দুর্নীতির দুর্বিত্তায়ন আর কতদিন ?

6

একসময় মানুষ ভাগ্য গণনার জন্য কবুতরের দ্বারস্থ হতেন। চট্টগ্রাম স্টেশন রোড তৎকালীন নুপুর সিনেমার পাশে কবুতর আর খাম নিয়ে ভাগ্য গণকরা সারাদিন বসে থাকতেন। খামের ভিতর ছোট্ট কাগজে লেখা থাকত মানুষের ভাগ্য। নিরীহ পশু মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করতে পারলেও গণকের শারীরিক অবয়ব ও পোশাক-পরিচ্ছেদ দেখে নির্ঘাত বুঝা যেত কবুতর গণকের ভাগ্য বদলাতে পারে নি; কপাল বলে কথা। কথাটি আসছে রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমানের ছেলের কুরবানির ছাগলকান্ড আর ভাগ্যের নির্মমতা নিয়ে। ছাগলটি গণক কিনা তা জানা নেই, তবে ১৫ লাখের ছাগল নিয়ে মতিউরের দুর্নীতির দৌরাত্ম্য থমকে যাওয়া, মতিউরের রাজত্বের অবসানের সাথে স্ত্রী ও সন্তানদের রাজকীয় জীবনের ছন্দপতন আর ছাগল বেপারির গোবর ফাঁস হওয়ার মত ঘটনা নিরীহ ছাগলের কারিশমার প্রকাশ পেয়েছে বটে, দেশের দুর্নীতি দমন কমিশন, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কার্যক্রম নিয়ে নতুনভাবে ভাবনার সময় হয়েছে বলে বিশিষ্টজনরা মত দিচ্ছেন। বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাকে আমাদের গৌরব করার অনেক কিছু আছে। বিশেষ করে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ দমনে এ সংস্থাটির সামর্থ ও দক্ষতা প্রশংসনীয়। চাঞ্চল্যকর বেশকিছু অপরাধের তদন্ত ও আসামীদের গ্রেফতারের ক্ষেত্রে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ভূমিকা ঈর্ষনীয়। তবে সম্প্রতি অবসরপ্রাপ্ত পুলিশের এক শীর্ষ কর্মকর্তা কিংবা অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বাহিনীর এক শীর্ষ কর্মকর্তাসহ রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউরের দুর্নীতি ও টাকা পাচারের একেকটি তথ্য দেশবাসীকে অবাক করছে। এসব ঘটনা নিয়ে জাতীয় সংসদেও সরকারি ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা উত্তাপ ছড়াচ্ছে। সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতা ও ঢাকা-৮ আসনের সংসদ সদস্য আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম বলেছেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের মধ্যে এমন মতিউর আছে, ছাগল বা বোবা প্রাণি দ্বারা চিহ্নিত করার আগে আমাদের দায় রয়েছে তাদের চিহ্নিত করার। এসময় তিনি ক্ষোভের সাথে বলেন, “ যারা রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বে থাকেন, যেমন মতিউরকে দুর্নীতি দমন কমিশন, গণমাধ্যম এমনকি আমরা যারা রাজনীতিবিদ আছি তারা চিহ্নিত করতে পারিনাই। তাকে একটি বোবা প্রাণি ছাগল চিহ্নিত করেছে। এমন মতিউর আরও আছে কিনা , যাদের ভবিষ্যতে ছাগল কিংবা অন্য কোন বোবা প্রাণি চিহ্নিত করার আগে তাদের চিহ্নিত করার প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট সংস্থার।” দেরিতে হলেও রাজনীতিবিদ ও সংসদ সদস্যদের এমনটি ক্ষোভ জাতীয় সংসদে আলোচনা আশাব্যাঞ্জক। এর আগে দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও খেলাপি ঋণ আদায়ে সরকারকে কঠোর হওয়ার আহবান জানিয়েছিলেন বিরোধী দল ও স্বতন্ত্র কয়েকজন সংসদ সদস্য। এসময় দেশের জন্য গুরুতর এসব সমস্যা সমাধানে সময়ক্ষেপণ না করে এখনই বিশেষ কমিশন অথবা বৃহত্তর কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের দাবি জানিয়েছিলেন তারা। গত সোমবার জাতীয় সংসদে ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে তারা এ দাবি জানান। দেশে দুর্নীতি বন্ধ করতে এখনই ‘বিশেষ কমিশন’ গঠনের দাবি জানানোর পাশাপাশি দুর্নীতিবাজদের অর্থসম্পদ বাজেয়াপ্ত ও বিচার করে কঠিন শাস্তি নিশ্চিত করার দাবিও জানান তারা। আমরা তাদের এসব দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করছি। বস্তুত দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতি, দুর্নীতি, অর্থ পাচার, ব্যাংক খাতে লুট ও নৈরাজ্য, খেলাপি ঋণের বিশাল পাহাড় দেশের অর্থনীতিতে সংকট বাড়িয়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে দেশের সব দুর্নীতিবাজকে আইনের আওতায় আনা জরুরি।
আলোচনাকালে বিরোধী দলের সংসদ-সদস্যরা আরও বলেছেন, প্রতিবছর দেশ থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। ঋণখেলাপিদের তালিকা প্রকাশের দাবিও জানিয়েছেন তারা। আমরা মনে করি, এক্ষেত্রে তালিকা প্রকাশই যথেষ্ট নয়। খেলাপি ঋণ আদায়ে যা যা করণীয়, এর সবই করতে হবে। খেলাপি ঋণ নিয়ে বছরের পর বছর আলোচনা হয়; খেলাপি ঋণ আদায়ে নানারকম উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। এত উদ্যোগ নেওয়ার পরও কেন এসব খাতে কাক্সিক্ষত সুফল মিলছে না, তা খতিয়ে দেখা দরকার। যেহেতু দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও খেলাপি ঋণের কারণে দেশে নানারকম সংকট সৃষ্টি হয়েছে, সেহেতু এসব সমস্যা সমাধানে জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
সোমবার জাতীয় সংসদে একজন সংসদ-সদস্যের এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, দেশের শীর্ষ ঋণখেলাপি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তালিকা তৈরির প্রক্রিয়া চলছে। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ কেলেঙ্কারি বন্ধে খেলাপি ঋণগ্রহীতা ও ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতাকে নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করে চিহ্নিত করা এবং ওই ঋণগ্রহীতার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়াসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেছেন, বিদ্যমান আইনে খেলাপি ঋণগ্রহীতা ও ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতা সম্পর্কিত বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং সে অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি করে সার্কুলার দেওয়া হয়েছে। এসব পদক্ষেপের সুফল নিশ্চিত করতে হবে।
অর্থ পাচারের একটি বড় কারণ দুর্নীতি। ঋণ খেলাপ করাও একধরনের দুর্নীতি। দুর্নীতি রোধ করা গেলে অর্থ পাচার ও ঋণ খেলাপি হওয়ার প্রবণতাও কমবে। মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণ ও অর্থ পাচারের কারণে দেশের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তির উপায় খোঁজা জরুরি। এক্ষেত্রে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। অর্থ পাচারের ছিদ্রগুলো শনাক্ত করতে হবে। কীভাবে, কোন কোন চ্যানেলে অর্থ পাচার হচ্ছে, তা সঠিকভাবে চিহ্নিত করে সেই ফাঁকগুলো বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি কঠোরভাবে প্রয়োগ করা এখন সময়ের দাবি-বলে আমরা মনে করি।