তৃতীয় দফায় ভোটে আসবে তো!

5

প্রথম দফা ষষ্ঠ উপজেলা নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম দেখে নির্বাচন কমিশন যুক্তি দেখিয়েছিলেন, ভোটের আগের দিন ঝড়, বৃষ্টি, কৃষকের ধানকাটা ইত্যাদির কারণে ভোটার উপস্থিতি কম ছিল। কিন্তু গত ২১ মে মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপেও ‘ভোটার খরা’ দেখা গেল মারাত্মকভাবে। দৈনিক পূর্বদেশসহ দেশের সকল গণমাধ্যমে সচিত্র যে প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে, তাতে রীতিমত আশঙ্কার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, আগামীতে তৃতীয় দফার নির্বাচনে ভোটার পাওয়া যাবে কিনা! নির্বাচন কমিশন প্রথম দফায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও কৃষকের উপর দায় ছাপিয়ে পার পেলেও দ্বিতীয় দফায় প্রকৃত কারণ উদঘাটন করতে পেরেছে বলে আমাদের ধারণা। গত বুধবার দৈনিক পূর্বদেশের প্রতিবেদনে হাটহাজারীর একটি কেন্দ্রের সচিত্র ছবিসহ উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, দুপুর নাগাদ ভোটার শূন্য ভোট কেন্দ্রে অলস সময়ের সদ্ব্যবহার করেছে ভোটকেন্দ্রে দায়িত্বরত পুলিশ-আনসার, এজেন্টরা ছবি তোলে, আড্ডা দিয়ে সময় কাটাচ্ছেন। চট্টগ্রামের সংবাদপত্রে মঙ্গলবারের ভোটার উপস্থিতির উপর অনুমান করে বলা হয়েছে, ২৬ বা ২৭ শতাংশের উপর ভোট পড়েনি। নির্ধারিত ১৫৬ উপজেলায় ভোট শেষে ঢাকায় খোদ প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, ভোটার উপস্থিতির হার ৩০ শতাংশের কিছু বেশি হতে পারে। ৮ মে বুধবার উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপে ভোট পড়েছিল ৩৬ শতাংশের সামান্য বেশি। আমাদের দেশে ভোটের ইতিহাস বলে স্থানীয় সরকার নির্বাচন বরাবরই উৎসমুখর। দীর্ঘ একটি আমেজের মধ্যে চলে নির্বাচন। কারণ নির্বাচনী প্রচারণার মাধ্যমে ভোটারদের সাথে সম্ভাব্য প্রার্থীদের যোগাযোগ, সমর্থকদের নিয়ে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে ভোট চাওয়ার মধ্যেই এ আমেজ ও উৎসব চলতে থাকে। ভোটের পরিসংখ্যানও এই বাস্তবতা তুলিয়া ধরে। বর্তমান সরকার প্রথমবার ক্ষমতায় আমার পর থেকে দেশে এ পর্যন্ত তিনবার উপজেলা নির্বাচন হয়েছে। এর আগে হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদের শাসনামলে দুইবার নির্বাচর হয়েছিল। চারটিতেই ভোটের হার ছিল উল্লেখযোগ্য। প্রথম দুই নির্বাচনের ভোটের সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান না মিললেও ২০০৯ ও ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় ও চতুর্থ উপজেলা নির্বাচনে যথাক্রমে ৬১ ও ৬৭ শতাংশের অধিক ভোট পড়েছিল। ২০১৯ সালের পঞ্চম উপজেলা নির্বাচনে ৪১ শতাংশের কিছু অধিক ভোট পড়ে। যার মাধ্যমে স্পষ্ট হয় মূলত ওই উপজেলা নির্বাচনেই ভোটার খরা শুরু। এবার সেই খরা সম্ভবত রীতিমতো রেকর্ড গড়তে যাচ্ছে।
ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার কারণ হিসেবে এবার নির্বাচন কমিশন দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির বর্জনকে দায়ী করেছেন। অন্তত বিএনপি ও তার রাজনৈতিক মিত্রদের বর্জনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত গত উপজেলা নির্বাচনের ভোটের হার দেখলে এই বক্তব্য উড়িয়ে দেয়ার কোন সুযোগ নেই। তবে সমস্যাটি আরো গভীর বলে আমাদের ধারণা। ক্ষমতাসীন দল মনোনীত বা সমর্থিত প্রার্থীদের সুবিধা দিতে গিয়ে বিশেষত ২০১৪ সাল হতে জাতীয় ও স্থানীয় সকল নির্বাচনকে যেভাবে প্রায় একতরফা নির্বাচনে পরিণত করা হয়েছে, এর নেতিবাচক প্রভাব ভোটারদের মধ্যে পড়ছে-এটিই স্বাভাবিক। সন্দেহ নেই, এই ক্ষেত্রে সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের দায় সর্বাধিক। তবে ইসি বা নির্বাচন কমিশন এই ক্ষেত্রে দায় এড়াতে পারে না। কারণ তারা নিজেদের সাংবিধানিক যে ক্ষমতা তা যথাযথভাবে প্রয়োগ করে নি। যেমনটি এবার চলমান উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপির প্রভাব বিস্তারের বিপক্ষে সরকার ও সরকারি দল দৃশ্যমান অবস্থান নিয়েছে, তাতে নির্বাচন কমিশন কঠোর ও দৃঢ়তা দেখালে নির্বাচনে মাঠ প্রশাসনকে নিরপেক্ষ রাখা অনেকাংশেই সহজ হতো, সুষ্ঠু নির্বাচন এবং ভোটারদের আশ্বস্ত করার ক্ষেত্রে যার ভূমিকা প্রধান। কিন্তু দুই দফার নির্বাচন দেখে কেউ আশ্বস্ত হতে পারছেনা, আসলে নিজের বোটটি ঠিকমত দিতে পারবে কিনা! আরো একটি বিষয়, ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থীদের অধিকাংশই সরকারি দলের লোকজন বা সমর্থিত। এর মধ্যে বিরোধী দল বা নিজেদের মিত্রদের মধ্য থেকেও কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে ভোটের মাঠে তাকে সহ্য করা হচ্ছে না। নানাভাবে নাজেহাল করার অভিযোগ সংবাদপত্রে আসছে। যেমনটি আমরা দেখতে পায় গত মঙ্গলবারের ভোটে। বিভিন্ন স্থানে প্রায় সকল প্রকার অনিয়ম এবং প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থীর সমর্থকদের সাথে সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এমনকি হাটহাজারীতে গোলাগুলি করে দুজনের আহত হওয়ার ঘটনা, কক্সবাজারের নবগঠিত ঈদগাঁও উপজেলায় এক যুবককে ছুরিকাঘাতে হত্যার ঘটনাও ঘটেছে।
বাস্তবতা হচ্ছে, সংবিধান ও গণতন্ত্র রক্ষায় নির্বাচনে ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। তবে এক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থীদের সমঅধিকারসহ সকল দল ও মতের মানুষের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অংশগ্রহণের সুযোগও নিশ্চিত করতে হবে। আমরা মনে করি, আগামীু ২৯ মে তৃতীয় দফায় নির্বাচনে ইসি আরো কঠোর হলে, ভোটারদের ভোট প্রয়োগের বিষয়টি আস্থায আনতে পারলে ভোটার খরা কিছুটা হলেও কমবে-এমনটি প্রত্যাশা দেশবাসীর।