নব গঠিত রাষ্ট্র সংস্কারে করণীয়

4

জসিম উদ্দিন মনছুরি

সীমাহীন দুর্নীতি ও আত্তীকরণে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার নজির স্থাপন করে গেছে। রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টরে ঘুষ, দুর্নীতি, প্রভাব বিস্তারের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রকে প্রায় বিকল করে গেছেন। প্রতিরক্ষাসহ দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আজ্ঞাবহ দাসে পরিণত করে এক নায়কতন্ত্রে রূপ দিয়েছেন। জনগণের বাক স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে। প্রতিবাদ করলে তাকে জেল জুলুমের ভয় দেখিয়ে মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিগত ১৬ বছর আওয়ামী সরকারের আমলে প্রাণ খুলে হাসার মত অবস্থা ছিলো না। যেখানে সেখানে মৃত্যুর ভয়, বুলেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে সাধারণ নিরীহ মানুষদের দিন গুজরান করতে হয়েছে। উন্নয়নের নাম দিয়ে ক্ষমতাসীনরা নিজের আখের গুছিয়েছে। নতুন নতুন প্রকল্প সৃজন করে লোপাট করা হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ঋণের বোঝায় দেশকে অথৈ জলে ডুবিয়ে রেখে গেছেন সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী। বিরোধী মতকে দমন করার জন্য রাজাকার আখ্যা দিয়ে হরণ করা হয়েছে বাক স্বাধীনতা। কেড়ে নেয়া হয়েছে স্বাধীনভাবে চলাচলের অধিকার। রাজাকার টেগ দিয়ে সাধারণ মানুষকে দমিয়ে রাখার অপচেষ্টা করা হয়েছে। বলতে গেলে প্রহসনের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বারবার ক্ষমতায় এসে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছে আধিপত্যবাদী হাসিনা সরকার। ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের পতন হলে একের পর এক দুর্নীতির পাহাড় বের হয়ে আসতে থাকে। কথিত বন্ধু রাষ্ট্রের একচ্ছত্র আধিপত্যে শেখ হাসিনা সরকার আগ্রাসী মনোভাব নিতে থাকে। অধিকারের দাবিকে তারা পরাজিত শক্তির জঙ্গি তৎপরতা বলে চালিয়ে দিতে চেষ্টা করে। উপায়ান্তর না দেখে দাবি আদায়ে ছাত্র জনতা মরণ কামড় দিয়ে আন্দোলনে নামেন। ফলে আন্দোলন চরম রূপ ধারণ করে। আন্দোলনের তীব্রতায় শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালাতে বাধ্য হয়। শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে অবসান হয় তার দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের দমনপীড়নের নিষ্ঠুর ইতিহাসের। বিরোধী মতকে দমাবার জন্য নিষ্ঠুর বর্বরতম আয়না ঘর তার নিষ্ঠুরতার অন্যান্য নজির স্থাপন করেছে। যে আয়নাঘর পৃথিবীর কলঙ্কিত অধ্যায় হয়ে নিষ্ঠুরতার প্রতীক হিসাবে বিরাজমান থাকবে কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আয়নাঘর থেকে ফিরে এসে ভিকটিমরা নির্যাতনের লোমহর্ষক বর্ণনা দিতে থাকে। যা পৃথিবীব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। ঋণের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে দেশ অথৈ সাগরে ডুবুডুবু অবস্থা। রেখে গেছেন দেশের ইতিহাসে সর্বনিম্ন বৈদেশিক রিজার্ভ। অর্থ পাচারের কারণে কলঙ্কের মাত্রাটাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। পুলিশ বাহিনী নিষ্ঠুরভাবে ছাত্র জনতার উপর বেপরোয়া গুলি চালিয়ে জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলেন। পুলিশ বাহিনীর উপর জনগণের আস্থা হীনতায় জনরোসের কবলে পড়তে হয়েছে পুলিশ বাহিনীকে। অনেক পুলিশ সদস্য পলাতক থাকায় আইন-শৃঙ্খলা চরম তলানিতে নেমে গেছে। সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এরই সুযোগ গ্রহণ করে জনগণকে আতঙ্কিত করার লক্ষ্যে বিভিন্নভাবে চুরি ডাকাতি সহ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার পাঁয়তারা করছে। ট্রাফিক বাহিনী না থাকায় ছাত্ররা স্বেচ্ছায় ট্রাফিক কন্ট্রোলে নেমেছে। ভঙ্গুর দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করা ছাড়া নতুন সরকারের কাছে দ্বিতীয় কোনো বিকল্প নেই। জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা বিধানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নতুন করে ঢেলে সাজিয়ে সুশৃংখল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী গঠন করা সময়ের প্রত্যাশিত দাবি। রাষ্ট্রের সংস্কারে কতিপয় দাবি উপস্থাপন করা হলো-
১. অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঢেলে সাজাতে হবে।
২. দুর্নীতির মূলোৎপাটনের লক্ষ্যে ঘুষ চাঁদাবাজি কঠোরভাবে দমন করতে হবে।
৩. পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।
৪. বৈদেশিক রিজার্ভ বৃদ্ধিতে পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। প্রবাসীদেরকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে।
৫. দুর্নীতি রোধে দুর্নীতি দমন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করার অধিকার দিতে হবে।
৬. আইন-শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে। প্রয়োজনে অনুপস্থিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিবর্তে যোগ্য নাগরিকদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীতে নিয়োগ দিতে হবে।
৭. যোগাযোগ ব্যবস্থার চরম অবনতি রোধকল্পে দ্রুত সড়কগুলো সংস্কারের পদক্ষেপ নিতে হবে।
৮. রাষ্ট্রের সকল জনগণকে জনমত প্রকাশের অধিকার প্রদান করতে হবে।
৯. প্রয়োজনে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার সংবিধান সংশোধন করে জন আকাক্সক্ষার সংবিধান রচনা করবে।
১০. সর্বোপরি দেশের সকল জনগণকে নবগঠিত রাষ্ট্রের উন্নয়নে সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলে আমরা ফিরে পাব স্বপ্নের সোনার দেশ। যেখানে থাকবে না দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ঘুষ, জুলুম নির্যাতন মারামারি হানাহানি। সকল নাগরিকের সমান অধিকারে আইনের প্রতি সবাই শ্রদ্ধাশীল হবে। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। তাহলে অপরাধীরা কখনো ছাড় পাবে না। কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করে অপরাধীদের নির্মূল করতে হবে। উপযুক্ত দাবি বিবেচনায় আনলে আমরা হয়তো পেতে পারি স্বপ্নের সোনার সফল দেশ। সবাই মিলে আমরা নবগঠিত দেশকে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যাই।
লেখক: প্রাবন্ধিক