তিস্তা প্রকল্পে ভারতকেই চাই

11

পূর্বদেশ ডেস্ক

বাংলাদেশ অংশে তিস্তা নদীর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার মহাপরিকল্পনার প্রকল্প ভারতেরই করা উচিত বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল রোববার গণভবনে চীন সফরের নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নে তিনি কথা বলেন তিনি। শেখ হাসিনা বলেন, তিস্তা প্রজেক্টটা আমাদের করতে হবে। চীনও আমাদের কাছে কিছু অফার দিয়েছিল। তাদের ফিজিলিবিটি স্টাডি করেছে। ইন্ডিয়াও আমাদের কাছে অফার দিয়েছে। ইন্ডিয়াও ফিজিবিলিটি স্টাডি করবে। এটা করার পরে, যেটা আমাদের জন্য যুক্তিযুক্ত হবে, আমরা সেটা নেব।
পরে অবশ্য শেখ হাসিনা ভারতের প্রস্তাবের পক্ষে থাকার কথা তুলে ধরেন। বলেন, চীন তো রেডি, কিন্তু আমি চাচ্ছি যে এটা ইন্ডিয়া করে দিক, এই প্রজেক্টটা করলে এই প্রজেক্টটার জন্য যা দরকার, ইন্ডিয়া দিতেই থাকবে। ঠিক আছে? যা সাফ সাফ কথা, রাখা ঢাকা নাই।
ভারতের প্রস্তাবকে অগ্রাধিকার দেওয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কারণ তিস্তার পানিটা ইন্ডিয়াই আটকে রেখেছে, কাজেই তাদের কাছ থেকে আমাদের যদি আদায় করতে হয়, প্রজেক্টের কাজ তাদেরই করা উচিত। তারা প্রজেক্ট করে আমাদের যা প্রয়োজন তারা দেবে। এটা তো একটা ডিপ্লোমেসি। এখানে আর কোনো দ্বিধা থাকার তো কথা নয়।
তিস্তা প্রকল্প বহু যুগের প্রকল্প জানিয়ে তিনি বলেন, আমার যতটুকু মনে পড়ে, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে (১৯৫৪ সালে) ছিল, আওয়ামী লীগের ইশতেহারে অনেকবার ছিল।
এর আগে চীনও এই প্রকল্পে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। তারাও বাংলাদেশকে একটি প্রস্তাব দিয়েছে
দুর্নীতির বিরুদ্ধে চলমান অভিযান তাঁর সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করবে না জানিয়ে দেশ থেকে দুর্নীতি নির্মূলে তাঁর ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণের প্রতিশ্রুতিও পুনর্ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, যারা অপরাধ করছে বা দুর্নীতিতে জড়াচ্ছে সে আপন কিংবা পর বিবেচনা না করে তাদের ধরতে হবে সেটা মনে করি না। তাদের ছাড়ব না। এক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হবে না।
তিনি বলেন, আমি কঠোর হয়েছি বলেই কিন্তু ধরা পড়েছে, এটা মাথায় রাখতে হবে। এর আগে কখনও কেউ এভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান করেনি। আমি তো বলেছি আমার ‘জিরো টলারেন্স’। এর আগে জঙ্গিবাদ নির্মূল করার কথা ছিল সেটাও আমরা করেছি। কারণ এটা তো চট করে হবে না, দীর্ঘদিনের সমস্যা। এই সমস্ত জঞ্জাল দূর করতে হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কাজেই জঙ্গিবাদ যখন আমরা নিয়ন্ত্রন করতে পারলাম আর দুর্নীতি নিয়ে যেহেতু আমার ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা করাই আছে সেটা আমি করছি।
পিএসসির এক গাড়িচালক কিভাবে অঢেল সম্পদের মালিক হলো? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার বাসার একজন পিয়ন ছিল,সেও নাকি ৪০০ কোটি টাকার মালিক! হেলিকপ্টার ছাড়া নাকি চলে না। পরে তাকে ধরা হয়েছে। খোঁজ-খবর নেওয়া হয়েছে। ড্রাইভার কীভাবে এত কোটি কোটি টাকার মালিক হলো, সেটা কীভাবে বলবো? তাদের অপকর্ম আমরা ধরছি বলেই তো এখন জানতে পারছেন। এতদিন তো আপনারা জানতে পারেননি।
চীন সফর নিয়ে সংবাদ সম্মেলন হলেও দুর্নীতি, বিএসএস-এর প্রশ্নপত্র ফাঁস, কোটা আন্দোলন থেকে শিক্ষকদের আন্দোলন, তিস্তা প্রকল্প, সাংবাদিকদের ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়ন এবং সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর হামলাসহ বিভিন্ন সমসাময়িক বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের বিস্তারিত উত্তর দেন প্রধানমন্ত্রী।
সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সংসদ উপনেতা বেগম মতিয়া চৌধুরী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, তথ্য ও স¤প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত এবং বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী ড. আহসানুল ইসলাম টিটু, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম ও ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব মো. নাঈমুল ইসলাম খান সংবাদ সম্মেলনটি সঞ্চালনা করেন।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি নিয়ে আদালত থেকে সমাধান না আসা পর্যন্ত তাদের কিছু করার নেই। কোটা নিয়ে আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে সংবিধান অনুযায়ী দাঁড়ানোর কোন অধিকার সরকারের নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত আদালত থেকে সমাধান না আসবে ততক্ষণ আমাদের কিছু করার থাকে না। আদালতের রায়ের বিষয়, সেটার সমাধান সেখানেই হবে। এ বাস্তবতা তাদের (কোটা বিরোধী আন্দোলনকারী) মানতে হবে। না মানলে কিছুই করার নেই।
সরকার প্রধান বলেন, রাজপথে আন্দোলন করছে, তবে কোনও ধ্বংসাত্মক কাজ করতে পারবে না। তারা শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করে যাচ্ছে, কেউ কিছু বলছে না। তবে এর বাইরে কিছু করলে কিংবা পুলিশের গায়ে হাত দিলে, গাড়ি ভাংচুর করলে বা তারা যদি অন্যকিছু করতে যায়, তখন তো আইন আপন গতিতে চলবে।
চলমান কোটা বিরোধী আন্দোলন নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরো বলেন, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে না, তাহলে কী রাজাকারের নাতি-পুতিরা পাবে? আমার প্রশ্ন দেশবাসীর কাছে।
তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের অপরাধটা কী? তারা নিজের জীবন বাজি রেখে, সংসারসহ সব ফেলে মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে যুদ্ধ করে এদেশের বিজয় এনেছে। তাঁরা (মুক্তিযোদ্ধা) বিজয় এনে দিয়েছিল বলেই সবাই আজ উচ্চপদে আসীন। নইলে তো পাকিস্তানের বুটের তলায় থাকতে হতো।
প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন রেখে বলেন, এখন কী অবস্থা হয়েছে? বেশিদূর যাওয়া লাগবে না। সর্বশেষ বিসিএসে দেখেন, ফরেন সার্ভিসে দুই জন মেয়ে নিয়োগ পেয়েছে, পুলিশে চার জন। নারী অধিকারের কথা বলি। সব ধরনের ব্যবস্থা করছি। বঙ্গবন্ধু নারীদের জন্য ১০ শতাংশ ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা রেখেছিলেন। আমরা বলেছিলাম যে, কোটা পূর্ণ হবে না, যারা তালিকায় পরবর্তীতে থাকবে তাদের সেখানে নিয়োগ দেওয়া হবে। সেটাই আমরা শুরু করে দিয়েছিলাম। তারপরে যখন আন্দোলন শুরু হল সব বন্ধ করলাম।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেই সময় (২০১৮) যারা আন্দোলন করেছিল, সেখানে নারীও ছিল। যারা বলেছিল নারী কোটা চায় না, মেধা দিয়ে চাকরি করব, সে কি চাকরি পেয়েছে? সে কি বিসিএস পরীক্ষা দিয়েছে? বিসিএসের প্রিলিমিনারিতে পাস করেছে? তারা যদি এই বড় কথাগুলো না বলত, কোথাও না কোথাও চাকরি করত। দেশের সব এলাকা সমানভাবে উন্নত না।
কোটা বাতিলে মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষুব্ধ হয়ে মামলা করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মামলার পরে কোর্ট যখন কোনও রায় দেয়, সে বিষয়ে নির্বাহী বিভাগের কিছু করার নেই। সেখানে সমাধান করতে হবে। যারা আন্দোলন করছে, তারাতো আইন মানবেন না, আদালত মানবেন না, সংবিধান কি তারা চিনবেন না। ভালো পড়ালেখা করে, ভালো নম্বর পাচ্ছে। কিন্তু ভবিষ্যতে এরা নেতৃত্ব দেবে, তাদের তো ধারণাগুলো দরকার, জানা উচিত। রাষ্ট্র পরিচালনায় কী ধরনের কাজ হয়, সেটা কি তাদের জানা আছে? ধারণা তো দেখি না। তিনি আরও বলেন, যখন আদালতে চলে গেল, সেটার সমাধান সেখানেই হবে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আন্দোলন বিষয়ে অপর এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁদের একটি দাবিনামা আমার কাছে এসেছে। সেখানেও তাদের ভ্রান্ত ধারণা আছে। সেগুলো আমার মার্ক করা আছে। এর মধ্যে তুলতে চাই না। আমার কাছে লেখা আছে।
