দিনভর সারাদেশে রক্তাক্ত সংঘাত

15

পূর্বদেশ ডেস্ক

কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রভাবে গত ৪ জুলাই থেকে রাজপথ উত্তাল। ‘বাংলা বøকেড’, বিক্ষোভ মিছিল, অবস্থান, সমাবেশসহ আন্দোলনকারীদের নানান কর্মসূচি চলছে একের পর এক। আন্দোলনের ১২তম দিনে সোমবার (১৫ জুলাই) প্রথম বড় ধরনের সহিংসতা হয়। ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে শত শত মানুষ আহত হয় এদিন। তবে গতকাল মঙ্গলবার আন্দোলনের ১৩তম দিনটি হলো আরও রক্তক্ষয়ী। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রংপুরে কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও পুলিশের সংঘর্ষে ৬ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে গতকাল রাত ১১টায় এ রিপোর্ট লিখা পর্যন্ত। আহত হয়েছেন অগণিত।
নিহতদের মধ্যে রংপুরের একজন, চট্টগ্রামের তিন জন ও ঢাকার দুজন রয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিহতের সংখ্যা আরও বেশি হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লেও তার কোনও সত্যতা পাওয়া যায়নি।
রাজধানী ঢাকা, রংপুর, চট্টগ্রাম, টাঙ্গাইল, রাজশাহী, কুমিল্লা, বগুড়া, ময়মনসিংহ, খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া, বরিশাল, সিলেটসহ বিভিন্ন স্থানে কোটাবিরোধীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মী ও পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এসব সংঘর্ষে আহত হয়েছেন শত শত তরুণ-তরুণী। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দেশজুড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক থাকার পাশাপাশি ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়া, রাজশাহী ও রংপুর জেলায় বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গতকাল বিকালে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, কোটা আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াত ইন্ধন দিচ্ছে। তারা নির্বাচনে আসে না। বাইরে থেকে হইচই করে। তবে আন্দোলনকারীরা কোনও ধরনের ধ্বংসাত্মক কাজ করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ আন্দোলনে বিভিন্ন মহল থেকে উসকানি দেওয়া হচ্ছে। তারা যেন আন্দোলন ছেড়ে ফিরে আসে। শিক্ষার্থীরা যেন ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমে লিপ্ত না হয় সেই আহবান জানান তিনি।

রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ, নিহত ২ : সোমবারের মতো গতকালও রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। এসময় ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা মাথায় হেলমেট পরে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দিলে সংঘর্ষ শুরু হয়। রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব এলাকায় শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করলে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে ধাওয়া দেন। পরে উভয় পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হতে থাকে। দুই পক্ষ থেকেই ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু হলে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় পুরো সায়েন্স ল্যাব-নিউ মার্কেট এলাকা।
দুপুরের পর ঢাকা কলেজের সামনে এক তরুণকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে ফেলে রেখে যায় একদল দুষ্কৃতকারী। পরে পথচারীরা তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এছাড়া সিটি কলেজের সামনে আরেক তরুণ আহত অবস্থায় পড়ে ছিল। তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকেও মৃত ঘোষণা করেন।
গতকাল সকাল থেকেই রাজধানী ঢাকার মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বর, বাড্ডা, মহাখালী, ফার্মগেট উত্তরা, পুরান ঢাকা, চানখাঁরপুল এলাকায় কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা। ফার্মগেটে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করলে তেজগাঁও কলেজ শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের ধাওয়া দেয়। সেখানে সংঘর্ষ শুরু হলে একপর্যায়ে তা মেট্রো স্টেশন পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।
মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বর অবরোধ করে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করলে তাদেরও ধাওয়া দেয় ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা। পরে আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পুরান ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অভিমুখে মিছিল নিয়ে আসার সময় সেখানেও সংঘর্ষ হয়। অজ্ঞাত দুষ্কৃতকারীদের গুলিতে অন্তত চার জন গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
মহাখালীতে রেললাইন অবরোধ করে রেখেছিল আন্দোলনকারীরা। বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে প্রতিবাদ শুরু করে। উত্তরায় বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করলে সেখানেও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।

