জবাবদিহির ঘাটতিতে বাড়ছে অনিয়ম

5

দেশের ব্যাংক খাতে দিনদিন বাড়ছে অনিয়ম দুর্নীতি। এর কারণ হিসেবে তদারকি ব্যবস্থার দুর্বলতাকে দুষছেন সংশ্লিষ্টরা। অনিয়ম রুখতে তদারকি বৃদ্ধির পরিবর্তে উল্টো কমছে ব্যাংকগুলোতে বিশেষ পরিদর্শন। বিভিন্ন অভিযোগের নিষ্পত্তিও হচ্ছে ধীর গতিতে। প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগগুলো আলোর মুখ দেখছে না। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ক্ষমতাশালীদের সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে।
এমন প্রেক্ষাপটে কিছু ঘটনার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ায় চাপের মুখে পড়েছেন সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা। এক পর্যায়ে বন্ধ হয়ে গেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাংবাদিকদের প্রবেশ পাস। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনিয়মের অভিযোগের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। জবাবদিহির ঘাটতির কারণে দুর্নীতি-জালিয়াতি বিস্তার লাভ করছে- এমন অভিযোগ ব্যাংকারদের।
জানা গেছে, কিছু দিন আগে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধিদলের সফরকালে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের অব্যবস্থাপনা ও উচ্চ খেলাপি ঋণসহ নানা অনিয়ম নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন। বৈঠকে ব্যাংক খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি ও ঋণ কেলেঙ্কারি ঠেকাতে ব্যাংকগুলোতে পরিদর্শন বাড়ানোর তাগিদও দিয়েছেন তারা। একই সঙ্গে ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্বাস্থ্য এবং এর ওপর করা পরিদর্শনের প্রতিবেদনগুলো গ্রাহকদের জন্য উন্মুক্ত করতেও পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, বর্তমান গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার যোগ দেওয়ার পর ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শন কমে প্রায় অর্ধেকে নেমেছে।
জানা গেছে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের ঋণ জালিয়াতিসহ বিভিন্ন অনিয়ম শনাক্তকরণে কাজ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিসেস ডিপার্টমেন্ট (এফআইসিএসডি)। উল্লেখ্য, এফআইসিএসডি হলো বাংলাদেশ ব্যাংকের একমাত্র ডিপার্টমেন্ট, যেখানে গ্রাহকসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীও তাদের ব্যাংকিং লেনদেনসংক্রান্ত যেকোনো অভিযোগ জানাতে পারেন। গ্রাহকরা ই-মেইল, অ্যানড্রয়েড অ্যাপস, বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইট, ডাক ও কুরিয়ার পরিষেবার মাধ্যমেও তাদের অভিযোগ দাখিল করতে পারেন এফআইসিএসডিতে। মূলত তফসিলি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ জালিয়াতি ও অনিয়ম চিহ্নিতকরণে বিশেষ পরিদর্শন করে থাকে এফআইসিএসডি।
কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরের চেয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে এফআইসিএসডির বিশেষ পরিদর্শন কমে প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। এ ছাড়া গত ২০২১-২২ অর্থবছরের চেয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে অভিযোগও এসেছে বেশি এবং সমাধান হয়েছে আগের তুলনায় কম।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে এফআইসিএসডি কর্তৃক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে মোট ১৭৯টি বিশেষ পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছিল। