আমি কারও থেকে টাকা নিই না। আপনি যা বলছেন, তার কোনো সত্যতা নেই।
তথ্য নিয়ে জানা গেছে, সৈকত এলাকায় দোকানিরাও একদিকে অসহায়। প্রভাবশালী নেতাদের কাছ থেকে দৈনিক ভিত্তিতে দোকান ভাড়া নিতে হয়। যা দোকানভেদে দৈনিক ৮০০ থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত দেয়া লাগে। মাসে ২৪ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত। যা আয় হয়, তার একটা অংশ দিয়ে দিতে হয় প্রভাবশালী সিন্ডিকেটকে। আর সেই সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিচ্ছে পতেঙ্গা থানা স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা মাসুদ করিম নামে এক নেতা। তিনি ‘পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত হকার ক্যামেরাম্যান শ্রমজীবী সমবায় লিমিটেড’ সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদকও। এ কারণে সি বিচ এলাকায় দোকানভেদে দিনে ১০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত তোলেন। প্রতিবাদ করলে দোকান উচ্ছেদ, ভয়-ভীতি, মামলা দিয়ে জেল খাটানোর ভয় দেখান দোকানিদের। এভাবে পুরো এলাকার সকল দোকানিকে জিম্মি করে রেখেছে বলে অভিযোগ উঠে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাসুদের বিরুদ্ধে পতেঙ্গা থানায় ২০১৫ সালের একটি চাঁদাবাজির মামলা রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, পতেঙ্গা সৈকত ঘিরে দোকান বাণিজ্যের পাশাপাশি তিনি টানেল রোডে ওই সমিতির ব্যানারে বানিয়েছেন মাইক্রোবাস স্ট্যান্ড। যেখান থেকে দৈনিক মাইক্রোবাস প্রতি ১০০ টাকা চাঁদা তোলা হয়। পতেঙ্গা সৈকতের মূল পয়েন্ট থেকে বালুচরের দিকে নামতে ওয়াকওয়েতে বসানো হয়েছে নৌকা, দোলনাসহ ৮ থেকে ১০টি রাইড। যেখান থেকে দৈনিক ৩০০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়। এসবের নিয়ন্ত্রণেও রয়েছে মাসুদ করিম। এমন অভিযোগও মিলেছে।
তবে এসবের বিষয়ে অস্বীকার করে মাসুদ করিম ক্ষেপে গিয়ে পূর্বদেশকে বলেন ‘সব দোকানি যদি একই কথা বলে, আপনার কথা মতে, তা সত্য হবেই। আমি যদি পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণ করি, তাহলে থানা পুলিশ কী করে? পতেঙ্গা তো র‌্যাবের অফিসের কাছেই, তারা আমার নামে থানায় বা র‌্যাবে অভিযোগ দেয় না কেনো? আসলে যারা চাঁদাবাজি করতো, তাদেরকে আমি এখান থেকে বিতাড়িত করেছি। সেজন্য আমার নামে এসব কথা ছড়াচ্ছে। কোন দোকানি আমার বিরুদ্ধে বলেছে, আমাকে দেখিয়ে দিন। দেখি, আমার সামনে বলে কি না।’
প্রভাবশালী নেতাদের নাম ভাঙিয়ে দোকান নির্মাণ কেন করছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি কারও প্রভাব খাটাই না। যে যার যার মত দোকান বসিয়েছে। এখানে আমার করার কী, আমার সংগঠন আছে, সমিতি আছে। সেগুলো পরিচালনার জন্য সামান্য টাকা তুলি। কিন্তু অতিরিক্ত টাকা তোলার বিষয়ে যা বলা হচ্ছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। আর কেউ যদি বলে আমি দৈনিক ১০০-২০০ টাকা তুলি। তাহলে প্রমাণ দিতে বলেন।’
স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, পুলিশ যেখানে সমুদ্র সৈকত রক্ষার কাজ করবেন, সেখানে নিজেরা দোকান দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে যাচ্ছেন। তাহলে অন্য দোকানিদের উচ্ছেদ করবেন কীভাবে?
