নিরাপদ সড়কের স্বপ্ন আর কতকাল দেখতে হবে ?

3

আজহার মাহমুদ

নিরাপদ সড়কের জন্য আন্দোলন, ধর্মঘট, মিছিল, সমাবেশ কত কিছুই না হলো। ছাত্রদের আন্দোলন থেকে শুরু করে দেশে নানান কান্ড ঘটে গেলো ২০১৮ সালে। যার মধ্যে সাড়াজাগানো বিষয় নিরাপদ সড়কের জন্য ছাত্রদের আন্দোলন। এরপর আরও ৫ বছর কেটে গেলো। কিন্তু সড়কে মৃত্যুর মিছিল আছে সেই আগের মতোই। এতোকিছুর পরেও আজও আমরা পাইনি আমাদের নিরাপদ সড়ক। সড়কে মৃত্যুর মিছিল সেই আগের মতোই আছে। বলা যায় দিনে দিনে বাড়ছে। কখনও গাড়ির অসুস্থ প্রতিযোগিতা, কখনও হেলপার, ড্রাইভারদের ইচ্ছেকৃত হত্যা কোনো না কোনো ভাবেই চলছে সড়কে মৃত্যুর মিছিল।
অথচ জাতিসংঘের কাছে বাংলাদেশ অঙ্গীকার করেছিল ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে কমিয়ে আনবে। সেই অঙ্গীকারের সময়সীমা বাড়িয়ে ২০৩০ সাল করা হলেও বাস্তবে আমরা উল্টো যাত্রাটাই দেখছি। সড়কে দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর লেখ প্রতিবছরই ঊর্ধ্বমুখী।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সড়ক দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের প্রতিবেদনে বলা হয়, এবারের ঈদযাত্রায় সারা দেশে দুর্ঘটনায় ৪৩৮ জন প্রাণ হারিয়েছে। এর মধ্যে দেশের সড়ক-মহাসড়কে ৩৯৯টি দুর্ঘটনায় ৪০৭ জন নিহত ও ১ হাজার ৩৯৮ জন আহত হয়েছে। একই সময়ে রেলপথে ১৮টি দুর্ঘটনায় ২৪ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ২১ জন। এ ছাড়া নৌপথে দুটি দুর্ঘটনায় সাতজন নিহত ও পাঁচজন আহত হয়েছে। সড়ক, রেল ও নৌপথে মোট ৪১৯টি দুর্ঘটনায় ৪৩৮ জন নিহত ও ১ হাজার ৪২৪ জন আহত হয়েছে।
আমি পরিসংখ্যান নিয়ে টানাটানি করবো না। কারণ পরিসংখ্যান ঘাটলে হতাশা আর কষ্ট ছাড়া কিছুই প্রাপ্তি নেই। আমি শুধু বলতে চাই, সড়কের প্রাণহানী কমিয়ে আনার কি কোনো উপায় নাই? নিরাপদ সড়কের জন্য আমাদের দেশে সংগঠনেরও অভাব নেই। কিন্তু কেউ কাজের কাজ করছে বলে মনে হয় না। সকলেই লোক দেখানো কাজে মেতে উঠে। আর বাকি সময় কেই যেন কিছু জানেই না। আর প্রতিদিন সড়কে ঝওে যাচ্ছে তাজা তাজা প্রাণ। কেউ মা, কেউ বাবা, আবার কেউ হারাচ্ছেন সন্তান। কেউ কেউ পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। শত-শত পরিবার হয়ে যাচ্ছে অসহায়।
প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, গত ১৬ এপ্রিল বাস ও ছোট ট্রাকের সংঘর্ষে ১৫ জন নিহত হন। দুর্ঘটনার পর বেরিয়ে আসে অবৈধভাবে ট্রাকটিতে যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছিল আর বাসটির কোনো ফিটনেস সনদ ছিল না। এই যে অনিয়ম আর অনিয়ম চলছে এটার উত্তর কে দিবে?
সড়কে ফিটনেসবিহীন যান চলাচল করছে কি না, সেটা দেখার দায়িত্ব বিআরটিএর। তাদের তথ্য বলছে, চলতি বছরের ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় ৬ লাখ ১৭ হাজার যানবাহন ফিটনেস সনদ নেয়নি। কারণ সনদ ছাড়াই তারা সড়কে দেদারসে চলছে। যে সড়কের জন্য ছাত্ররা রাস্তায় নেমেছে, যে সড়কের জন্য স্বজনদের হৃদয় পুড়েছে, যে সড়কের জন্য হাজার হাজার পরিবার ধ্বংস হয়েছে। বর্তমান সরকার যদি এই বিষয়টির দিকে সুনজর না দেয় তাহলে সড়কে মৃত্যুর মিছিল কখনোই থামবে না।
