দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়নে আন্তরিক হতে হবে

1

বিগত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে অন্যতম ঘোষণা ছিল, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ’। এমন ঘোষণা দিয়ে দলটি টানা তৃতীয়বারের মতো নির্বাচনী বৈতরনী পার হয়ে দীর্ঘ পাঁচ বছর সরকার পরিচালনা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী সরকার গঠনের পরপর দুর্নীতির বিরুদ্ধে আবারও তাঁর জিরো টলারেন্স নীতির কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন এবং দুর্নীতি দমন কমিশন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে অভিযান পরিচালনার নির্দেশ নিয়েছিলেন। এরপরও লক্ষ করা গেছে, দুর্নীতি দমন কমিশন বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাদের নিয়মিত অভিযানের বাইরে উল্লেখযোগ্য কোন পদক্ষেপ নিতে পারছেন বলে মনে হয়না। তবে যুবলীগ নামধারী কয়েকজন নেতাকর্মী কেসিনো ইস্যুতে গ্রেফতার হয়েছিল, কয়েকজন ব্যাংক পরিচালক দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছিল। তাদের বিচার কার্যক্রম এখনও চলমান। এ বছরের শুরুতে ২০৪১ সাল নাগাদ স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের কর্মসুচি একইভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কমিটমেন্ট দিয়ে চতুর্থবার সরকার গঠন করেছে। ৬ মাসের ব্যবধানে সরকার উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ না নিলেও গণমাধ্যমের খবর এবং বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের বেশ কয়জন সাবেক সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তার দুর্নীতির কথা ফাঁস হয়ে যায়। এতে দেশের ভাবমুর্তিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় সরকার দুর্নীতি দমনে আবারও জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছে। প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করে চলমান অভিযান অব্যাহত রাখা হবে বলে জাতীয় সংসদকে জানিয়েছেন। আমরা আমা করি, প্রধানমন্ত্রীর এবারের প্রত্যয় কঠোরভাবে বাস্তবায়নে দুর্নীতি দমন কমিশন আন্তরিকভাবে কাজ করবে। অতীতে প্রধানমন্ত্রী আন্তরিক থাকলেও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ধিরে চলা নীতির কারণে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি কাক্সিক্ষত সফলতা পায় নি। পর্যবেক্ষকদের মতে, ওই সময় দুর্নীতির লাগাম টানার পদক্ষেপ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছিল। তবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বলছে, সংস্থাটি দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার পথেই হাঁটছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা চারদলীয় জোট সরকার আমলে দুর্নীতির সূচকে এক নম্বরের তুলনায় এখন ১৩ নম্বরে থাকাকে উন্নতি হিসেবে উল্লেখ করে বলছেন, সরকার শূন্য সহনশীলতার নীতিতে অটল আছে। ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা, নীতি’ ঘোষণা করে ইশতেহারে বলা হয়েছিল, দুর্নীতি প্রতিরোধে আইনি ব্যবস্থার পাশাপাশি রাজনৈতিক, সামাজিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ জোরদার করা হবে। ঘুষ, অনোপার্জিত আয়, কালো টাকা, চাঁদাবাজি, ঋণখেলাপি, টেন্ডারবাজি ও পেশীশক্তি প্রতিরোধ এবং দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, সরকার ওই ঘোষণার পর দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করতে উদ্যোগ এবং এর লোকবল বৃদ্ধির পাশাপাশি আধুনিকায়নেও নানা পদেক্ষপ গ্রহণ করা হয়। তবে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা নীতি’ কার্যত ঘোষণা আর উদ্যোগের মধ্যেই রয়ে গেছে। স্বাস্থ্য খাতে কেনাকাটা এবং ব্যাংক খাতে ঋণের নামে অর্থ লোপাটের লাগাম টানা যায়নি। সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগেও নানা ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে সদিচ্ছা ব্যক্ত করা হলেও মাঠ প্রশাসনে ঘুষ, দুর্নীতি দমনে নানা পদক্ষেপ গ্রহণের বড় ঘাটতি থাকার দিকটিই বারবার সামনে চলে আসছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) তথ্য বলছে, বাংলাদেশের দুর্নীতির যে চিত্র তা গত এক দশকের মধ্যে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। দুর্নীতি প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করলেও তা বাস্তবায়নে সদিচ্ছার অভাব রয়েছে বলে মনে করে জার্মান ভিত্তিক সংস্থা টিআইবি। এ ছাড়া কোম্পানি সংক্রান্ত সিপিডির এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে ব্যবসার জন্য বড় বাধা হচ্ছে ‘দুর্নীতি’। সংস্থাটির এক জরিপে বলা হয়, ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশ ব্যবসায়ী মোটা দাগে দুর্নীতিকে ব্যবসার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখছেন। তবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি সঠিকভাবেই নির্ধারিত হয়েছে বলে মনে করছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তারা। এ নীতিকে সামনে রেখে লক্ষ্য বাস্তবায়নে সংস্থাটির সার্বিক কর্মকা- পরিচালিত হচ্ছে বলে দাবি করা হয়েছে। অপরদিকে সম্প্রতি বিরোধী ও সরকারি দলের সংসদরা জাতীয় সংসদে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরার দাবিতে সোচ্চার হলেও দেশে দুর্নীতি কমেছে বলে দাবি করে আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, ‘এর প্রমাণ হচ্ছে ২০০১ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বিএনপির সময় আমরা দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন ছিলাম। এখন আমরা ১২/১৩ নম্বরে গিয়েছি। এটাও ভালো না, আরও ভালো হতে হবে। সে লক্ষ্যে ইতোমধ্যে আমরা দুর্নীতি কমিয়ে আনতে আইনানুগ ব্যবস্থার পাশাপাশি প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কখনও কখনও দুর্নীতি নিয়ে আমাদের ওপর মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হয়েছে। এর বড় উদাহরণ হচ্ছে- পদ্মা সেতু নিয়ে। কিন্তু কানাডার আদালতে এটি মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।’ বলার অপেক্ষা রখেনা যে, সরকার ২০১০ সালে উন্নয়নের মেগা প্রকল্পসমূহ স্বচ্ছতার সাথে বাস্তবায়নের লক্ষে ‘জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলপত্র’ প্রণয়ন করেছিল ২০১২ সালে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এ কৌশলপত্রে বিভিন্ন আর্টিক্যাল যুক্ত করা হলেও বাস্তবে তা প্রশিক্ষণে সীমাবদ্ধ; কার্যক্ষেত্রে নয়। বঙ্গবন্ধু দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার উপর জোর দিয়েছিলেন বার বার। আমরা মনে করি, এখন সে সময়। সরকারের একার পক্ষে তা সম্ভব নয়, জনগণকে সচেতন হতে হবে। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।