দাবি আদায়ে জোর নয় ধৈর্য ধরুন

9

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অগ্রাধিকার ও কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ছাত্র-জনতার নতুন বাংলাদেশ গড়তে এসব কাজ শেষ করতে সময় চেয়েছেন। প্রয়োজনীয় কাজ শেষে এ সরকারের দায়িত্ব হস্তান্তর ও নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি সবার আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কথা বলেছেন। নির্বাচনের বিষয়টিকে ‘সম্পূর্ণ রাজনৈতিক’ সিদ্ধান্ত হিসেবে তুলে ধরে তিনি দেশবাসীকে তা ঠিক করার কথা বলেছেন। দায়িত্ব নেওয়ার ১৭ দিনের মাথায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া দ্বিতীয় ভাষণে ড. ইউনূস বলেন, একটা বিষয়ে সবাই জানতে আগ্রহী, কখন আমাদের সরকার বিদায় নেবে। এটার জবাব আপনাদের হাতে, কখন আপনারা আমাদেরকে বিদায় দেবেন। আমরা কেউ দেশ শাসনের মানুষ নই। আমাদের নিজ নিজ পেশায় আমরা আনন্দ পাই। দেশের সংকটকালে ছাত্রদের আহবানে আমরা এই দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। আমরা সমস্ত শক্তি দিয়ে এই দায়িত্ব পালন করবো। আমাদের উপদেষ্টামন্ডলীও এই লক্ষ্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে সবাই মিলে একটা টিম হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে।
গতকাল রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যমে ২৬ মিনিটের ভাষণে মুহাম্মদ ইউনূস দেশের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরে তাঁর সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলো এবং আগামী দিনের পরিকল্পনার পাশাপাশি অগ্রাধিকারগুলোও জানিয়েছেন। ছাত্র-জনতার বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি পূরণে তার সরকারের অঙ্গীকারের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।
দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইউনূস বলেন, কখন নির্বাচন হবে সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আমাদের সিদ্ধান্ত নয়। দেশবাসীকে ঠিক করতে হবে আপনারা কখন আমাদের ছেড়ে দেবেন।
ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের সরকার পতনের পর ৮ আগস্ট শপথ নেয় শান্তিতে নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
শুরু থেকেই রাষ্ট্র মেরামতে অন্তর্বর্তী সরকারের জোরালো অবস্থানের কথা জানিয়ে আসছে নতুন সরকার। এদিন প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণেও এটি পুর্নব্যক্ত করেন।
তিনি বলেন, আমরা বিভিন্ন সংস্কারের কাজ শুরু করেছি দেশবাসীকে অনুরোধ করব, একটা আলোচনা শুরু করতে আমরা সর্বনি¤œ কী কী কাজ সম্পূর্ণ করে যাবো, কী কী কাজ মোটামুটি করে গেলে হবে। এই আলোচনার মাধ্যমে আমরা একটা দিকনির্দেশনা পেতে পারি। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক আলোচনা থেকেই আসবে। এই দিক নির্দেশনা না-পেলে আমরা দাতা সরকার এবং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সঙ্গে আলোচনায় দৃঢ়তার সঙ্গে অগ্রসর হতে পারছি না।
আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি আমরা আমাদের পক্ষ থেকে মেয়াদ বৃদ্ধির কোনো প্রশ্ন তুলব না। বৈষম্যহীন ও শোষণহীন রাষ্ট্র গড়তে ছাত্র-জনতার স্বপ্ন পূরণ করাই তার সরকারের লক্ষ্য হিসেবে তুলে ধরে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আমি তাদের সেই স্বপ্নপূরণে অঙ্গীকারবদ্ধ।
নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিভিন্ন দাবি জানিয়ে আন্দোলনে নেমেছেন অনেকেই। সেই দিকে দৃষ্টি দিয়ে তিনি বলেন, একটা বিশেষ ব্যাপারে আমরা আপনাদের সহযোগিতা চাচ্ছি। আমাদের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে প্রতিদিন সচিবালয়ে, আমার অফিসের আশেপাশে, শহরের বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ করা হচ্ছে। গত ১৬ বছরের অনেক দুঃখ-কষ্ট আপনাদের জমা আছে। সেটা আমরা বুঝি। আমাদের যদি কাজ করতে না দেন তাহলে এই দুঃখ ঘোচানোর সকল পথ বন্ধ হয়ে থাকবে। আপনাদের কাছে অনুরোধ আমাদের কাজ করতে দিন। আপনাদের যা চাওয়া তা লিখিত ভাবে আমাদের দিয়ে যান। আমরা আপনাদের বিপক্ষ দল নই। আইনসঙ্গতভাবে যা কিছু করার আছে আমরা অবশ্যই তা করব। কিন্তু আমাদেরকে ঘেরাও করে এই গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোতে আমাদের কাজে বাধা দেবেন না। ধৈর্য ধরুন, দাবি আদায়ে এখনই জোর করবেন না, রাতারাতি বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণ কঠিন।
সবাই মিলে তাদের বোঝান তারা যেন এ সময়ে তাদের অভিযোগের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য আমাদের দৈনন্দিন গুরুত্বপূর্ণ কাজে বাধা না দেন। আগের সরকারের অপশাসন ও দুর্নীতির খতিয়ান তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা ছাত্র-জনতার গণ আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলতে আগের ‘ফ্যাসিবাদের’ যুগ শেষে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি বলেন, গণরোষের মুখে ফ্যাসিবাদী সরকারপ্রধান দেশত্যাগ করার পর আমরা এমন একটি দেশ গড়তে চাই যেখানে প্রতিটি নাগরিকের মানবাধিকার থাকবে পুরোপুরি সুরক্ষিত। আমাদের লক্ষ্য একটিই-উদার, গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন, অসা¤প্রদায়িক বাংলাদেশ।
সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার দুই সপ্তাহের মাথায় ভারতের উজান থেকে ধেয়ে আসা ঢল ও বৃষ্টিতে উত্তর পূর্বাঞ্চলের ১০ জেলার ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা বন্যা দুর্গতদের জীবন দ্রুত স্বাভাবিক করার জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছেন। বর্তমান সরকারের কাজের অগ্রাধিকারের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে বল প্রয়োগ ও হতাহতের ঘটনায় তদন্ত করার কথাও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, স্বচ্ছ তদন্ত নিশ্চিত করতে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রধানকে বাংলাদেশে এসে তাদের তদন্ত শুরু করতে আমরা আমন্ত্রণ জানিয়েছি। তদন্তের এই প্রক্রিয়া এ সপ্তাহেই শুরু হবে। তাদের প্রথম দল ইতোমধ্যে এসে গেছে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় দায়ের করা ‘মিথ্যা ও হয়রানীমূলক’ মামলা প্রত্যাহার করার কথা তুলে ধরে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে গণ-অভ্যুথানে সকল শহীদের পরিবারকে পুনর্বাসন করা হবে। সকল আহত শিক্ষার্থী ও জনতার চিকিৎসার সম্পূর্ণ ব্যয় সরকার বহন করবে। তথ্যের অবাধপ্রবাহ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতিও দেন তিনি। তিনি বলেন, জনগণের তথ্যের অধিকার নিশ্চিত করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। শিক্ষাক্ষেত্রে ‘চরম নৈরাজ্যের’ অবসানেও তার সরকারে কাজ করার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, আমরা তার পূর্ণাঙ্গ সংস্কারের উদ্যোগ নেব। এটা আমাদের অন্যতম অগ্রাধিকার। একই সাথে পাঠ্যক্রমকেও যুগোপযোগী করার কাজও দ্রুত শুরু করা হবে। তিনি বলেন আপনাদের কাছে অনুরোধ, আমাদের কাজ করতে দিন। আপনাদের যা চাওয়া তা লিখিতভাবে দিয়ে যান। আমরা আপনাদের বিপক্ষ দল নই, আইনসঙ্গতভাবে যা কিছু করার আছে আমরা অবশ্যই তা করব। নির্বাচন কখন হবে সেই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক, আমাদের নয়। আমাদের লক্ষ্য একটিইÑউদার, গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন, অসা¤প্রদায়িক বাংলাদেশ। জনগণ প্রধান উপদেষ্টার এই ভাষণের যথাযথ বাস্তবায়ন আশা করে।