জাল নোট ঠেকাতে পুলিশের নজরদারি

4

তুষার দেব

এবার কোরবানির পশুর হাটসহ বড় অংকের আর্থিক লেনদেনের জায়গাগুলোতে জাল নোট প্রতিরোধে গোয়েন্দা নজরদারি করছে পুলিশ। পশুর হাটের ভেতরে-বাইরে সাদা পোশাকে সতর্ক রয়েছে পুলিশের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্যরা। জালনোট বাজারজাত করতে গিয়ে ইতিপূর্বে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের সর্বশেষ অবস্থানও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। জামিনে কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়া জাল নোট সংক্রান্ত মামলার আসামিদের গতিবিধির উপর নজর রাখা হচ্ছে। এছাড়া কোরবানির পশুর হাটগুলোতে অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে জালনোট শনাক্তকরণ বুথ স্থাপন করা হয়েছে। নগরীর বড় দুটি পশুর হাটে ‘ক্যাশলেস’ লেনদেনের ব্যবস্থা করেছে সিটি কর্পোরেশন।
পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কোরবানির পশুর হাটকে টার্গেট করে প্রতারক চক্র প্রতিবছর জালনোট বাজারজাত করতে সক্রিয় থাকে। গত ঈদুল ফিতরের আগে র‌্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশের অভিযানে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম মহানগর এলাকায় কয়েক লাখ টাকা মূল্যমানের জাল নোটের একাধিক চালান ধরা পড়ে। এর মধ্যে কুতুবদিয়া থেকে কেবল জাল নোটই নয়, জাল নোট তৈরির কাজে ব্যবহৃত ল্যাপটপ, নোটপ্যাড, পিঙ্ক প্যাড, এলইডি মনিটর, টাকা ছাপানোর প্রিন্টার এবং ফটোকপি মেশিনও জব্দ করা হয়েছিল। কোরবানির ঈদের আগে এখন পর্যন্ত চট্টগ্রাম অঞ্চলের কোথাও জাল নোটের চালান ধরা না পড়লেও প্রতারক চক্র সক্রিয় থাকতে পারে বলে সন্দেহ করছেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা।
নগর পুলিশের কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় পশুর হাটে অন্যান্য অপরাধের পাশাপাশি জাল নোট প্রতিরোধে পুলিশ সক্রিয় রয়েছে উল্লেখ করে পূর্বদেশকে বলেন, সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে। পশুর হাটসহ অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাগুলোতে সাদা পোশাকে পুলিশের গোয়েন্দা সদস্যদের বিশেষ নজরদারি রয়েছে। পাশাপাশি পশুর হাটে জাল নোট শনাক্তকরণ বুথও চালু করা হয়েছে। সবমিলিয়ে পশুর হাটে ক্রেতা-বিক্রেতার জাল নোটে প্রতারিত হওয়ার ঝুঁকি আগের তুলনায় কমেছে। পুলিশের সক্রিয় নজরদারির কারণে পশুর হাটের বাইরেও প্রতারক চক্রের লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হয়েছে। এরপরও সকলকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে।
এদিকে জেলা শহর উপজেলা সদর পর্যন্ত অনুমোদিত সব হাটে পশু ব্যবসায়ীদের বিনা খরচে নোট যাচাই সংক্রান্ত সেবা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জারি করা এক বিজ্ঞপ্তিতে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা দিয়ে যেসব জেলায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অফিস রয়েছে সেখানে সংশ্লিষ্ট সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার অনুমোদিত পশুর হাটগুলোতে ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট অফিসের নেতৃত্বে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়ার জন্য তাদের আঞ্চলিক কার্যালয় বা প্রধান শাখাগুলোকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অফিস নেই এমন জেলাগুলোর সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ও থানা- উপজেলার অনুমোদিত পশুর হাটে বিভিন্ন ব্যাংকের এ সংক্রান্ত দায়িত্ব বন্টনের জন্য সোনালী ব্যাংকের ‘চেস্ট’ শাখাগুলোকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। পশুর হাটের বুথে ব্যাংকের নাম ও তার সঙ্গে ‘জাল নোট শনাক্তকরণ বুথ’ কথাটি উল্লেখ করে সেখানে নোট কাউন্টিং মেশিনের সাহায্যে নগদ টাকা গণনার সুবিধা দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে। এ জন্য প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট সিটি কর্পোরেশন, জেলা মিউনিসিপ্যালিটি ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার বা সংশ্লিষ্ট পৌরসভা কর্তৃপক্ষ এবং সার্বিক নিরাপত্তার জন্য পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব ও আনসার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করে নোট যাচাইয়ের সময় কোনও জালনোট ধরা পড়লে জাল নোট নীতির নির্দেশনা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
এদিকে জাল নোটের বিস্তার ঠেকাতে নানামুখী পদক্ষেপের কথা বলা হলেও এ সংক্রান্ত মামলাগুলোর নিষ্পত্তির হার মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়। মামলা নিষ্পত্তিতে হতাশাজনক এই চিত্র প্রতারক চক্রের অপতৎপরতা নির্মূল না হওয়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৯৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত জালনোট সংক্রান্ত মোট মামলা হয়েছে নয় হাজার পাঁচশ’ ৬৮টি। এর বিপরীতে সর্বশেষ ১৭ বছরে আদালতে নিষ্পত্তি হয়েছে দুই হাজার একশ’ ৭৪টি মামলা। আবার বেশিরভাগ মামলাতেই অভিযুক্তরা আদালতে বেকসুর খালাস পেয়েছেন। তদন্তে দুর্বলতা ও উপযুক্ত সাক্ষীর অভাবেই অভিযুক্তরা মামলা থেকে রেহাই পেয়ে যাচ্ছেন। আসামি শনাক্ত করতে না পারায় অনেক মামলা অভিযোগ গঠনের আগেই খারিজ করে দিচ্ছেন আদালত। এসব কারণেই জাল নোট কারবারি চক্রের মূলোৎপাটন যেমন সম্ভব হচ্ছে না, তেমনি রোধ করা যাচ্ছে না জাল নোটের বিস্তার। শাস্তি নিশ্চিত না হওয়ায় গ্রেপ্তারকৃতরা জামিনে বেরিয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে একই অপরাধ সংঘটিত করছে। জালনোটের বিস্তার রোধে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল পক্ষগুলোর ধারাবাহিক ব্যর্থতার নেপথ্য কারণ অনুসন্ধানে এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
জাল নোটের মামলা নিষ্পত্তির বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সরকারি-বেসরকারি একাধিক ব্যাংকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা আলাপকালে জানান, রাষ্ট্রের সাথে প্রতারণার মত স্পর্শকাতর বিবেচনায় নিয়ে জালনোট সংক্রান্ত মামলাগুলোও দ্রæতবিচার আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ওই আইনেই জালনোটের মামলাগুলো নিষ্পত্তি করতে হবে। পাশাপাশি সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের আরও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। উপজেলা পর্যায় থেকে শুরু করে বিভাগীয় শহর পর্যন্ত সর্বস্তরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের তৎপরতা জোরদার করতে হবে। একই সঙ্গে ব্যাংকসহ আর্থিক লেনদেনের সংশ্লিষ্ট পয়েন্টগুলোতে উন্নত ও সর্বাধুনিক জাল নোট শনাক্তকরণ মেশিন সরবরাহ করতে হবে। যাতে করে ব্যাংকের মাধ্যমে জালনোটের প্রবাহ বৃদ্ধি করা হলেও গণনায় তা ধরা পড়ে।