নবীন চিকিৎসকদের হতাশায় ভোগা : কারণ ও প্রতিকার

2

ডা. হাসান শহীদুল আলম

(প্রথম পর্ব)
নবীন চিকিৎসক কাহারা ?
সদ্য ইন্টার্নীশীপ সমাপ্ত চিকিৎসক,যারা বিসিএস পরীক্ষায় অবতীর্ন হবার অপেক্ষায় আছেন এবং কোন বেসরকারী হাসপাতালে অস্থায়ীভাবে মেডিকেল অফিসার হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন,অথবা কোন ফার্মেসীতে রোগী দেখার জন্য বসেছেন,অথবা বিসিএস পাশ করে উপজেলা মেডিকেল অফিসার হিসাবে নিয়োগ পেয়েছেন অথবা বিসিএস পাশ করে ননক্যাডার তালিকায় অপেক্ষমান থেকে সরকারী বা বেসরকারী হাসপাতালে অনারারী মেডিকেল অফিসার হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।
নবীন চিকিৎসকদের বর্তমান পরিস্থিতি : ক) সদ্য ইন্টার্নীশীপ শেষ করা চিকিৎসকগন বেকার হয়ে পড়েন। সদ্য ইন্টার্নীশীপ শেষ করা চিকিৎসকগন বছর দুয়েক বা তারও বেশী সময়ব্যাপী কর্ম সংস্থানের সুযোগ না পেয়ে আংশিক বা পূর্ন বেকার হিসাবে সময় ক্ষেপন করে থাকেন। কারন হচ্ছেÑ ১) নবীন চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতা কম থাকায় বেসরকারী হাসপাতালসমূহ নবীন চিকিৎসকদের দায়িত্বরত চিকিৎসক হিসাবে নিয়োগ দিতে আগ্রহী হয় না। যেহেতু সে জায়গায় পাঁচ-সাত বছরের অভিজ্ঞ চিকিৎসক পাওয়া যায়। আর যদি নিয়োগ দিতেই হয়, তবে সন্মানজনক বেতন দিতে চায় না। ২) একইভাবে ডায়াগনসটিক সেন্টার বা ওষুধের ফার্মেসীসমূহ নবীন চিকিৎসকদের চেম্বার করে দিতে আগ্রহী হয় না। যেহেতু রোগী তেমন আসে না বিধায় চেম্বারের ভাড়া আদায় করা বা চেম্বারের ব্যয়ভার সংকুলান করা সম্ভব হয় না। ৩) মেডিকের কলেজ হাসপাতালসমূহে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অনারারী চিকিৎসক হিসাবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেলেও বেতন-ভাতা প্রয়োজন অনুযায়ী না পাওয়ার কারণে নবীন চিকিৎসকদের পক্ষে অন্ন সংস্থান করাটাও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। ৪) নবীন চিকিৎসকদের কিছু সংখ্যক উপজেলা শহরের ডায়াগনসটিক সেন্টার বা ওষুধের ফার্মেসীতে দৈনিক কয়েক ঘন্টা করে সপ্তাহে দুই-তিনদিন অর্থাৎ সপ্তাহে ৯-১২ ঘন্টা রোগী দেখার সুযোগ করে থাকেন। সেখানেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং প্রবীন চিকিৎসকদের সংগে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে খুবই অল্প সংখ্যক রোগী দেখার সুযোগ পেয়ে থাকেন এবং অতি অল্প আয়ে তাদের পক্ষে খেয়ে পরে বাঁচাও দূঃসাধ্য হয়ে পড়ে।
নবীন চিকিৎসকদের কেন বেকার বা অর্ধবেকার বলা হচ্ছে ?
ক) বেকারত্ব কি ?
