জাতীয় সংগীতসহ স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে অহেতুক বিতর্ক নয়

2

মিঞা জামশেদ উদ্দীন

ঢাকার বন্ধু গীতিকার ও বিনোদন সাংবাদিক আশিক বন্ধু উদ্বেগের সাথে জানালো, সাম্প্রতিক সময়ে দেশে নিত্যপণ্য-সামগ্রীর দাম অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে, আজ একদর কাল আরেক দর। যা কিনা ঘণ্টায় ঘণ্টায় পাগল ঘোড়ার মতো ধাবমান- বাজারে সাধারণ মানের চাউল যেখানে কেজি ৬০-৬২টাকা ছিল, এখন তা বেড়ে ৮০-৮২ টাকা। এভাবে প্রতিটি জিনিসের দাম বেড়ে গেছে। পেঁয়াজ বিক্রয় করা হচ্ছে কেজি ১২০-২৩০টাকা। কাঁচা মরিচের বিষয়ে বলতেই নারাজ। ২০টাকা মরিচ দিতে বললে, দোকানদার ২০ টাকার মরিচ নেই বলে জানিয়ে দেয়; সে বিক্রেতার একথা শোনে রীতিমতো হতভম্ব হয়ে যায়। এ তরুণ বিনোদন সাংবাদিক ঢাকার মগবাজার এলাকায় থাকেন এবং পাশাপাশি মিউজিক লাইনে কাজ করেন- যেমন, নিজেই গীতিকার ও সুরকার। আবার মিউজিকসহ কণ্ঠশিল্পী সিলেকশন করা এবং স্টুডিও কন্ট্রাক করা। যাক, কোনোভাবেই জীবন-জীবিকা কাটছে তার। পাশাপাশি ছাত্র-জনতার আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেন। বিশেষ করে চলচ্চিত্র নির্মাতা সংগঠন, কলাকৌশলীসহ শিল্পীরা একযোগে প্রতিবাদ-সভায় অংশ নেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সম্মুখে বারবার। আর আজ তারই মুখে এ হতাশার কথা; ভবিষ্যতে কি হতে চলেছে, এ নিয়েও উদ্বেগ- উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেন। এমনিতে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা আন্দোলনের পর থেকে উদ্বেগের শেষ নেই। একের পর এক রটনা-ঘটনা-গুজব ছড়িয়ে পড়ছে। মহা আতঙ্কে আছে এসবে আমজনতা। জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা, জাতীয় কবি এবং স্বাধীন-সার্বভৌমত্ব নিয়েও নানা কথা উঠছে। অথচ এসব বহু আগে মিমাংসিত বিষয় ছিল, অযাচিতভাবে কেন এসব সামনে আসছে বারবার। সঙ্গে সেন্টমার্টিন নিয়েও প্রশ্ন ওঠছে। সেন্টমার্টিনে যেতে নাকি একজন পর্যটকে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে, সে যদি এদেশের নাগরিক হন, তারপরও রেজিস্ট্রেশন করতে হবে! এটি এক তুঘলকি সিদ্ধান্ত। সেন্টমার্টিন তো এদেশেরই অংশ; তা হলে দেশের নাগরিক জন্য কেন এ আইন। হ্যাঁ, বিদেশি পর্যটকদের বেলায় নাইবা ভিসা লাগতে পারে কিন্তু রেজিস্ট্রেশন কেন প্রয়োজন রয়েছে। তবে কথা ওঠেছে, সেন্টমার্টিনের অত্যাধিক পরিবেশ বিপর্যের কারণে নাকি পরিবেশ অধিদপ্তর এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বিশেষ করে পলিথিন ও প্লাস্টিকের বোতল যত্রতত্র ছুটে ফেলেয় পরিবেশ অসহনীয় উঠছে। আর এ জন্য পর্যটকদের ওপর এ খড়ক- তার সাথে প্রকৃতি-পরিবেশ ঠিক রাখতে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আবার কেউ কেউ অন্যকিছুর গন্ধ খুঁজছেন- সেন্টমার্টিন বিদেশিদেরকে ছেড়ে দেয়ার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ বিশেষ। আর সেখানে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করা হবে দক্ষিণ এশিয়াকে নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণে। বিশেষ করে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি