দখল-দূষণে অস্তিত্ব সঙ্কটে ঈদগাঁও’র ফুলেশ্বরী নদী

9

সেলিম উদ্দীন, ঈদগাঁও

ক্রমাগত দূষণ ও দখলে অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়ছে কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলার ঐতিহ্যবাহী ফুলেশ্বরী নদী। দিনদিন এই নদী একদিকে যেমন ময়লা আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে, অন্যদিকে নদীর মূল্যবান জমি ভূমিদস্যুদের দখলে চলে যাচ্ছে।
ভৌগোলিক তথ্যমতে, দেশের পূর্ব-দক্ষিণ সীমান্তবর্তী অঞ্চল বান্দরবানের মৈভার (মৈন পাহাড়) পর্বতশৃঙ্গ থেকে উৎপন্ন হয়ে ফুলেশ্বরী নদীর আনুমানিক ৪২ কিমি পাহাড়ি ও সমভূমি পাড়ি দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। পার্বত্য জেলা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারী, কক্সবাজার জেলার রামু উপজেলার গর্জনিয়া-ঈদগড়, ঈদগাঁও উপজেলার ঈদগাঁও, ইসলামাবাদ, জালালাবাদ, পোকখালী ইউনিয়নের উপর দিয়ে সর্পিল গতিতে প্রবাহিত হয়ে পশ্চিমে মহেশখালী চ্যানেলে মিশেছে।
যে সকল অঞ্চলের উপর দিয়ে এই নদী প্রবাহিত হয়েছে সেই সকল অঞ্চলের জীবন-জীবিকা, সভ্যতার ক্রমবিকাশ ও সমৃদ্ধি সর্বাংশে এই নদীর উপর নির্ভরশীল। এই দীর্ঘ পথে নদীর দু’পারে তৈরি হয়েছে বিস্তীর্ণ পলি ও পলি দো-আঁশ মাটির উর্বর প্লাবণ সমভূমি। যা এই অঞ্চলের ৫ লক্ষ জনগোষ্ঠীর কৃষিপ্রধান গ্রামীণ অর্থনীতিতে এনেছে সজীব ও স্বনির্ভর সচ্ছলতা আর সমৃদ্ধি। দেশের খাদ্যনিরাপত্তায় রাখছে অনন্যসাধারণ ভূমিকা। সময়ের বিবর্তনে শ্বাপদসঙ্কুল জনপদে সভ্যতার ক্রমবিকাশ ও সভ্যতা সৃষ্টির সূতিকাগার এই ফুলেশ্বরী নদী নিজেই মরাবন্ধ্যা জলস্রোতে পরিণত হয়েছে।
কক্সবাজারের বৃহত্তম বাণিজ্যিক উপশহর ঈদগাঁও বাজার, ঈদগাঁও বাস-স্টেশন ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকার পচনশীল ও অপচনশীল শতশত মণ বর্জ্য ফেলা হচ্ছে এই নদীতে। ফলে দূষিত হচ্ছে নদীর পানি, হারিয়ে যাচ্ছে নদীর প্রাণবৈচিত্র্যতা এবং ধ্বংস হচ্ছে নদীর প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থান ও জীবসত্ত্বা। নদীতীর ভরাট ও দখলের ফলে সরু ও সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে নদীর প্রশস্ততা। এতে নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে। যা প্রতি বর্ষা মৌসুমে বন্যা ও নদী ভাঙনের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
সরেজমিন ফুলেশ্বরী নদী উত্তর পারের (কবি মুহম্মদ নূরুল সড়ক) ঈদগাহ জাহানারা বালিকা বিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী পয়েন্টে (যা ঈদর্গাও উপজেলা সদর দপ্তর থেকে ৫০ মিটার দূরত্বে) দেখা গেছে, নদীর উত্তর পাড়ের অভ্যন্তরে পর্বতপ্রমাণ বর্জ্যরে স্তূপ। যার মধ্যে অধিকাংশই অপচনশীল পলিথিন ও মেডিক্যাল বর্জ্য। প্রতিদিন কিছু অসাধু ব্যবসায়ী রাতের আঁধারে ওই নদীর বাঁশঘাটা সেতু ও বাসস্টেশন সেতু পয়েন্ট দিয়ে ফেলছে মুরগী খামারের বর্জ্য, ফল ও তরকারী বর্জ্য, মাছ ও মুরগী কাটা উচ্ছিষ্ট বর্জ্য, হোটেল রেস্তোরাঁর বর্জ্যসহ গ্রহস্থালি বর্জ্য। নদীতীরে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠা অধিকাংশ আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনের মানব পয়োঃবর্জ্য পাইপলাইনের মাধ্যমে ফেলা হচ্ছে নদীর অভ্যন্তরে। এতে নদীর পানি মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। শুষ্ক মৌসুমে অনিয়ন্ত্রিত ও নিয়মবিরুদ্ধ বালু উত্তোলনের ফলে নদীর অমূল্য সম্পদ প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থান ধ্বংস হচ্ছে। নদীর অভ্যন্তরে তৈরি হচ্ছে গভীর খাদ, চোরাগুপ্তা গর্ত। এতে ফুলেশ্বরী নদী উদ্বেগজনক প্রতিবেশ সংকটের মুখোমুখি হওয়ার পাশাপাশি যৌবন ও জৌলুস হারিয়ে পড়েছে অস্তিত্ব সংকটের মুখে। সমাজ বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় মানুষের জীবন ও জীবিকা, কৃষ্টি কালচার, সাহিত্য-সংস্কৃতি, কৃষি, যোগাযোগ ও অর্থনীতির সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত এদেশের নদীসমূহের অস্তিত্ব আজ বিলীন হওয়ার পথে। ক্রমাগত দূষণ, অবৈধ দখলের ফলে নদীর চিরায়ত রূপ ও গতিপ্রকৃতি যেমন বিলুপ্ত হতে চলছে তেমনি মানুষের জীবিকা ও জীবনযাত্রা, পরিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্যতা, বাস্তুতন্ত্রও মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি কলিম উল্লাহ বলেন, ফুলেশ্বরী নদী কক্সবাজার জেলার বৈচিত্র্যময় একটি নদী। এভাবে একটি নদীকে অস্তিত্ব সঙ্কটে ঠেলে দেয়া দেশের পরিবেশ আইন, নদী রক্ষা আইনের সরাসরি বরখেলাপ এবং জীবন্ত সত্ত্বা হিসেবে স্বীকৃত নদীকে হত্যা করার সামিল।