বাংলাদেশের শ্রমশক্তি সম্পর্কিত জরিপে ১৫ বছর বা তদূর্ধ বয়সের এমন ব্যক্তিকে বেকার বিবেচনা করা হয়েছে যে সক্রিয়ভাবে কাজের সন্ধান করা বা কাজের জন্য প্রস্তুত থাকা সত্তে¡ও তার যোগ্যতা অনুযায়ী প্রচলিত মজুরী হারে কর্মসংস্থান করতে ব্যর্থ হয়েছে। খ) আংশিক বেকারত্ব কি ? আংশিক বেকার বলতে ১৫ বছর বা তদূর্ধ বয়সের এমন ব্যক্তিকে বিবেচনা করা হয়েছে যাদের কর্মসংস্থান হওয়া সত্তে¡ও প্রয়োজনীয় কর্মঘন্টা অর্থাৎ সাপ্তাহিক ৩৫ ঘন্টা কাজে নিয়োজিত ছিলেন না। গ) নবীন চিকিৎসকদের বেকার বা আংশিক বেকার কেন বলা হচ্ছে ? যেহেতু তাঁরা সক্রিয়ভাবে কাজের সন্ধান করা বা কাজের জন্য প্রস্তুত থাকা সত্তে¡ও তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী প্রচলিত মজুরী হারে পেশাগত দায়িত্ব পালন করার সুযোগ পাচ্ছেন না। তাই তাঁরা বেকারের অন্তর্ভুক্ত। আর যেটুকু কাজের সুযোগ তারা তৈরী করেন সেটুকুর কর্মঘন্টা সাপ্তাহিক ৩৫ ঘন্টার চেয়েও কম হয় বিধায় তারা আংশিক বেকারের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হচ্ছেন ।
নবীন চিকিৎসকদের বেকারত্ব বা অর্ধবেকারত্ব এর কারনসমূহ ঃ
ক) সরকারের পরিকল্পনাহীনতা : স্বাস্থ্যজনশক্তিনীতি না থাকা অর্থাৎ কতোসংখ্যক চিকিৎসক প্রয়োজন এবং কতো সংখ্যক চিকিৎসক তৈরি করতে হবে সে সম্পর্কে সরকারের সুনির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনা নেই। প্রস্তাবিত স্বাস্থ্যনীতিতে স্বাস্থ্যজনশক্তি বা স্বাস্থ্যজনশক্তিনীতি বলে কোন শব্দ খুঁজে পাওয়া যায় না। খ) সরকারী খাতে অপর্যাপ্ত নিয়োগ : ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন দেশে সরকারী নানা ধরনের প্রতিষ্ঠানে সাড়ে ছয় হাজার রোগী প্রতি একজন করে চিকিৎসক কর্মরত রয়েছেন। সে হিসাবে বর্তমানে সরকারি নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসকের সংখ্যা ২৬১৫৩ জন। কিন্তু আড়াই হাজার জনগনের জন্য একজন চিকিৎসক হিসেব করলে বর্তমানে সরকারী নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসক থাকা উচিৎ ১৮ কোটি জনগনের জন্য প্রায় ৭২ হাজার জন। অর্থাৎ সরকারের উচিৎ আরও ৪৫৮৪৭ জন চিকিৎসককে এখনই নিয়োগ দেয়া।
বিশ্বব্যাংকের হিসাব মতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর ১.০১ শতাংশ হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত জনসংখ্যার জন্য সরকারকে প্রতি বছর চিকিৎসক নিয়োগ দিতে হবে বাড়তি ৬৮৬ জন। অর্থাৎ সরকার এখনই যদি আরও ৪৫৮৪৭ জন চিকিৎসক নিয়োগ দেয় এবং প্রতি বছর ৬৮৬ জন চিকিৎসককে নুতনভাবে নিয়োগ দেয় এবং শূন্য পদসমূহ পূরণ করা হয়, তবে চিকিৎসক পিছু ২৫০০ জনগনের হিসাবটা মিলবে। এতে পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে যে, সরকারি খাতে নিয়োগকৃত চিকিৎসকের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় মাত্র ৩৬ শতাংশ। এবারে অপর একটি পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করা যাক।