স্থাপনে, দেশটি তৎপরতা রয়েছে। তবে সেন্টমার্টিন হাতছাড়া হোক-এ দেশের নাগরিকেরা তা চায় না, প্রয়োজনে তারা নিজের জান দিবে, এদেশের একবিন্দু কর্ণা-মাটি ছাড় দেবে না। হয়তো বিগত সরকারগুলো এসব বিষয় গুরুত্ব সহকারে অনুধাবন করছেন। দেশের মানুষকে ক্ষেপিয়ে ক্ষমতায় ঠিকে থাকা যাবে না। তাই, তাঁরাও আত্মঘাতিমুলক কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। দেশের জাতীয় পতাকার নকশাকার ‘হিন্দু’ একথাও সত্য নয়। শিব নারায়ণ দাস জাতীয় পতাকার প্রধান নকশাকার নয়। স্বাধীন- সার্বভৌমত্ব বাংলাদেশের পতাকা কেমন হবে, এ মনস্তাত্তি¡ক চিন্তাপোষণ করেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা কাজী আরেফ আহমেদ। তিনি বাংলাদেশর ৫৬ হাজার বর্গমাইলের একটি ভৌগোলিক মানচিত্র অঙ্কন, যা কি-না আয়তন-অবস্থা, প্রকৃতি ও পরিবেশ, জলবায়ু, মা ও মাটি থাকবে। এবং পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর জাতীয় পতাকার আকার-ধরন চিন্তাভাবনা এনেই দেশের জাতীয় পতাকার পুর্নাঙ্গ একটি কল্পিত-নকশা বা রূপ প্রনয়ন করেন। আর এ কাজে যাঁরা সহায়তা করেন, তাঁরা সকলেই ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। তাদের মধ্যে এখনো অনেকে জীবিত আছেন। তাদের একজন জাসদ একাংশের সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সাবেক কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা ও জাসদ অপরাংশের সভাপতি আ স ম আব্দুর রব, অপরজন আমেরিকা প্রবাসী ও সাবেক ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম-সম্পাদক ইঞ্জিনিয়র ইউসুফ সালাউদ্দিন আহমেদ। এছাড়া পতাকা তৈরি সাথে আরো যাঁরা জড়িত ছিলেন, শেখ শহিদুল ইসলাম, মনিরুল ইসলাম প্রকাশ মার্শাল মনি, শরীফ নুরুল আম্বিয়া, চিশতী শাহ্ হেলালুল রহমান, আবদুল্লাহ সানি, মইনুল ইসলাম চৌধুরী, গোলাম ফারুক, ফিরোজ শাহ্ ও খসরু প্রকাশ খসরুভাই।
ছাত্ররা পতাকা তৈরি নিয়ে মিটিংয়ে বসেন ইকবাল হলের ১০৮ নং কক্ষে। এই কক্ষটি বরাদ্দ ছিল তৎকালীন ছাত্রনেতা আ স ম আব্দুর রবের নামে। কাজী আরেফ আহমেদের প্রস্তাব অনুযায়ী সিদ্ধান্ত হলো পতাকায় সবুজ জমিনের ওপর থাকবে একটি লাল বৃত্ত। আর লাল বৃত্তের মাঝে থাকবে পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র। সবুজ জমিনে বাংলার চির-সবুজ প্রতীক, আর লাল সূর্যে জন্ম নেবে একটি দেশ। সোনালী আঁশের রঙে হবে তার পরিচয়, লাল বৃত্তের মাঝখানে সোনালি রঙের মানচিত্র-তারই প্রতীক। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সবাই কাজে নেমে পড়েন। খসরুভাই গেলেন বলাকা সিনেমা হলের ৪র্থ তলায় এক বিহারি দরজির দোকানে। বড় একটি টুকরো সবুজ কাপড়ের মাঝে সেলাই করে আনলেন লাল বৃত্তাকার সূর্যের প্রতীক। এবার করতে হবে পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র। সিদ্ধান্ত হলো, ওটা লাল বৃত্তের মাঝে রঙ দিয়ে আঁকা হবে। আঁকাআঁকিতে কুমিল্লার শিবর হাত ছিল ভালো। শিবু জানালেন, তিনি পেইন্ট করতে পারবেন, তবে মানচিত্র আঁকতে পারবেন না। ঠিক করা হলো হাসানুল হক ইনু ও ইঞ্জিনিয়র ইউসুফ সালাউদ্দিন আহমেদ পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র ট্রেসিং