টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট বিশ্বকাপ ও আগামী দিনের প্রত্যাশা

2

প্রদীপ ভট্টাচার্য্য

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের যা কিছুর উজ্জ্বল অর্জন তার মধ্যে শীর্ষস্থানে রয়েছে ক্রিকেট। ১৯৯৭ সালে আকরাম-বুলবুলদের হাত ধরে আইসিসি ট্রফি জিতে যে স্বপ্নের সূচনা হয়েছিল তা আজ হাঁটি হাঁটি পা-পা করে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ অর্জন টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তির আসীন টাইগাররা। পর্যায়ক্রমে ক্রিকেটের প্রতি বাঙালিদের সে স্বপ্ন ক্রমে ক্রমে বাস্তবের পথে হেঁটে ক্রিকেট ইতিহাসে ইংল্যান্ড, ভারত, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও শ্রীলঙ্কা এর মতো ক্রিকেটের পরাশক্তিকে বিভিন্ন সিরিজ বা বিশ্বকাপে বধ করে, বাংলাদেশ ক্রিকেট দল বসেছে বিশ্ব ক্রিকেটের মর্যাদার আসনে। তার ধারাবাহিকতায় এবারের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট বিশ্বকাপে অংশ নেয় বাংলাদেশ ক্রিকেটের জাতীয় দল। ভালো কিছু করার প্রত্যায় নিয়ে অংশগ্রহণ করে গত ২রা জুন ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে শুরু হওয়া টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ২০ টি দলের প্রাণবন্ত লড়াইয়ে। গ্রুপ ফরম্যাট বা বিন্যাস অনুযায়ী ডি গ্রæপে বাংলাদেশ প্রতিদ্ব›দ্বী দেশগুলো হলো দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কা, নেদারল্যান্ডস ও নেপাল। বাংলাদেশ গ্রæপ পর্ব পার হওয়ার যে স্বপ্ন নিয়ে বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছিল তা দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে ৬ রানে পরাজিত হলেও বাকি ৩ দল শ্রীলঙ্কা, নেদারল্যান্ডস ও নেপাল এর সাথে জয় নিয়ে সুপার এইটে খেলার গৌরব অর্জন করে। কিন্তু দ্বিতীয় পর্বের রাউন্ডে লজ্জাজনক ভাবে হারে অষ্ট্রেলিয়া ও ভারতের কাছে। তারপরেও আফগানরা অষ্ট্রেলিয়াকে ২১ রানে হারানোর পর গ্রুপ পর্ব থেকে পয়েন্ট সমীকরণ হিসাবে সেমিফাইনালে যাবার যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল তা-ও কাজে লাগাতে ব্যর্থ হলো, ব্যাটসম্যানদের হতাশা জনক পারফরমের কারণে। যা এক রকম অসহায় আত্মসমর্পণের মতোই।
সেদিন বুকভরা আশা নিয়ে নানান কাজ ফেলে দলবেঁধে টিভির পর্দার সামনে বসে ছিলেন পরিবার পরিজন, বন্ধু বান্ধব ও ক্রিকেটপ্রেমী ভক্তরা। মাঠে আফগানদের কাছে টস হেরে ফিল্ডিংয়ে নেমে বোলার রিয়াদ, মুস্তাফিজ ও তাসকিনের বোলিং নৈপুণ্যে ২০ ওভারে ৫ উইকেটে ১১৫ রানের মধ্যে আফগানদের আটকে ফেলে বাংলাদেশ। যার কারণে সেমিফাইনালে যাওয়ার স্বপ্ন জেগেছিল বাংলাদেশের। টাইগারদের সামনে সমীকরণ ছিল ১২.১ ওভারে ১১৬ রানের টার্গেট পার করার। যদিও ধীরগতির এই পিচে সমীকরণটা একটু কঠিন হলেও শুরুটা ছিল চমৎকার।