এ বিষয়ে পতেঙ্গা সাব জোন ট্যুরিস্ট পুলিশের পরিদর্শক (ওসি) ই¯্রাফিল মজুমদার বলেন, ‘এখানে পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। অবৈধ দোকানপাট উচ্ছেদ আমি করতে পারি না। এটার জন্য বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি ও সিডিএ আছে। এছাড়া আমি যোগদান করার পর এখানের প্রতিটি দোকানে লিফলেট দিয়েছি। কেউ চাঁদা চাইতে আসলেই যেন আমাকে জানায়। কিন্তু এখনও কেউ চাঁদাবাজির বিষয়ে জানায়নি। পাশাপাশি এসবের সাথে আমাদের সদস্যদের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। কেউ যদি বলে থাকে, তাহলে সেটা আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছু নয়। আর আমাদের যে দুইটি দোকানের কথা বলছেন, তা সত্য। এসব দোকানের টাকা আমাদের কল্যাণ ফান্ডে চলে যায়। এগুলো আমি আসার পূর্বে স্যারেরা বসিয়েছেন। আমি এ সম্পর্কে জানি না।’
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) বন্দর বিভাগের উপ-কমিশনার শাকিলা সোলতানা বলেন, ‘পতেঙ্গা সৈকতে কোন দোকানই বৈধ নয়। সব দোকানই অবৈধ। আমি আসলে তাদেরকে বলতে বলতে বিরক্ত। এরা পুরো বিচ এলাকার পরিবেশ একেবারেই নষ্ট করে ফেলেছে। ওয়াকওয়েতে হাঁটার জায়গা পর্যন্ত নেই। দুই পাশেই দোকান করে রেখেছে। আমি এটা নিয়ে খুব বিরক্ত। ওখানে মাসুদের দৌরাত্মের কথা আমি জেনেছি। সে কার ক্ষমতা নিয়ে এসব করছে জানি না। আমাদের সদস্যদের বিরুদ্ধেও কয়েক দফায় অভিযোগ দিয়েছে সে। আমি মনে করি পুরো সৈকত এলাকা উচ্ছেদ করা ছাড়া দ্বিতীয় কোন উপায় নেই। আমি সিডিএ’কে বেশ কয়েকবার জানিয়েছি। তারা করবে করবে বলে কালক্ষেপন করছে। আর সৈকত এলাকায় যদি আমাদের (সিএমপি) কোন সদস্য জড়িত থাকে, তবে তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পতেঙ্গা সৈকতের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘আমরা গত এক বছর পূর্বেও একটা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করেছিলাম। এরই মধ্যে টানেল এলাকার ১২০-১৩০টা দোকানকে উচ্ছেদ করে পূণর্বাসনের কথা দিয়েছি। কিন্তু এখানে ৭০০-৮০০ দোকান বসেছে বলে জানতে পেরেছি। সুতরাং, সব অবৈধ দোকানকে উচ্ছেদ করে পূর্বের অবস্থায় ফিরে আনবো। সৌন্দর্যবর্ধনের অংশ হিসেবে পর্যটকদের সুবিধার জন্য এখানে আমরা দুইটি পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করছি।
তিনি আরও বলেন, ‘সমুদ্র সৈকত এলাকার জন্য অপারেটর নিয়োগ দেওয়া হবে। যাতে সি বিচের সৌন্দর্য রক্ষা পায়। পরবর্তীতে কোন স্থাপনা করা হলে তাৎক্ষণিক আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তবে বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান পূর্বদেশকে বলেন, ‘সি বিচ এলাকায় ইদানিং অতিরিক্ত দোকান নির্মিত হওয়ার ফলে যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে, তা আমি জেনেছি। পরবর্তী সপ্তাহে আমি বিচ এলাকার দুই কমিটির সদস্যদের ডেকেছি। তাদেরকে আমরা নিজস্ব ইউনিফর্ম, পরিচয়পত্র দিয়ে একটা শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসবো। বাকিদের মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে উচ্ছেদ করে দেওয়া হবে। এরপর সেখানে প্রতিটি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিবো, যাতে নৈরাজ্য বা গলাকাটা বাণিজ্য না হয়। আমরা পতেঙ্গা বিচটাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব সহকারে দেখছি। এখানে কোন চাঁদাবাজি, দখল বাণিজ্য, প্রভাব বিস্তার ইত্যাদি করতে দেওয়া হবে না।’