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিশেষ পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে ৯৪টি। সেই হিসাবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিশেষ পরিদর্শন কার্যক্রম কম পরিচালিত হয়েছে ৮৫টি বা ৪৭ শতাংশ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, আগে কোনো ব্যাংকের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ উঠলেই ওই ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখায় পরিদর্শন করা হতো। অভিযোগের বিষয় তদন্ত হতো। এখন এসব খুব একটা করা হচ্ছে না। ছোট ছোট অনেক সমস্যা সমাধান করতে হলেও ডিজির অনুমতি লাগে। তাদের কাছে গিয়ে বিভিন্ন অপ্রত্যাশিত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এ কারণে অনেক অনিয়ম এড়িয়ে যাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিআরপিডির এক কর্মকর্তা জানান, এখন সব কাজেই গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নররা সরাসরি হস্তক্ষেপ করেন। আগে কোনো ব্যাংক বা প্রতিষ্ঠানের বিষয় কোনো ফাইলের কাজ করাতে হলে নির্বাহী পরিচালকরা সংশ্লিষ্ট বিভাগের পরিচালকদের মাধ্যমে যুগ্ম বা সহকারী পরিচালকদের দিতেন। এখন গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নররা সরাসরি যুগ্ম পরিচালকদের ফাইল রেডি করতে বলছে। তারা যেভাবে চাচ্ছে সেইভাবে ফাইল তৈরি করতে হচ্ছে। সার্বিকভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলায় বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হয়েছে- এমন অভিযোগ একাধিক নির্বাহী পরিচালকের। এর আগে নির্বাহী পরিচালকদের ক্ষমতা খর্ব করার খবরও গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও ভারপ্রাপ্ত মুখপাত্র সাইফুল ইসলাম বলেন, পরিদর্শনের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি নীতিমালা আছে। কোন বিষয়ের জন্য কার অনুমতি নেবে তা উল্লেখ আছে। তবে কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ অনেক জটিলতা এড়াতে গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নরদের জানানো হয়; তবে এটা সবক্ষেত্রে নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যেসব অনিয়মের পেছনে প্রভাবশালীরা থাকে সেগুলো নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করা হয় না। আবার কিছু ঘটনা আছে যেগুলো চিহ্নিত করার পরও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকে বিশেষ পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে ১৮টি। আর আগের অর্থবছরে হয়েছিল ২১টি। বিশেষায়িত ব্যাংকে কোনো বিশেষ পরিদর্শন হয়নি। আগের অর্থবছরে হয়েছিল ১টি। বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে বিশেষ পরিদর্শন হয়েছে ৫০টি। আগের অর্থবছরে হয়েছিল ১১৪টি। ইসলামি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকে বিশেষ পরিদর্শন হয়েছে ২১টি। আর আগের অর্থবছরে হয়েছিল ২৯টি। বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকে বিশেষ পরিদর্শন হয়েছে ১টি। আর আগের অর্থবছরে হয়েছিল ২টি। আর সবচেয়ে বেশি অনিয়মে জর্জরিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিশেষ পরিদর্শন বেশি কমেছে। এগুলোতে বিশেষ পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে মাত্র ৪টি। আর আগের অর্থবছরে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিশেষ পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছিল ১২টি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, আইএমএফ প্রতিনিধিদল ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্বাস্থ্য পরীক্ষায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন অব্যাহত আছে কি না তা জানতে চেয়েছিল। পাশাপাশি পরিদর্শন প্রতিবেদনগুলো গ্রাহকদের জন্য প্রকাশ করা হয় কি না সে বিষয়েও ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া অনিয়ম-দুর্নীতি ও ঋণ কেলেঙ্কারি ঠেকাতে পরিদর্শনের মান ও সংখ্যা বাড়াতে পরামর্শ দিয়েছেন আইএমএফের প্রতিনিধিরা।
আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে এফআইসিএসডি মোট ১০ হাজার ৫৪২টি অভিযোগ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে সমাধান হয়েছে ৮২ শতাংশ। আর আগের অর্থবছরে অভিযোগ এসেছিল ৬ হাজার ৯২৩টি। এর মধ্যে ৯১ দশমিক ৪২ শতাংশই সমাধান হয়েছিল। অর্থাৎ এক বছরে অভিযোগ বেশি এসেছে ৩ হাজার ৬৫৯টি। আর অভিযোগের সমাধান হয়নি প্রায় ১০ শতাংশ।