আমাদের আগে চিন্তা করতে হবে কোন কোন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনা বেশী হয় এবং প্রাণহানী হয়। এবং কেন দুর্ঘটনা সৃষ্টি হয়। আমরা যদি সমস্যাটা বের করতে পারি তবে সমাধান কেন বের করতে পারবো না। এছাড়াও সড়ক-মহাসড়ককে ফিটনেসবিহীন গাড়ি, লাইসেন্সবিহীন চালকের হাতে সঁপে দিয়ে কোনোভাবেই দুর্ঘটনা কমানো যাবে না।
বর্তমান সরকারের সাফল্য এবং উন্নয়ন অস্বীকার করার মতো দুঃসাহস কারো নেই। তবে এই সেক্টরের উন্নয়নটা এখনো দৃশ্যমান হয়নি দেশের মানুষের কাছে। আমি নিরাপত্তার উন্নয়নের কথা বলছি। অবকাঠামোগত উন্নয়ন অনেক হয়েছে, এবার প্রয়োজন জীবনের উন্নয়ন।
আমরা এই সেক্টরের কাজ দেখি শুধুমাত্র লোক দেখানো। আসলে এই সেক্টরে চলছে দুর্নীতির মহা উৎসব। এ সেক্টরের প্রধান বাণিজ্য লাইসেন্স। যত বেশি টাকা, তত আগে লাইসেন্স। সে গাড়ি চালাতে জানুক আর না জানুক। টাকা ঢাললে নাকি লাইসেন্স ২ মিনিটের বিষয়। এমন যদি হয়, তবে সড়কের মৃত্যু অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উচিত যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই সেক্টরের প্রতি নজর দিয়ে দেশ এবং দেশের মানুষকে রক্ষা করুন। সড়কে মৃত্যু প্রতিরোধ করার জন্য সরকারের বেতন ভুক্ত অনেক কর্মকর্তা রয়েছে। যারা এই বিষয় নিয়ে কাজ করার কথা। অথচ তারা সরকার থেকে জনগণের সেবা করার জন্য পারিশ্রমিক নিয়ে জনগণকে বুড়ো আঙ্গুল দেখায়। সড়কে রোজ মৃত্যু হচ্ছে। অথচ এই সেক্টরের কারো কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেই। আইন থাকলেও কার্যকর হয় না সেই আইন। কারণ আইনেও এখন চলছে অংকের হিসাব। তাই সুশাসন এবং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত করলে সবদিকেই জনগণের উন্নয়ন হবে। আর জনগণের উন্নয়ন মানেই দেশের উন্নয়ন। বিচারের আওতায় আনতে হবে সরকারি বেসরকারি সকল কর্মকর্তাদের। যারা পরিবহন সেক্টওে অনিয়ম এবং দুর্নীতি করছে। এ বিষয়ে সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবাইদুল কাদেরের আরও বেশি নজর দিতে হবে। কারণ তিনি আবারও এই সেক্টরের দায়িত্ব নিয়েছেন। তাই তার কাছে দেশের মানুষের প্রত্যাশা এখন একটাই, সেটা নিরাপদ সড়ক।
সর্বশেষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট আর্জি, দেশের উন্নয়ন করছেন দেশের মানুষের জন্য। কিন্তু দেশের মানুষ যদি বেঁচে না থাকে তবে দেশের উন্নয়ন করাটা বৃথা হয়ে যাবে। তাই শ্রদ্ধার সাথে বলছি, আগে দেশের মানুষ বাঁচান, তারপর দেশ সাজান। এটাই হোক ২০১৯ সালের কর্মসূচি। আমার বিশ্বাস বর্তমান সরকার এই সেক্টরকেও সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে পারবে। সেই সুন্দরের অপেক্ষায় রইলাম আমি এবং আমার দেশের মানুষ।

লেখক : প্রাবন্ধিক