নিরসন প্রকল্পের সুফল আদৌ মিলবে?

4

চট্টগ্রামবাসীর দুঃখ যেন পিছু ছাড়ছে না। দেশের প্রধান বন্দর ও বাণিজ্যিক নগরীর চট্টগ্রামের মানুষ জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তির স্বপ্ন যেন অধরায় থেকে যাবে! জলাবদ্ধতা নিরসনে দীর্ঘ প্রায় ৩০ বছর ধরে ছোট বড় বহু প্রকল্পের কাজ হয়েছে, হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে, কিন্তু জলাবদ্ধতার দুঃখ থেকে মুক্তি মিলেনি। সম্প্রতি আষাঢ়ের ভারি বৃষ্টিতে সয়লাব হয়েছে নগরীর নি¤œাঞ্চল। মাত্র ৬৯ মিলিমিটার বৃষ্টিতে নগরীর মুরাদপুর, ২নং গেইট, চকবাজার, কাপাসগোলা, আগ্রাবাদ সিডিএ এলাকা, কমার্স কলেজ রোড, বাকলিয়ার বেশ কয়েকটি এলাকা পানিতে ডুবে যায়। বৃষ্টি হলেই এসব এলাকায় পানি ওঠবেই-এ যেন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। অথচ বৃষ্টি আর জোয়ারের পানি থেকে মুক্তির জন্য দীর্ঘ ৮ বছর ধরে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকার চারটি বড় প্রকল্পের কাজ চলছে। বেশির ভাগ প্রকল্পের কাজই শেষ পর্যায়ে। কিন্তু জলাবদ্ধতা নিরসনের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। একটি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সবেমাত্র বর্ষা মৌসুম শুরু, এরই মধ্যে আতঙ্ক ভর করেছে নগরবাসীর মধ্যে। আগের মতোই অল্প বৃষ্টিতেই তলিয়ে যাচ্ছে নগরী। প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছর ও এ বছর অপেক্ষাকৃত কম জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে, যা প্রকল্পের সুফল। পুরো প্রকল্প শেষ হলে সুফল মিলবে। নগরবাসীর কষ্ট লাঘব হবে। তবে গত এপ্রিলের শেষে এবং মে মাসে বৈশাখি ঝড়-বৃষ্টিতে এবং সম্প্রতি মৌসুমি বৃষ্টিতে যেভাবে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে, তাতে আদৌ জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কোন সুফল মিলবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়ে যাবে। নগর পরিকল্পনাবিদরা এ জন্য প্রকল্পের দুর্বলতাকে দায়ি করে আসছেন, এখনও তারা ডিজাইনে ত্রুটির কারণে সুফল না পাওয়ার সম্ভাবনার কথা বলে যাচ্ছেন। আমরা জানি, চার প্রকল্পের দুটি বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক) এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) ও পানি উন্নয়ন বোর্ড একটি করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। জলাবদ্ধতা নিরসনে ২০১৭ সালে ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘খাল পুনর্খনন, স¤প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের প্রাথমিক কাজ শুরু করে চউক। সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে। ২০২০ সালের জুনে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দফায় দফায় ব্যয় ও সময় বাড়ানোর কারণে এখনো শেষ হয়নি। প্রকল্পের মেয়াদ তিন দফা বাড়িয়ে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত নির্ধারণ হয়। প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা। প্রকল্পের অধীনে ৩৬টি খাল সংস্কার, ড্রেনেজ নির্মাণ, গার্ডার ব্রিজ, কালভার্ট এবং বন্যার পানি সংরক্ষণের জন্য জলাধার তৈরি করা হচ্ছে। প্রকল্প পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফেরদৌস আহমেদ স¤প্রতি এক সভায় বলেন, ‘শেষের দিকে এসে বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। খাল-নালা উদ্ধার করতে গিয়ে অনেক অবৈধ ভবন ভাঙতে হচ্ছে। সবকিছুর মধ্যে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা রয়েছে। কোনো কোনো বিষয় সমাধান করতে সময় নিতে হচ্ছে। জটিলতা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বর্ধিত মেয়াদের মধ্যে (২০২৬ সালের জুন) প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হবে বলে আশা করছি।
চউকের আরেক প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে ২ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ। এছাড়া ১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা ব্যয়ে আরেকটি প্রকল্প (বাঁধ নির্মাণ) বাস্তবায়ন করছে পাউবো। সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে নেওয়া এ প্রকল্পে ২৩টি রেগুলেটর নির্মাণ, রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণসহ বেশকিছু কাজ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ৪টি রেগুলেটর নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। এ বছর ১০টি নির্মাণ শেষ হবে। চতুর্থ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে চসিক। ২৮৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ব্যয়ে নগরীর বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খননের এ প্রকল্পটি ২০১৪ সালে হতে নেওয়া হয়। ১০ বছর আগে এই প্রকল্পটি যখন নেওয়া হয় তখন মেয়র ছিলেন বিএনপি থেকে নির্বাচিত এম. মনজুর আলম। এরপর আ জ ম নাছির উদ্দিনের সময়ে দফায় দফায় মেয়াদ বাড়লেও কাজ শেষ হয়নি। এরই মধ্যে এই প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে ১ হাজার ৩৬২ কোটি টাকা হয়েছে। চলতি জুনে মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও প্রকল্পের অগ্রগতি ৬০ শতাংশের মতো। আবারও মেয়াদ বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে বলে জানা গেছে। তবে এসব প্রকল্পের ডিজাইনে ত্রুটি থাকায় সুফল মিলছে না বলে মনে করছেন নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী সুভাস বড়–য়া। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘প্রকল্প অনেক হচ্ছে। কিন্তু সুফল তো কেউ পাচ্ছে না। প্রকল্প যারা করছে তাদের সেই অভিজ্ঞতা কতটুকু আছে এবং যারা প্ল্যানিং ও ডিজাইন করছে, ফিজিবিলিটি স্টাডি করেছে, এই বিষয়গুলো যদি সঠিক না হয়, তাহলে তো শুধু টাকা খরচ হবে। জলাবদ্ধতা নিরসন হবে না। এ পর্যন্ত জনগণ এটা দেখে আসছে।’ আশার কতা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে চউক ও চসিকের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব কিছুটা ঘুচিয়ে আসছে। সম্প্রতি দুই সংস্থা জলাবদ্ধতা নিরসনে একসাথে কাজ করার কথা ঘোষণা করেছেন। নগরবাসী চসিক ও চউকের উপর আস্থা রেখে আসছে। তারা এর প্রতিদান দেবে-এমনটি আশা নগরবাসীর।