নরে নাগে হয় না বাস

3

সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক ও গণমাধ্যমে রাসেল ভাইপার সবচেয়ে বেশি আলোচিত গুজব। বেনজির, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, ছাগল মতিয়ুর কেলেংকারি ইত্যাদি ছাপিয়ে হুলুস্থুল কাÐে রাসেল ভাইপার। এই হুজুগের বিষিষিকায় সারাদেশে অজগর, ঢোড়া, মেটে, গুইসাপসহ মারা পড়ছে অসংখ্য নির্বিষ সাপের গুষ্ঠি। গুজবের ফলে সাপ মেরে প্রকৃতির বা বাস্তুতন্ত্রের যে ক্ষতি হলো তার দায় কে নেবে ? বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট বলছে, তাদের কাছে প্রতি ঘণ্টায় সাপ বিষয়ক ৫০টি কল আসভে তাঁরা বলছেন, যে সকল সাপ মারা পড়ছে তার ৮০ শতাংশই হলো নির্বিষ সাপ। দেশে সাপ নিয়ে উদ্বেগ জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। হায়রে হুজুগে বাঙালি। কান নিয়ে গেল চিলে, একবারও কানে হাত দিলো না। কোন যথাস্থানে আছে কিনা ? এই হুজুগের মহাডামাডোলে কর্পোরেট হাউস, কিম্বা স্বার্থান্বেষী ওষুধ বিপনন কোম্পানির স্বার্থ কতটুকু হাসিল হয়েছে বলা দুস্কর। তবে বেনজির, ছাগল মতিউর এবং রাসেল গুজবে দেশ যখন মাতোয়ারা। তখন একটি গোষ্ঠিতাদের স্বার্থ বাস্তবায়নে এক ধাপ এগিয়ে গেল। বাংলাদেশের বুকচিরে ভারতীয় ট্রেন চলাচলের চুক্তিও নির্বিঘেœ সম্পাদিত হলো। কিন্তু অভিন্ন নদী নিয়ে চুক্তি, তিস্তা পানি বন্টন কিম্বা ফারাক্কা চুক্তির বাস্তবায়ন লক্ষনীয় নয়। তবে দিল্লীতে ভারত-বাংলাদেশ ‘টেকসই ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে অভিন্ন দৃষ্টি ভঙ্গি নিয়ে ঢাকা-দিল্লী সমঝোতা স্মারক সম্পাদিত হল। আশার কথা বিশ্বস্থ ও বন্ধু প্রতীম উভয় দেশ এতে অন্যের সাথে মিলে মিশে উন্নয়নের পথে এগুবে। শংকার বিষয় হলো এ পর্যন্ত ভারতীয় অধিকাংশ প্রকল্প বা চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘ইউরোপীয় দেশগুলোতে কোন সীমান্ত নেই। আওয়ামী লীগ কখনো দেশ বিক্রি চুক্তি করে না’। তবে ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটা তারের বেড়া আছে।
সাপের কথা বলতে গিয়ে ‘ভুতের মুখে রাম নাম’ উচ্চারণ মানায় না। প্রাচীন বাংলার প্রবাদে আছে ‘নরে নাগে হয় না বাস ’। সহজ সরল ব্যাখ্যা হল মানুষ আর সাপ একসাথে বসবাস হয় না। আম জনতার মাঝে সর্পভীতি আজন্মের। এ নিয়ে উদ্ভব হয়েছে প্রবাদও পুরান কথা। জ্ঞান বিজ্ঞানে উন্নত মানুষের মনে সর্পভীতি আছে বলেই সামাজিক মাধ্যমে গুজবের মহাউৎসব। ইতিহাস বলছে রাসেল ভাইপার নামীয় সাপটি প্রাচীন কাল থেকে বঙ্গদেশে বহাল তবিয়তে ছিল। বাঙালিরা ভুলোমনো জাতি। ইতিহাস, ঐতিহ্য তাঁদের স্মরণে থাকে না। তাই তারা শত্রæমিত্র চিনতেও ভুল করে। আমাদের ‘চন্দ্রবোড়া’ সাপই হলো গুজবের রাসেলস ভাইপার। চন্দ্রবোড়া সাপ খুঁটি চাই গাইয়া ভাষায় ‘চ’ল পোড়া হাল’। হালের বাঙ্গালীরা চদ্রবোড়াকে যেমন ভুলে গেছে তেমনি চাটগাঁইরাও ভুলে গেছে চ’লপোড়া হাপকে। দুর্ভাগ্য এই যে, চাটগাঁইয়া এলিট, উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবারে এখন চাটগাঁইয়া ভাষার চল উঠে যাচ্ছে।