প্রথম ওভারে ১৩ রান নিয়ে। কিন্তু ব্যাটারদের চরম ব্যর্থতা, খেলার ছন্দ পতন ও দূরদর্শিতার অভাবে সেমিফাইনাল যাওয়া স্বপ্ন স্বপ্নেই থাকলো। তারপরেও দর্শকেরা প্রত্যাশা নিয়ে বসে ছিল পূর্ণ ২০ ওভারের খেলায় আনুষ্ঠানিক জয়ের আশা নিয়ে। সেখানেও ব্যর্থ হলো বাংলার টায়গাররা। এত কম সংখ্যক রান তাড়া করতে নেমে ১৭.৫ ওভারে ১০৫ রানেই থেমে গেল টাইগারদের ইনিংস। সহজ সুযোগ পেয়েও পরাজয় বরণ করলো লাল সবুজের দল। আফগানদের কাছে ডিএলএস মেথডে হারে ৮ রানে।
এতে ক্রিকেটের সাথে যাঁরা সংশ্লিষ্ট এবং ক্রিকেটের বাইরের জগতের সবাই চিন্তিত ও হতাশায় ডুবলো। সমালোচনা ও ক্ষোভের ঝড় উঠলো দেশে ও দেশের বাইরে। প্রশ্ন তুললো ১১ জনের টিমে লিটন দাস ৫৪ তাওহিদ হৃদয় ১৪ ও সৌম্য সরকার ১০ রান ছাড়া অন্যরা কেন দুই এর অংকে পৌঁছাতে না-পারা নিয়ে। ক্ষোভ বাড়লো অলরাউন্ডার সাকিবসহ তিনজনের শূন্য রানের আউট নিয়ে। যা কোন অবস্থাতেই মানতে নারাজ ক্রিকেট প্রিয় ভক্তরা।
বাংলাদেশ ১৯৯৯ সালে প্রথম ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে অংশ নেওয়ার পর থেকে অনেক আন্তর্জাতিক ও বিশ্বকাপের খেলায় হারজিত থাকলেও এরকম অস্বস্তিতে সময় পার করেনি ক্রিকেট ভক্তরা। এক কথায় ক্রিকেটকে যারা ভালোবাসেন সেই বিরাট জনগোষ্ঠী এত অনিশ্চয়তা, হতাশা, উদ্বেগ ও উৎকন্ঠায় ভোগেননি। এখন ক্রিকেটকে ঘিরে সচেতনতা যেমন বেড়েছে তেমনি তাদের প্রত্যাশাও আকাশচুম্বী নয়। তারা শুধু চাই দেশের প্রতিনিধিরা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট চত্বরে ক্রিকেটের মতো ক্রিকেট খেলার মর্যাদা রাখুক। খেলায় হার-জিততো আছেই।
মাঠের লড়াই শেষে শ্রেয় দলেই জিতবে এটা সবার জানা। কিন্তু বাংলাদেশের এমন লজ্জাজনক পরাজয় ও হতাশাজনক পারফরম্যান্স ক্রিকেটানুরাগীরা মানতে নারাজ। এতে দলের ভেতর যে চরম আতœবিশ্বাসীসের অভাব তা এখন প্রতিয়মান। ম্যাচ ফিনিশিংয়ের দুর্বলতা, খেলোয়াড়দের সার্মথ্য ও লড়াকু মনোভাব কোথাও পরিলক্ষিত হয়নি। যার কারণে অধিনায়ক নাজমুল হাসান শান্ত খেলা শেষে দেশবাসী ও ক্রিকেট ভক্তদের কাছে ক্ষমাও চেয়েছেন। এত কিছুর পরেও অনেকের মতে তবুও গর্বিত বাংলাদেশ। কারণ যেখানে ক্রিকেট দুনিয়ায় শক্তিশালী নিউজিল্যান্ড, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশ সুপার এইটে উঠা সম্ভব হয়নি, সেই হিসাবে বাংলাদেশতো প্রথম বারের মতো বিশ্ব কাপের সুপার এইটে কোয়ালিফাই করেন নাজমুল হোসেন শান্তরা। এছাড়া এবারের বিশ্বকাপে কিঞ্চিত ব্যাক্তিগত অর্জনও আছে বাংলাদেশের। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ইতিহাসে একমাত্র প্রথম বোলার হিসাবে ৫০ উইকেট শিকারের মাইলফলকটি ছুঁলেন বাংলাদেশের অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। ভারত- বাংলাদেশের খেলায় রোহিত শর্মাকে বিদায় করে। তার অন্য অর্জন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শুরু থেকে সবকটি বিশ্বকাপ খেলার সুযোগও পেয়েছেন অভিজ্ঞ সাকিব আল হাসান ও ভারতের অধিনায়ক রোহিত শর্মার। যা এপর্যন্ত এই রেকর্ড আর কারো নেই। তদুপরি টুর্নামেন্টে ব্যাটারদের ক্ষেত্রে কিছু দুর্বলতা থাকলেও পুরো বোলিং বিভাগই দুর্দান্ত করেছে বাংলাদেশের বোলাররা। এলাইত কম অর্জন নয়।
তবে যে কথা বলা উচিত বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের শুরু থেকে অনেকেই আজ অবসরে, বর্তমান টিমের সাথে যুক্ত কিংবা বিভিন্ন কাজে দূর-দুরান্তে থাকলেও তাদের যে যথার্থ উত্তরাধিকার তৈরি করতে পারেনি তা র‍্যাংকিং ও সামর্থ্য বিবেচনায় দুর্বল প্রতিপক্ষ আফগানদের বিরুদ্ধে এ পরাজয়ই একমাত্র প্রমাণ। আমাদের ক্রিকেটের একটি বড় সমস্যা হলো, বোর্ড কর্মকর্তাদের সাথে খেলোয়াড়দের সম্পর্ক সব সময় ভালো থাকে না। তার উপর নানা অব্যবস্থা, অনিয়ম অথবা দুর্নীতির অভিযোগ উঠে, তাহলে একটি সম্ভাবনাময় স্বপ্ন পরিনত হয় দুঃস্বপ্নে। দেশ ও দলকে নিয়ে মানুষের মনে প্রত্যাশা অনেক। মাঠভর্তি দর্শক কিংবা টেলিভিশনের সামনে, হাট বাজারে জড়ো হওয়া ভক্তরা সমর্থন দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে, উৎসাহ দিয়ে দলকে উজ্জীবিত রাখেন। কিন্তু দল যদি ছন্দ হারায়, তাহলে তার প্রভাব ভক্তদের মধ্যেও পরে। তবে মনে রাখতে হবে শত ব্যর্থতার মধ্যেও সফলতার উঁকি দেয়। তাই আগামীতে এগিয়ে যেতে হবে প্রতিকূলতাকে ডিঙিয়ে।
আপ্রাণ চেষ্টা থাকতে হবে বাংলাদেশ ক্রিকেটকে সম্মানের জায়গায় পৌঁছে দিতে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে এখান থেকে মুক্তির স্বাদ মিলতে পারে খেলোয়াড়দের আত্নবিশ্বাসী, সাহস ও সার্মথ্যকে কাজে লাগিয়ে। তাই দীর্ঘমেয়াদি চিন্তাভবনা ও দুরদর্শিতা মাথায় রেখে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) কে আগামী আগস্টে পর্যায়ক্রমে পাকিস্তান ও ভারত সফরে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সকল সফলতা, দুর্বলতা ও ব্যর্থতাকে কাটাচেড়া বিশ্লেষণ করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। কারণ এদেশের ক্রিকেটভক্তরা চায় না আমাদের ক্রিকেট আনন্দের নির্মম কবর। তারা চায় আগামীতে প্রত্যাশার বেলুন উড়ুক, শত সংশয় কাটিয়ে উজ্জীবিত হোক এক ক্রিকেট বাংলাদেশ। আগামী দিনের এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: প্রাবন্ধিক