দুদেশের সম্পর্ককে আরো গভীর করবে

6

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফর শেষে গত ১০ তারিখ রাতেই দেশে ফিরেছেন। ৪ দিনের সিডিউল থাকলেও তিনদিনে সকল কর্মসূচি শেষ করে তিনি দেশে ফিরেছেন বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন। টানা চতুর্থবার সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী পরপর দুটি বৃহৎ প্রতিবেশী দেশে সফর করেছেন। দুটি সফরই ছিল গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যময়। মুক্তিযুদ্ধকালীন চীনের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন ও সমালোচনা থাকলেও ১৯৭৫ সাল থেকে চীনের সাথে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের জোড়া লাগে। দুদেশের সরকারের আন্তরিকতায় এ সম্পর্ক এখন বহু উচ্চতায় রয়েছে। দেশের অবকাঠামো, শিল্প, বাণিজ্য, শিক্ষা ও ডিজিটাল উন্নয়নে চীন বাংলাদেশের বড় অংশীদার। সম্প্রতি পদ্মাসেতু নির্মাণ ও কর্ণফুলীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু টানেলে চীনের কারিগরি ও অন্যান্য সহযোগিতা বাংলাদেশকে ঋণি করে রেখেছে। সম্প্রতি রোহিঙ্গা প্রত্যাবসান নিয়ে চীনের অবস্থানও ইতিবাচক বলে মনে হয়। সবগুলো বিবেচনায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত ছিল। এ সফরের মধ্য দিয়ে দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন দুয়ার খুলবে বলে আশা করছেন কূটনেতিক বিশ্লেষকরা। প্রধানমন্ত্রীর এ সফরে যেসব সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে, তাতে দুদেশের বাণিজ্যিক বৈষম্য দূরীকরণ, দেশে আরো বেশি বিনিয়োগ, শিক্ষা, আইটি ও শিল্পখাতে চীনের সহযোগিকা বাড়বে। এছাড়া বাংলাদেশ ও চীনের দুই নেতার মধ্যে রোহিঙ্গা ইস্যুটি গুরুত্ব পায়, সমস্যা সমাধানের চীনের সহযোগিতা থাকবে বলে -আশ্বস্থ করেন। এ সফরকালে প্রধানমন্ত্রী চীনা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে বিশ্বের সবচেয়ে উদার বিনিয়োগ ব্যবস্থার দেশ হিসাবে বাংলাদেশকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। সফরের দ্বিতীয় দিন বেইজিংয়ে ‘বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য, ব্যবসা এবং বিনিয়োগের সুযোগ’ শীর্ষক শীর্ষ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শুধু অবকাঠামো, জ্বালানি ও লজিস্টিক খাতেই নয়; সেই সঙ্গে আইসিটি, পর্যটন, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প এবং উন্নয়ন খাতেও বড় পরিসরে বিনিয়োগের আহŸান জানিয়েছেন। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রীর এ সফরকালে চীনের সঙ্গে ২১টি সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি এবং ৭টি ঘোষণাপত্রে সই করেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ২টি সমঝোতা স্মারক নবায়নও হয়েছে।
চুক্তি-সমঝোতা স্মারক ও দলিলগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-ডিজিটাল অর্থনীতিতে বিনিয়োগ সহায়তা শক্তিশালী করা, অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন নীতি সহায়তা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহায়তা এবং ডিজিটাল অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোরদার, মেডিকেল সেবা ও জনস্বাস্থ্য বিষয়ে সহযোগিতা শক্তিশালী করা, বন্যার মৌসুমে ব্রহ্মপুত্র নদীর হাইড্রোলজিক্যাল তথ্য দেওয়ার বিধিবিষয়ক সমঝোতা স্মারক নবায়ন, চীনের মিডিয়া গ্রুপ ও দেশটির জাতীয় রেডিও ও টেলিভিশনের সঙ্গে আমাদের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের মধ্যে কয়েকটি সহযোগিতা ও সমঝোতা স্মারক সই, শিক্ষাবিষয়ক সমঝোতা স্মারক নবায়ন, টেকসই অবকাঠামো উন্নয়নে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ বিষয়ক সমঝোতা স্মারক সই। এছাড়া ডিজিটাল কানেক্টিভিটি, সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিংয়ের ট্রায়াল, দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি, রাজশাহী ওয়াসা সারফেইস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট ও বাংলাদেশে লুবান ওয়ার্কশপ নির্মাণবিষয়ক সাতটি ঘোষণাপত্রও স্বাক্ষর হয়েছে।
সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে চীনের বহু পণ্য এদেশে আমদানি হয়ে থাকে। তবে পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, সে তুলনায় আমাদের দেশের পণ্য সেদেশে রপ্তানি হয় কম। বাণিজ্য ভারসাম্য কমাতে তাই চীনে রপ্তানি বৃদ্ধির দিকে অধিক মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন আমাদের। কোন কোন পণ্যের চাহিদা রয়েছে চীনের বাজারে, সে বিষয়ে আগাম জরিপ চালাতে হবে। শুধু তাই নয়, বাণিজ্যিক স্বার্থে রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্ক সুবিধার বিষয়টিও গুরুত্বের দাবি রাখে। এছাড়া দীর্ঘদিনের গলার কাঁটা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রশ্নেও চীনের সমর্থন ও সহযোগিতা আমাদের প্রয়োজন। মনে রাখা দরকার, জনবল তো বটেই, বাণিজ্যিক দিক থেকে এদেশ দক্ষিণ এশীয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় এবং পূর্ব এশীয় প্রবৃদ্ধি সার্কিটের সংযোগস্থলে রয়েছে। আমাদের সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর ও স্থলপথগুলো আন্তর্জাতিক মান পূরণে ক্রমাগত উন্নত, দক্ষ ও নির্বিঘ্ন হচ্ছে। এছাড়া দেশের বিশাল অভ্যন্তরীণ বাজার এবং এর সংলগ্ন বাজারগুলোয় সমগ্র অঞ্চলের জন্য অফুরন্ত সুযোগ রয়েছে। চীন যদি সুযোগগুলো কাজে লাগাতে পারে, তাহলে শুধু তারাই নয়, আমরাও লাভবান হব। গেল এক দশকে দুদেশের সম্পর্কের গুণগত উত্তরণ ঘটেছে। চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ উদ্যোগে বাংলাদেশ যুক্ত হয়েছে। চীন অর্থায়ন করেছে পদ্মা রেলসেতু ও বঙ্গবন্ধু টানেলের মতো বড় প্রকল্পেও। কাজেই এ ধারাবাহিকতা শুধু ধরে রাখাই নয়, ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দুদেশের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হলে আখেরে তা বাংলাদেশের জন্যই সুফল বয়ে আনবে।