প্রাচীন প্রবাদ অনুযায়ী ‘নরে-নাগে হয় না বসবাস’। এর মূল কারণ সর্পভীতি। সনাতন ধর্মীরা সর্পভয় দূর করতে সর্বদেবী মনসার পূজা করে থাকেন। শ্রাবণ মাসে বাড়িতে বাড়িতে, মন্দিরে মনসার ঘট বসে পূজা হয়। নাগ পঞ্চমী ছাড়াও শ্রাবণের শেষ দিনে মহা সমারোহে হাজার হাজার পাঁঠা, হাঁস, পায়রা বলী দেয়া হয় মনসা দেবীকে তুষ্ট করার জন্য। নেপালে লক্ষ লক্ষ গরু, মহিষ, পাঁঠা বলী হয়। ভেলরে দেখেছি চাল কুমড়া বলী দিতে। তাই মানুষের মনে সর্পভীতি থাক বা না থাক রীতি অনুযায়ী সনাতন ধর্মে পুরো শ্রাবণ মাসজুড়ে সর্পহত্যা নিষিদ্ধ। শ্রাবণ মানে বর্ষাঋতু। বর্ষায় সর্প উপদ্রব বেশি। বর্ষা হচ্ছে সর্পগোষ্ঠির মিলনের কাল, প্রজননের ঋতু। এ সময় সর্পের উপদ্রব বা আনাগোনা বেশি। তারা প্রজননের জন্য নিরাপদ আশ্রয় খোঁজে। ঝোপঝাড় হাঁস-মুরগীর আড়াইল, ঘরের কোণে, খোপেখাপে তো এদের দেখা যাবেই।
রাসেল ভাইপার নিয়ে এতো গুজব, অভিযান, মাতামাতির কী আছে ? কই নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি, সীমাহীন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোন অভিযান তো লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এই গুজবের কারণে অবলা সাপেরগোষ্ঠি নিধনে নেমেছে হুজুগে বাঙালি। ওয়াইল্ড লাইফ মিশন সভাপতি জুলফিকার রাইহান সামাজিক মাধ্যমে ঘোষণা দিয়েছেন গুজব ছড়ালে আইনের আশ্রয় নিবেন। তিনি কী দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, ভূমিখোর ও অর্থপ্রচারকারীদের বিরুদ্ধে কোন এ্যাকশনে গিয়েছেন ? যারা এই সমাজকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। মনে রাখতে হবে ‘খল মানুষ সর্পের ন্যায়’। সমাজে খল মানুষেরা গিজগিজ করছে। খল মানুষেরাই সমাজে উদ্ভট গুজব রাটায়।
দেশের ঝোপ-ঝাড়, বন বনানী, পাহাড় টিলা, নদী-নালা, খাল বিল জলাশয়সহ প্রাকৃতিক অনুষঙ্গ তথা বাস্তুসংস্থান বা ইকোসিস্টেমে জীববৈচিত্র্য বেঁচে থাকার জন্য এদের গুরুত্ব অপরিসীম। খাদ্য শৃঙ্খলে একটির ঘাটতি হলে প্রকৃতি স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার প্রতিশোধ নেয়। এটা শুধু মাত্র সময়ের ব্যাপার। মানব ইতিহাসে এর নজির ভুরিভুরি। উদাহারণত, বলা যায় প্লেগ, ম্যালেরিয়া, বার্ডফ্লু, অ্যানথ্রাস, এইডস, করোনা ভাইরাস প্রভৃতি। বর্তমানে জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে মানুষের জীবনাচারণ ও অনেক উন্নত হয়েছে। উন্নতির সাথে সাথে ইটপাথরের জঞ্জাল, যন্ত্রের আস্ফালনও বেড়ে গেছে। শব্দ দূষণ, আলো দূষণ, খাদ্য দূষণ বেড়ে যাওয়ায় বন্যপ্রাণী ও কীটপতঙ্গের বেঁচে থাকার সমস্যা হচ্ছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিঘœ হচ্ছে। এরা এখন অবাঞ্চিত। অথচ পৃথিবী ও বাস্তুতন্ত্রের জন্য এরা বেঁচে থাকা জরুরি। রাসেল ভাইপার সাপের বংশবৃদ্ধি ও উপদ্রব হ্রাসের জন্য যাদের বেঁচে থাকার কথা তাদের অর্থাৎ গুইসাপ, বেজি, বনবিড়াল, মেছোবাঘ, ঈগল, চিল, পেঁচাসহ সর্পভুত পাখি, শিয়াল ভাল্লুক শঙ্খিনীসহ সর্পভুক সাপগুলোর জীবন আজ সংকটাপন্ন। এরা বেঁচে থাকলে ভাইপারের উপদ্রব কমে যেত। এই প্রাণীগুলো হারিয়ে যাওয়ার লাল তালিকায়। রাসেল ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া এই উপমহাদেশের সাপ। আগেও ছিল এদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতা। এদের দমন করার জন্য প্রাণীগুলোর বিলুপ্তিতে এদের উপদ্রব বেড়েছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করার প্রাণী ও উপসঙ্গ ধ্বংস করে বাঙালি বহাল তবিয়তে বাস করবে সে স্বপ্ন / আশা ভুল। বলা চলে আহম্মকের স্বর্গে বসবাস। অতএব এই পৃথিবীতে সকলকে বাস করার সুযোগ দিন। ফিরিয়ে আনুন অরণ্য।

লেখক : কবি, নিসর্গী ও ব্যাংক নির্বাহী (অব)