তিনি বলেন, পেনশনটা দেয়া হচ্ছে যারা আমাদের ট্যাক্স দেয়, তাদের টাকা থেকেই। আমরা সর্বজনীন পেনশন স্কিম করতে যাচ্ছি সবার জন্য। তাদের (বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষকদের) অনেকগুলো ভুল ধারণা। এত বিস্তারিত বলতে গেলে অনেক সময় লাগবে। পেনশন নিয়ে তাদের ধারণা এত বিভ্রান্তিকর! এর মধ্যে দুই একটা জিনিস আছে, সেটা ঠিক করে দেয়া হয়েছে। কোনও ব্যাপার না। আর কয়েকটি বিষয় আমি দেখে রেখেছি। মার্ক করে রেখেছি। সেগুলো আমরা দেবো।
শেখ হাসিনা সকল গণমাধ্যমে সাংবাদিকদের ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়ন না করা এবং ১০ম ওয়েজ বোর্ড প্রদানের বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, সাংবাদিকদের এই সমস্যা জানি বলেই তাদের জন্য পেনশন স্কিম দিয়েছি। সাংবাদিকদের আজ কারও চাকরি না থাকলে কাল কিছুই করার নেই। কোথায় যাবে তারা, তার পরিবার কোথায় যাবে? সেজন্যই পেনশন স্কিম এমনভাবে করা হয়েছে, বিপদের সময় যাতে হেল্প হয়। আপনারা সবাই এর (পেনশন স্কিম) সঙ্গে যুক্ত হন। আপনাদের পরিবারের সদস্যদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে পারবেন। তবে, ওয়েজ বোর্ড নিয়ে আমরা আলোচনা করবো।
এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা সরকারি চাকরি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত চক্রের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। বিসিএসের ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে যারা উত্তীর্ণ হয়ে চাকরি করছেন, খুঁজে বের করা গেলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে কোনো পরীক্ষা নয়, হাওয়া ভবন থেকে পাঠানো তালিকায় বিসিএসে চাকরি হতো । তিনি বলেন, ২৪তম বিসিএস পরীক্ষা হয়েছিল ২০০২ সালে। বিএনপির আমলে সেই সময়ে যত পরীক্ষা হতো, চাকরি হতো, সব হাওয়া ভবন থেকে তালিকা পাঠানো হতো। সেই তালিকা অনুযায়ী চাকরি হতো।
চীন সফরে বাংলাদেশ কিছুই পায়নি কোনো কোনো মহলের এমন সমালোচনা সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ কী পেল তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেন।
তিনি বলেন, বেইজিংয়ে অবস্থানকালে তিনি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং গ্রেট হল অব দ্য পিপলে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংয়ের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ ও চীন শক্তিশালী উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতার দিকে নজর দিয়ে বুধবার সকালে প্রতিনিধি পর্যায়ের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পর উভয় দেশ ২১টি সহযোগিতার নথিতে স্বাক্ষর করে এবং নবায়ন করেছে, যার বেশিরভাগই এমওইউ। পাশাপাশি সাতটি প্রকল্পেরও ঘোষণা দেয়।
তিনি বলেন, শি জিনপিংয়ের সাথে তাঁর দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে চীন বাংলাদেশকে ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দিতে সম্মত হয়েছে। এর মধ্যে কিছু থাকবে অনুদান। কিছু হবে সুদমুক্ত ঋণ।
এর বাইরে নবম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু নির্মাণেও তারা সম্মত হয়েছে বলেও জানান এবং এগুলো কি কিছুই নয়? সে প্রশ্নও তোলেন তিনি।