পেপার ট্রেস করে নিয়ে আসবেন। তাঁরা গেলেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন জিন্নাহ হলে। ইঞ্জিনিয়র ইউসুফ সালাউদ্দিন আহমেদ ও হাসানুল হক ইনু প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। জিন্নাহ হলে ৪০৮ নং কক্ষে থাকেন এনামুল হক। তার থেকে অ্যাটলাস আনেন ইউসুফ সালাউদ্দিন আহমেদ। ট্রসিং পেপারে ইউসুফ সালাউদ্দিন আহমেদ আঁকলেন পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র। শিবনারায়ণ দাস তাঁর নিপুণ হাতে ট্রেসিং পেপার থেকে পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র আঁকলেন লাল বৃত্তের মাঝে। আর ১৫ বাহিনীর পক্ষে আ স ম আব্দুর রব, ইকবাল হল- ১০৮ নং কক্ষে তৈরি করা পতাকা বঙ্গবন্ধুর হাতে থেকে গ্রহণ করলেন আনুষ্ঠানিকভাবে। আর এ পতাকা নিয়েই কি-যে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পতাকা নাকি শিবনারায়ণ দাস তৈরি করেছেন। এভাবেই বিভ্রান্তিমুলক কথা-বার্তায় জাতির প্রকৃত ইতিহাস বিকৃতি হয়ে যায়। আশা করি বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া গেছে (তথ্যসূত্র: ‘৭১’ গ্রন্থ, পৃ-১৩১, ১৩২, ১৩৩। লেখক-জামশেদ উদ্দীন)।
অবশ্য পতাকা তৈরি অন্যতম একজন জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনু গ্রেফতার হয়ে জেলে আছেন। আর জাতীয় সঙ্গিত নিয়েও যে বিতর্ক হচ্ছে, তারও কোনো যুক্তি থাকতে পারে না; এটি চুড়ান্তভাবে মিমাংসিত একটি বিষয়। তাছাড়া জাতীয় সঙ্গিতের রচিয়তা হিন্দু না মুসলিম, তা নিয়ে অযথা কেন এ বিতর্ক। স্বীকার করতে হবে, এটি একটি অনবদ্য সৃষ্টি। শুধু মা ও মাটির কথা আছে, সেখানে অন্যকিছুর গন্ধ খোঁজা আদৌও ঠিক হবে; অযথা এসব শুধু শুধু বিতর্ক জন্ম দিবে। জাতীয় সঙ্গিতের প্রতিটি লাইন, অত্যন্ত নিপুণভাবে-বুনন করা হয়েছে, উপমা-ব্যঞ্জনা ও শব্দ চয়নে মুনশিয়ানা প্রকাশ পায়। গানটির সুর অপর কোনো-এক সঙ্গীতের আদলে কিনা সেটি মূল্যায়নে আসে উচিত নয়। কখন কিভাবে এবং কিসে এজন লেখক প্রভাবিত হয় বলা তা মুসকিল। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্যাক্তিগতভাবে অগ্নি উপশক ছিলেন- বহুত্ববাদ বা দেবদেবী পূজা-অর্চনা করতেন না তিনি। করলেও কি আসে যায়– ব্যক্তি স্বাধীনতা তো আর খর্ব করা যায় না; সৃষ্টিশীল ব্যক্তিকে এসব নিছক-নিরিখে পরিমাণ বা মূল্যায়ন করা আদৌও ঠিক না। এতে জাতির ঐক্য বিনষ্ট হয়। বলতে গেলে জাতীভাবে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর জন্ম ভারতের বর্ধমান জেলার চুরিলিয়া গ্রামে। তিনি সাম্যের কবি, মানবতার কবি। তাঁর সৃষ্টি ও লড়াই-সংগ্রাম ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, ভারত মাতা-জাতিকে মুক্ত করা। তাই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা বরাবরই আতঙ্ক থাকতো, কখন কি গর্জে-আওয়াজে জাগিয়ে তোলে পরাধীন ভারত জাতিকে। তাই তিনি সাম্রাজ্যবাদীদের রোষানলে পড়ে বহুবার জেলের অন্ধকার-পোস্টে নিমজ্জিত হন। তবুও কবি দমিবার নয়। আজ কবিকে দেয়া প্রাপ্য সম্মানটুকু খুব-একটা বেশিকিছু তা নয়। তিনি মুক্তির জয়গান গেয়েছেন মানবের তরে।
লেখক : মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক, কবি কলামিস্ট