রংপুরে নিহত একজন : বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রংপুর জিলা স্কুল থেকে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী কোটা সংস্কার নিয়ে মিছিল বের করেন। মিছিলটি পুলিশ লাইন্সের কাছে এলে পুলিশ মিছিলকারীদের গতিরোধ করে। এ সময় লাঠিচার্জ করে পুলিশ। কিন্তু পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে মিছিলকারীরা নগরীর জাহাজ কোম্পানি এলাকায় এসে নগরীর প্রধান সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করে আধা ঘণ্টা সেখানে অবস্থান করেন। এরপর বিক্ষোভকারীরা মিছিল নিয়ে প্রেস ক্লাবের সামনে এসে বিক্ষোভ করেন।
পরে শিক্ষার্থীরা রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যেতে চাইলে পুলিশ আবার তাদের গতিরোধ করে। একপর্যায়ে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে মিছিল নিয়ে চার কিলোমিটার সড়ক অতিক্রম করে নগরীর লালবাগ এলাকায় পৌঁছে সেখানে কারমাইকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের সঙ্গে যোগ দেন। পরে মিছিলকারীরা রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি এলে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের ভেতরে অবস্থান নিয়ে আন্দোলনকারীদের ইটপাটকেল নিক্ষেপ করলে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে।
পুলিশ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে দুই পক্ষের মাঝখানে অবস্থান নিয়ে নিবৃত করার চেষ্টা করে। এ সময় বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি, রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে পুলিশ। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে আবু সাঈদ লুটিয়ে পড়েন। পরে শিক্ষার্থীরা তাকে উদ্ধার করে একটি অটোরিকশায় তুলে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে এলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
নিহত আবু সাঈদ (২২) বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমর্থক। তাজহাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রবিউল ইসলাম সংঘর্ষে শিক্ষার্থী নিহতের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তবে তিনি পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন কিনা, তা জানাতে পারেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রধান আসিফ আল মতিন বলেছেন, পুলিশের ছররা গুলিতে সাঈদ নিহত হয়েছেন।
প্রতিবাদ, হামলা, সংঘর্ষ : ঢাকার অদূরে সাভারের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সোমবার দিবাগত রাতে শতাধিক বহিরাগত হাতে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে কোটা আন্দোলনকারীদের নির্বিচারে পিটিয়েছে। আন্দোলনকারীরা ভিসির বাসার ভেতরে প্রবেশ করলে বহিরাগতরা ভিসির বাসভবনের প্রধান ফটক ভেঙে সেখানে প্রবেশ করে। গতকাল সকাল থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হল থেকে বেরিয়ে পুরো ক্যাম্পাসে মিছিল করে।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে খুলনার দৌলতপুর নতুন রাস্তা মোড়ে সরকারি বিএল কলেজের শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে রাখে। বিকাল ৩টার দিকে কুষ্টিয়া শহরের শত শত শিক্ষার্থী শহরের মজমপুরগেটে উপস্থিত হয়ে বিক্ষোভ মিছিল করে। এসময় শিক্ষার্থীরা মজমপুর গেটে রেললাইন ও মহাসড়কের ওপরে বসে বিক্ষোভ করে। এসময় কুষ্টিয়ার সঙ্গে দেশের সর্বত্র রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
কোটাবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের শিক্ষার্থীরা গতকাল সকাল ১১টার দিকে নতুন ভবনের সামনে সাতমাথা-তিনমাথা সড়ক অবরোধ করেন। এ সময় তারা কোটাবিরোধী বিভিন্ন ¯েøাগান দিতে থাকেন। অবরোধের সময় গুরুত্বপূর্ণ ওই সড়কের উভয় পাশে বিপুলসংখ্যক যানবাহন আটকা পড়ে। পরে পুলিশ প্রশাসনের অনুরোধে কোটাবিরোধীরা ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়েন। এ সময় প্রশাসন ভবনের কিছুটা সামনে হঠাৎ বিকট শব্দে ককটেল বিস্ফোরিত হয়। এতে কলেজের স্নাতক (সম্মান) তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সুমন রানা, মামুন, তাফসির ও মিলন রক্তাক্ত জখম হন।
সকাল ১১টার দিকে টাঙ্গাইল জেলা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী টাঙ্গাইল নিরালা মোড়ে অবস্থান নেন। এ সময় কোটাবিরোধী কয়েকজন সাধারণ শিক্ষার্থী মিছিল নিয়ে নিরালা মোড়ের দিকে যাওয়ার সময় হামলা ও ধাওয়া করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এতে নেতৃত্ব দেন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সোহানুর রহমান সোহান। এ সময় ছাত্রলীগের হামলায় ৩ শিক্ষার্থী আহত হয়।
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক অংশের বিভিন্ন পয়েন্টে অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল এলাকায় অবরোধ করে বিএম কলেজ ও ইনফ্রা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা। এছাড়া বরিশাল কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ করেন শেরেবাংলা মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীরা।

রাজধানীতে দুই বাসে আগুন : কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে দেশব্যাপী রক্তাক্ত সংঘাতের মধ্যে ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে দুটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেওয়া হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তা মো. শাহজাহান বলেন, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে প্রেসক্লাবের সামনে ‘কে বা কারা’ দুটি বাসে আগুন লাগিয়ে দেয়। পরে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা গিয়ে আগুন নেভান। ঘটনাগুলো ঘটে সচিবালয় মেট্রো স্টেশনের ঠিক নিচে। এসব ঘটনায় কারো হতাহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।