দুই বছরেও আলোর মুখ দেখেনি তদন্ত প্রতিবেদন

2

ফারুক আবদুল্লাহ

একজন চিকিৎসক কতটা অমানবিক হলে প্রচন্ড কষ্ট পাওয়া একজন রোগীকে অক্সিজেন ছাড়া কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার থেকে বাইরে নিয়ে যেতে নির্দেশ দেন! চিকিৎসকের এমন পৈশাচিক কর্মকান্ডের কারণে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়া রোগীর মৃত্যু হয়।
এ ঘটনায় সংবাদ সম্মেলন করে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে দোষীদের বিরুদ্ধে বিচারের দাবি জানিয়েছিলেন স্বজনরা। এছাড়া একের পর এক চারটি তদন্ত কমিটি করেই দায় শেষ, আলোর মুখ দেখেনি তদন্ত প্রতিবেদন। চরম হতাশায় ন্যায় বিচারের আশায় শেষ ভরসাস্থল হিসাবে হাইকোর্টে আশ্রয় নিয়েছে স্বজনরা। আজ বুধবার (৫ জুন) রোগী মৃত্যুর দুই বছর পূর্ণ হচ্ছে।
ঘটনাটি ঘটে ২০২২ সালের ৫ জুন, রাত আনুমানিক সাড়ে ৯ টায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অবস্থিত ‘স্যানডর ডায়ালাইসিস সেন্টারে’। ওইদিন সেখানে নগরীর ২০ নং দেওয়ান বাজার ওয়ার্ডের ঘাটফরহাদবেগ এলাকার বাসিন্দা কিডনী রোগী সাফিয়া খানমের মৃত্যু হয়।
পরিবারের অভিযোগ, ওই প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসক ডা. রেহনুমা তারান্নুম এবং তার সহযোগীদের অপচিকিৎসা, স্বেচ্ছাচারিতা ও অবহেলার কারণে রোগীর মৃত্যু হয়।
মায়ের মৃত্যুর দুই বছর পূর্ণ হওয়ার বিষয়ে পুত্র তানভীর আহমেদ বলেন, মায়ের মৃত্যুর ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির তদন্ত কাজে অহেতুক দীর্ঘসূত্রিতা, তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশে অস্বীকৃতি এবং তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থতার কারণে স্যানডর ডায়ালাইসিসের ডা. রেহনুমা এবং তার সহযোগীরা বহাল তবিয়তে আছেন। তাদের চরম অবহেলার কারণে একজন রোগীর মৃত্যু মত গুরুতর অপরাধে অভিযুক্তদের আড়াল করার একটি সু² চেষ্টা ছিল তদন্ত কমিটির।তানভীর আরও বলেন, ডায়ালাইসিস চলা অবস্থায় আমার মায়ের অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৭২-এ নেমে আসে। তা সত্ত্বেও ডা. রেহনুমা আমার মাকে আইসিইউতে রেফার না করে অক্সিজেন মাক্স খুলে ফেলেন। এরপর হুইল চেয়ারে বসিয়ে তার লোকজন দিয়ে ডায়ালাইসিস সেন্টারের বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে যে সেচ্ছাচারিতা, অবহেলা, অপেশাদারিত্ব, নির্মমতা ও দূর্ব্যবহার করেছেন, চিকিৎসা জগতের ইতিহাসে তার নজির নেই। এই মৃত্যু ঠান্ডা মাথায় খুন ছাড়া আর কিছু নয়।
তিনি আরও বলেন, ডা. রেহনুমাকে একাধিকবার বললেও তিনি তদন্ত কমিটির নিকট সেদিনের সিসিটিভি ফুটেজ দেননি। তাছাড়া তদন্ত কমিটিতে যারা আছেন, তারা সবাই ডাক্তার এবং যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনিও ডাক্তার। ফলে আমার মায়ের মৃত্যুর তদন্ত কেমন হবে, সে বিষয়ে আমরা সন্দিহান। তাই ন্যায় বিচার প্রাপ্তির আশায় শেষ ভরসাস্থল হিসাবে আমরা মহামান্য হাইকোর্টের আশ্রয় নিয়েছি। আশা করি, এখানে আমরা ন্যায় বিচার পাব।
রোগীর স্বামী বিশিষ্ট সমাজকর্মী এম এ মাসুদ বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী, ডাইরেক্টর জেনারেল অব হেলথ, ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ, বিএমএ ও স্বাচিপ- সকলের প্রতি আকুল আবেদন, আমার স্ত্রীর অসহায় মৃত্যুর সাথে জড়িত স্যানডর কর্তৃপক্ষ এবং ডাক্তার রেহনুমা ও তার সঙ্গীদের আইনের আওতায় এনে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তি নিশ্চিত করুন। আর কোন কিডনী রোগী তথাকথিত ডাক্তারের স্বেচ্ছাচারিতা, অমানবিক ও ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে যাতে মারা না যান, তা নিশ্চিত করুন।
তিনি বলেন, ডা. রেহনুমা চেয়েছিলেন রোগীর অক্সিজেন স্যাচুরেশন যেহেতু ৭২, সেহেতু যে কোন সময় রোগীর খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারে। এই অবস্থায় রোগী যদি মারা যায়, ডায়ালাইসিস সেন্টারের বাইরেই যেন মারা যায়। তাই রেহনুমা তড়িঘড়ি করে আমার স্ত্রীকে তার লোকজন দিয়ে হুইল চেয়ারে বসিয়ে বের করে দেন। এরপর আমার স্ত্রী বিনা চিকিৎসায় ও অক্সিজেন ছাড়াই মৃত্যুবরণ করেন।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য উপ-পরিচালক ডা. ইফতেখার আহমদ বলেন, আমি দায়িত্ব গ্রহণ করেছি এক সপ্তাহ হচ্ছে। এ বিষয়ে কিছু জানি না। খবর নিয়ে জানাতে হবে।
উল্লেখ্য, এ ঘটনা তদন্তের জন্য স্বাস্থ্য উপ-পরিচালক, চট্টগ্রাম বিভাগ এবং বিভাগীয় প্রধান, নেফ্রোলজি বিভাগ, চমেক হাসপাতালকে সভাপতি করে দুইটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয় এবং তদন্ত হয়। কিন্তু এ দুই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেনি। সর্বশেষ গত বছর ২১ আগস্ট স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালককে সভাপতি, চমেক হাসপাতালের উপ-পরিচালক ও নেফ্রোলজি বিভাগের প্রধানকে সদস্য করে ৩ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় এবং কমিটিকে সাতদিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়। তদন্ত কমিটি সাত দিনের স্থলে পাঁচ মাসে তদন্ত সম্পন্ন করে গত ১ জানুয়ারি তদন্ত রিপোর্ট, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবরে পাঠায়। নিহতের স্বামী এম এ মাসুদ তথ্য অধিকার আইনের ৩ ধারা মোতাবেক এই তদন্তের একটি কপি পাওয়ার জন্য তথ্য কমিশনের নির্ধারিত ফরমে তদন্ত কমিটির সভাপতির কাছে আবেদন করলে, তিনি তা দিতে অস্বীকৃতি জানান।