ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতা জরুরি

13

বর্ষার আগমনি বার্তার সাথে এডিস মশার তান্ডবের আতঙ্কও আছে। মূলত এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে হালকা, মাঝারি ও ভারি বৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা দেয়। এসময় বৃষ্টির পানিতে নালা নর্দমা, খাল বিল ও বিভিন্ন পরিত্যক্ত পাত্রে পানি জমে থাকে যা দিয়ে ডেঙ্গু মশার উৎপত্ত। এ মশা বৃদ্ধির সাথে সাথে ডেঙ্গু জ্বরও বেড়ে যায়।
আমরা জানি, ডেঙ্গু জ্বর একটি ভাইরাসজনিত জ্বর যা এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। বিশ্বব্যাপী দিনদিন বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব। বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই এখন ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে। দক্ষিণ এশিয়ার ভারত, বাংলাদেশ, মালয়েশিয়াসহ প্রায় সব দেশেই ডেঙ্গুর বিস্তার দেখা যায়। গত বছর বাংলাদেশে প্রায় তিন লাখ মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন এবং মৃত্যুহারও ছিল অনেক বেশি। এ বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও নাজুক। রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ সারাদেশে বেড়ে চলেছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। গত কয়েকদিনে প্রতিদিন গড়ে ৩০ জন করে ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। এর মধ্যে একদিনে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। তাই প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে হাসপাতালগুলো। ডেঙ্গুর মৌসুম শুরু না হলেও এবার বেশ আগেভাগেই রোগীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। গত বছরের তুলনায় এবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার দ্বিগুণ। ২০২৩ সালের প্রথম চার মাস অর্থাৎ এপ্রিল পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয় ১১ জনের। আর এবার মারা গেছেন ২৪ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত চট্টগ্রামে। এ বছর ১৩ মে পর্যন্ত মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন দুই হাজার ৪৯৬ জন। আর মারা গেছেন ২৯ জন। এ বছর হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যাও দ্বিগুণ বেড়েছে। গত বছর প্রথম তিন মাসে হাসপাতালে ভর্তি রোগী ছিল ৮৪৩ জন। এবার প্রথম তিন মাসেই ভর্তি হয়েছে এক হাজার ৭০৫ জন। ২০২৩ সালে দেশের ২৪ বছরের ডেঙ্গুর ইতিহাসের সব রেকর্ড ভেঙে যায়। জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন রোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়। আর মারা যান এক হাজার ৭০৫ জন। ডেঙ্গুর ভয়াবহতার আশঙ্কা করা হচ্ছে এবারো। প্রতিবছরই বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে এবং ক্রমান্বয়ে তা আমাদের জন্য চরম উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে ডেঙ্গুজ্বরের প্রকৃতি, হয়েছে অধিক শক্তিশালী। পূর্বে শুধু বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর বিস্তার দেখা গেলেও এখন প্রায় সারাবছরই মানুষ ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে। এডিস মশার বিস্তারের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে পরিবর্তন। আমরা জানতাম যে এডিস মশা পরিষ্কার পানিতে ডিম পাড়ে। কিন্তু এখন নোনা ও নোংরা পানিতেও পাওয়া যাচ্ছে এডিস মশার লার্ভা। এডিস মশা শুধু দিনে কামড়ায় বলে ধারণা করা হতো অথচ এখন দিনে-রাতে দুই সময়েই কামড়াচ্ছে এডিস মশা। বদলেছে রোগের লক্ষণ, তীব্র জ্বর, মাথাব্যথা, পেটেব্যথা, গায়ের্ যাশ, কিংবা বমির লক্ষণ নেই এখন ডেঙ্গুতে। বরং অল্পজ্বরেই আক্রান্ত হচ্ছে হৃৎপিন্ড, কিডনিসহ শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গসমূহ। রক্তে অঙ্গুচক্রিকার (প্লাটিলেট) সংখ্যা কমে যাওয়ার পাশাপাশি রোগীর দ্রæত শক সিনড্রোমে যাওয়ার আশঙ্কাও বেড়েছে। শনাক্তকরণে বিলম্বের ফলে বাড়ছে মৃত্যুহার। অন্যদিকে শহর ছাড়িয়ে গ্রামাঞ্চলেও এখন মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে ডেঙ্গুতে, পাওয়া যাচ্ছে এডিসের লার্ভা, কিন্তু প্রতিরোধে নেই তেমন কোনো পদক্ষেপ। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। বৃষ্টির পানি পরিত্যক্ত টায়ার, ডাব/ নারিকেলের খোসা, প্লাস্টিকের বোতলসহ অন্যান্য পাত্রে জমে থেকে হতে পারে এডিস মশার উৎপত্তিস্থল। এ ধরনের পাত্রে তিন দিনের বেশি সময় পানি জমতে দেওয়া যাবে না, ফেলে দিতে হবে দ্রুত। বাসা কিংবা অফিসে ফুলের টব, এসি ও ফ্রিজের নিচসহ যে কোনো স্থানের আবদ্ধ পানি নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। বাড়ি, অফিস-আদালত ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের আশপাশে ঝোপ-ঝাড় নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে ও মশা নিধনকারী ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে। প্রয়োজনে বিøচিং পাউডার ছিটাতে হবে। পূর্ণাঙ্গ এডিস মশার সম্ভাব্য লুকানোর স্থান যেমন পর্দার আড়ালে, আসবাবপত্রের পেছনে মশা মারার ওষুধ স্প্রে করা যেতে পারে। শরীর যথাসম্ভব ফুল হাতা জামা, ফুল প্যান্ট ইত্যাদি পোশাক দ্বারা আবৃত রাখতে হবে এবং শরীরের অনাবৃত স্থানে মশা নিবারক ক্রিম ব্যবহার করতে হবে। ডেঙ্গু থেকে সুরক্ষায় শিশু, বৃদ্ধ ও গর্ভবতী নারীদের বিশেষ যত্ন নিয়ে নিরাপদে রাখতে হবে। দিনে বা রাতে সবসময় ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করতে হবে। জ্বরে আক্রান্ত হলে ডেঙ্গু শনাক্তকরণ পরীক্ষা করতে হবে ও চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবনসহ অন্য নির্দেশনা মেনে চলতে হবে।