বাংলাদেশে চিকিৎসকের প্রয়োজন কতো দেখা যাক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সামপ্রতিক নির্দেশনা মতে, যে কোন দেশে প্রতি ১০০০-১৫০০ মানুষের জন্য একজন এমবিবিএস চিকিৎসক থাকা প্রয়োজন। সে হিসাবে যদি ১০০০ জনগনের জন্য একজন এমবিবিএস চিকিৎসক ধরা হয়, তবে ১৮ কোটি জনগনের জন্য ১ লাখ ৮০ হাজার চিকিৎসক প্রয়োজন।বিএমডিসি সূত্রে জানা গেছে দেশে বর্তমানে নিবন্ধিত চিকিৎসকের সংখ্যা ১২৫০০০ জন। সে হিসাবে বাংলাদেশে এ মূহুর্তে আরও (১৮০০০০-১২৫০০০) বা ৫৫০০০ জন চিকিৎসকের প্রয়োজন। আর যদি কর্মরত চিকিৎসকের সংখ্যা হিসাব করা হয় তবে বাংলাদেশে কর্মরত চিকিৎসকের সংখ্যা সরকারি বেসরকারী মিলিয়ে ৫০ হাজার এর বেশী হবে না। অর্থাৎ বাস্তবে আরও (১৮০০০০-৫০০০০) বা ১৩০০০০ জন কর্মরত চিকিৎসকের ঘাটতি রয়েছে। সে হিসাবে দেখা যাচ্ছে চিকিৎসকদের সরকারী নিয়োগ মাত্র ১৬ শতাংশ। আর সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে কর্মরত চিকিৎসক মাত্র ২৭ শতাংশ। এবারে আরও একটি পরিসংখ্যান দেখা যাক।
স্বাস্থ্যখাতে কতজন চিকিৎসকের পদ থাকা উচিৎ-
প্রাইমারী স্বাস্থ্যখাত : ১) ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র : ৪৫৫৪টি। রোগীদের প্রতিদিনের উপস্থিতি ৫০ থেকে ১০০ জন। গড়ে ৮০ জন। সারাদেশে মোট সংখ্যা ৩৬৩৩২০ জন। ত্রিশজন রোগীর জন্য একজন এমবিবিএস হিসাবে মোট চিকিৎসক প্রযোজন ১২১১০ জন। ২) কম্যুনিটি ক্লিনিক : ১৩৮৬১টি। রোগীদের প্রতিদিনের উপস্থিতি ১০০ থেকে ২০০ জন। গড়ে ১৫০ জন। সারাদেশে মোট রোগীর সংখ্যা ২০৭৯১৫০ জন। এমবিবিএস চিকিৎসক প্রয়োজন ৬৯৩০৫ জন। ৩) উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র ঃ৪৯২টি। রোগীদের প্রতিদিনের উপস্থিতি ৫০০ থেকে ১০০০ জন। গড়ে ৭৫০ জন। সারাদেশে মোট রোগীর সংখ্যা ৩৬৯০০০ জন। এমবিবিএস চিকিৎসক প্রয়োজন ১২৩০০ জন। ৪) প্রাইমারী স্বাস্থ্যখাতে মোট চিকিৎসক প্রযোজন : ১২১০০ + ৬৯৩০৫ + ১২৩০০= ৯৩৭১৫ জন।
সেকেন্ডারী স্বাস্থ্যখাত : জেলাসদর হাসপাতাল। প্রতিজেলায় ১টি হিসাবে ৬৯টি।রোগীদের প্রতিদিনের উপস্থিতি ১০০০-২০০০ জন। গড়ে ১৫০০ জন। সারা দেশে মোট রোগীর সংখ্যা ১০৩৫০০ জন। এমবিবিএস চিকিৎসক প্রয়োজন ৩৪৫০ জন। টারশিয়ারী স্বাস্থ্যখাত : মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সরকারী মোট ৩৬টি। রোগীদের প্রতিদিনের উপস্থিতি ৩০০০-৬০০০ জন। গড়ে ৪৫০০ জন। সারা দেশে মোট রোগীর সংখ্যা ১৬২৫০০ জন। এমবিবিএস চিকিৎসক প্রয়োজন ৫৪০০ জন। স্বাস্থ্যখাতে মোট চিকিৎসক প্রয়োজন : প্রাইমারী খাত+ সেকেন্ডারী+ টারশিয়ারী= ৯৩৭১৫+ ৩৪৫০+ ৫৪০০= ১০২৫৬৫ জন।
গ) উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রসমূহে রোগীর সংখ্যানুপাতে চিকিৎসকদের অপ্রতুল পোস্টিং, ঘ) বানিজ্যিকিকরনকৃত ভর্তি পরীক্ষা নেয়া : সরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তিযোগ্য সিটের দ্বিগুন সংখ্যক প্রাইভেট মেডিকেল কলেজের সিটে ভর্তি করানোর জন্য এবং ভর্তি পরীক্ষার ফি হিসাবে দশ বারো কোটি টাকা সংগ্রহের জন্য অধিক সংখ্যক ছাত্রকে ভর্তি পরীক্ষায় বসার অনুমতি দেয়া হয়।বিগত ২০২৩ সালের ৯ ফেব্রæয়ারী অনুষ্ঠিত ২০২৩-২৪ শিক্ষা বর্ষের এমবিবিএস কোর্সের ভর্তি পরীক্ষায় সরকারি ৫৩৮০ আসন ও বেসরকারি ৬২৯৫ আসনসহ মোট ১১৬৭৫ আসনের বিপরীতে ১ লাখ ৪ হাজার ৩৭৪ জন শিক্ষার্থী আবেদন করেছিল। (চলবে)
লেখক : ডায়াবেটিস ও চর্মযৌনরোগে স্নাতকোত্তর
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক, চট্টগ্রাম