তাপ প্রবাহের অন্যতম কারণ

10

সাম্প্রতিক তাপপ্রবাহে দেশের মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল। তখন জনগণ বুঝতে সক্ষম হয়েছিল তার কারণ সমূহ। তখন অনেক অতি উৎসাহীরা দেশে লক্ষাধিক বৃক্ষ রোপণের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিল। আবার অতি উৎসাহী কেউ কেউ বা কোন কোন ছাত্র সংগঠন কোথাও কোথাও বৃক্ষ রোপণ করে। হাস্যস্পদ হলো যে, তারা জানে না কখন, বৃক্ষ রোপণ করতে হবে। তদুপরি বৃক্ষ রোপণের স্থান নির্বাচনও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম কারণ হচ্ছে উষ্ণতা বৃদ্ধি। জৈব জ্বালানীর ব্যবহার বৃদ্ধি, পাহাড়, জঙ্গল, জলাশয়, ধ্বংসও এর অন্যতম কারণ। বলা যায় মানব জাতি তাদের সুখ ও আহ্লাদের কারণে প্রকৃতিকে ধ্বংস করে চলছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিতীয় রাজধানী চট্টগ্রামের কথাই বলা যাক। এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে, বিগত ৩০ বছরে চট্টগ্রাম মহানগরীতে সবুজায়ন কমেছে ২৯.৮২ শতাংশ। পুকুর জলাশয় কমেছে ৮.৩৭ শতাংশ। নগরে জনবসতি বেড়েছে ৪৫ শতাংশ। এখানে উল্লেখযোগ্য যে চট্টগ্রাম মহানরগীর জাকির হোসেন রোডের উভয় পাশে পাহাড় ছিল, সার্সন রোড, খুলশী, টাইগারপাস এলাকায় ছিল পাহাড় ও ঘন বনবনানী। ৮০ ও ৯০ এর দশকে এ সকল এলাকায় মানুষ দিনের বেলায় চলাচল করতে ভয় পেত। নাসিরাবাদ এলাকায় ছিল, বায়েজিদ বোস্তামী এলাকায় ছিল পাহাড় ও বন বনানী। এ সকল এলাকায় গড়ে উঠেছে আবাসিক এলাকা। নাসিরাবাদ প্রপার্টিজ, দক্ষিণ খুলশীর পাহাড়িকা আবাসিক এলাকা সিটি কর্পোরেশন আবাসিক এলাকা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ভিআইপি আবাসিক এলাকা ইত্যাদির সবগুলো হয়েছে পাহাড় বন বনানী ধ্বংস করে। এছাড়াও চট্টগ্রাম মহানগরীতে পুকুর দীঘি, জলাশয়, খেলার মাঠ, কৃষিজমি ভরাট ও দখল করে পড়ে উঠেছে আবাসিক, বাণিজ্যিক ও শিল্প কলকারখানা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়নরমেন্ট সায়েন্সের ২০২২ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে, নগরীতে সবুজায়ন যেমন কমেছে তেমনি জলাশয়ও কমে এসেছে। উক্ত প্রতিবেদনে দেখা যায় যে ১৯৯০ সালে নগরে ১৯ শতাংশ এলাকায় বসতি থাকলেও এখন তা ৪৫ শতাংশ হয়েছে। স্পারসো বাংলাদেশের ভৌগলিক পরিবর্তনের বিভন্ন মানচিত্র নিয়ে গবেষণা করে থাকে। তারা বলছে উন্নয়ন ও সবুজায়ন সাংঘর্ষিক। তারপরও উন্নয়ন চলমান রাখতে হবে। এই উন্নয়নের কারণেই দেশে সবুজায়নের পরিমাণ কমে আসছে। এ চিত্র সারা বিশ্বে। কোথাও কম আবার কোথাও বেশি। উন্নত দেশগুলি পরিকল্পিতভাবে উন্নয়ন করছে। তা আমাদের ক্ষেত্রে নেই ফলে বাড়ছে উষ্ণতা।
চট্টগ্রাম মহানগরে আবাসিক ও বাণিজ্যিক স্থাপনের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। পতিত জমি সবুজাচ্ছাদিত ভূমি ও জলাশয় ভরাটের হার প্রতিদিন বাড়ছে। শহরমুখো মানুষের চাপবৃদ্ধি পাওয়ায় আবাসনের চাহিদা বৃদ্ধিতে বলি হচ্ছে পাহাড় জলাশয় ও কৃষিজমি।
আজ থেকে ৪০ বছর আগে চট্টগ্রাম মহানগরে ৪০টি পাহাড় সাবাড় হয়েছে ১২০টি পাহাড় ও টিলা। একটি সড়ক নির্মাণে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ(সিডিএ) ১৬টি পাহাড় কেটে ফেলেছে। এখানে সিডিএ রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকাপালন করছে। সবচেয়ে বেশি পাহাড় ধ্বংস হয়েছে শুধু মাত্র আবাসিক স্থাপনা তৈরীতে। সিডিএ এর তথ্য অনুযায়ী গত ১৫ বছরে চট্টগ্রাম থেকে হারিয়ে গেছে তিন হাজার পুকুর ও জলাশয়। ২০০৮ সালের তথ্যানুযায়ী চট্টগ্রাম ৫ হাজার ৩১টি পুকুর ছিল। এখন সেখানে মাত্র দুই হাজার পুকুর ও জলাশয় বিদ্যমান।
কোন নগরীতে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ খোলা মাঠ পার্ক উন্মুক্ত স্থান, পুকুর দীঘি জলাশয় থাকা বাঞ্চনীয়। আমাদের শহরগুলোতে তার অর্ধেকের চেয়ে কম আছে। আমাদের শিশুরা খেলার জন্য কোন মাঠ নেই, পার্ক নেই। তাহলে কিভাবে আশা করবো সুস্থ ও সবল নাগরিক গড়ে উঠবে ? যতক্ষণ না পর্যন্ত আমরা আমাদের বসবাসের জন্য পর্যাপ্ত বন বনানী ও জলাশয়, পার্ক, খেলার মাঠ নিশ্চিত করতে না পারি ততক্ষণ পর্যন্ত তাপপ্রবাহ ও উষ্ণতা আমাদের আঘাত করবেই। এ নিয়ে সুশীল সমাজসহ সর্বস্তরের মানুষকে ভাবতে হবে। আমাদের কারণে উষ্ণতা বাড়ছে। আসুন আমরা বেঁচে থাকার জন্য যত্নবান হই।

লেখক : কবি, নিসর্গী ও ব্যাংক নির্বাহী (অব)