জনগণ অধিনায়ক

8

বাবুল কান্তি দাশ

রবীন্দ্রনাথ শুধু কবি নন, মহাপুরুষ, অর্থাৎ সত্য ও প্রেমপরায়ণ পুরুষ। রবীন্দ্রনাথের জীবন ও সাহিত্য আনন্দের বস্তু; তা’তে জীবনের জড়ত্ব ঘোচে, আত্মা মার্জিত হয়। মানুষের সাথে মানুষের আত্মার বন্ধন সুদৃঢ় হয় প্রীতি ও প্রেমে। মানুষের সঙ্গে শুধু তাই নয়, বিশ্বের সঙ্গে ও বিশ্বভূপের সঙ্গে আত্মীয়তাবোধের পথ প্রশস্ত হয়। তাই রবীন্দ্রনাথ সর্বকালের সর্বজনের। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের পৌত্র। বিলাস-বৈভবে আনন্দ-সুখে তাঁর জীবন কাটবে, এটাই বোধহয় আপাতভাবে স্বাভাবিক ছিল। এমন মনে হলেও তাঁর মতো হৃদয়বান মানুষের পক্ষে কী করেই বা তা সম্ভব! জনগণের কল্যাণ সাধনাই যে তাঁর ব্রত। তিনি যে বলেছেন-আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে, আমার মুক্তি সর্বজনের মনের মাঝে, দুঃখবিপদ-তুচ্ছ-করা কঠিন কাজে। বিত্ত বৈভব আর বিলাসী জীবন যত না কাছে টেনেছে তার থেকে বেশি আপন করে নিয়েছে সহজ সরল সাধারণের শান্তি স্বস্তির জীবন। আজকের সঞ্চয়োন্মাদ সমাজ ও বিলাসী জীবন নিয়ে এবং তার ফলাফল সম্পর্কে অনেক আগেই বলে গিয়েছেন এই দ্রষ্টা পুরুষ। সাথে সাথে প্রাচ্য এবং প্রতীচ্যের বিলাসী জীবন নিয়ে আলোচনা করেছেন ‘বিলাসের ফাঁস’ নামক প্রবন্ধে। ‘বিলাসের ফাঁস’ রবীন্দ্রনাথের বহুলপঠিত প্রবন্ধগুলির মধ্যে একটি কি না জানি না, কিন্তু প্রবন্ধটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ দু’টি কারণে। প্রথমত, প্রবন্ধটির বিষয় আজও কেবল প্রাসঙ্গিকই নয়, আধুনিক সমাজবিজ্ঞানে যে বিষয়গুলিকে ‘হট টপিক’ বলা হয়, সেগুলির মধ্যে অন্যতম। দ্বিতীয়ত, সমাজবিজ্ঞানে রবীন্দ্রনাথের কোনও প্রথাগত শিক্ষা ছিল না, তিনি এ বিষয়ে কুণ্ঠা প্রকাশও করেছেন। এই ধরনের লেখার সংবাদ তাঁর বলয়ে পৌঁছনোরও পরিস্থিতি ছিল না সে দিন। তবুও সাধারণ বুদ্ধি দিয়েই তিনি যে এক ধরনের উপলব্ধি এবং ব্যুৎপত্তিতে পৌঁছতে পারতেন, এমনকি এক জন প্রশিক্ষিত পাশ্চাত্য সমাজবিজ্ঞানীর লেখার সমতুল্য লেখা লিখতে পারতেন এই কথাটা নতুন করে আমাদের অবাক করে দিতে পারে।
রবীন্দ্রনাথও তাঁর প্রবন্ধের শুরুতেই জানিয়ে দেন, আড়ম্বর বা বিলাসের প্রতি মোহ একদা পশ্চিমি সংস্কৃতি এবং সমাজের অঙ্গ হলেও, ইদানীং (অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর গোড়ায়) আমাদের দেশেও এর বাড়বাড়ন্ত লক্ষ করা যাচ্ছে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে দেখা যায় এর বাড়বাড়ন্ত। ক্রমান্বয়ে এর গতিবেগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় বিলাসের বাহুল্য দেখে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- এটা যথেষ্টই চিন্তার! কারণ রবীন্দ্রনাথের মতে, “আমাদের দেশে আয়ের পথ বিলাতের অপেক্ষা সংকীর্ণ। শুধু তাই নয়। দেশের উন্নতির উদ্দেশ্যে যে-সকল আয়োজন আবশ্যক, অর্থাভাবে আমাদের দেশে তাহা সমস্তই অসম্পূর্ণ।” কেন আমাদের দেশে আড়ম্বরের বাড়বাড়ন্ত? রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “আড়ম্বরের একটা উদ্দেশ্য লোকের কাছে বাহবা পাওয়া। এই বাহবা পাইবার প্রবৃত্তি এখনকার চেয়ে পূর্বকালে অল্প ছিল সে কথা মানিতে পারি না। তখনো লোকসমাজে খ্যাত হইবার ইচ্ছা নিঃসন্দেহ এখনকার মতোই প্রবল ছিল। তবে প্রভেদ এই, তখন খ্যাতির পথ এক দিকে ছিল, এখন খ্যাতির পথ অন্য দিকে হইয়াছে।” এই খ্যাতির পথ বদলের ব্যাখ্যা দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, “তখনকার দিনে দানধ্যান, ক্রিয়াকর্ম, পূজাপার্বণ ও পূর্তকার্যে ধনী ব্যক্তিরা খ্যাতি লাভ করিতেন। এখনকার দিনে ব্যক্তিগত ভোগের আদর্শ বাড়িয়া উঠিয়াছে, এইজন্য বাহবার স্রোত সেই মুখেই ফিরিয়াছে। এখন আহার পরিচ্ছদ, বাড়ি গাড়ি জুড়ি, আসবাবপত্র দ্বারা লোকে আপন মাহাত্ম্য ঘোষণা করিতেছে।” শুধু তা-ই নয়, “এখন টাকা সম্বন্ধে সমাজস্থ সকলেই অত্যন্ত বেশি সচেতন হইয়া উঠিয়াছে। সেইজন্য আমাদের সমাজেও এমন-একটা দীনতা আসিয়াছে যে টাকা নাই ইহাই স্বীকার করা আমাদের পক্ষে সকলের চেয়ে লজ্জাকর হইয়া উঠিতেছে। ইহাতে ধনাড়ম্বরের প্রবৃত্তি বাড়িয়া উঠে সকলেই প্রমাণ করিতে বসে যে আমি ধনী।” ভোগ-বিলাসে নিজেকে মহান করে তোলা বা ভাবা এবং সেই ‘মাহাত্ম্য ঘোষণা’-র এই প্রতিযোগিতার ফলে, পশ্চিমের মতো আমাদের দেশেও কেবল বিত্তশালীরাই অপ্রয়োজনীয় ব্যয় করেন। আসলে যে তা নয়, স্পষ্ট করে দেন রবীন্দ্রনাথ, “ধনীতে ধনীতে এখন এই লইয়া প্রতিযোগিতা। ইহাতে যে কেবল তাহাদেরই চাল বাড়িয়া যাইতেছে তাহা নহে, যাহারা অশক্ত তাহাদেরও বাড়িতেছে।” ‘অশক্ত’-দের ‘চাল’ বৃদ্ধির একটি মোক্ষম উদাহরণ দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, “আমরা বীরভূম জেলায় একজন কৃষিজীবী গৃহস্থের বাড়ি বেড়াইতে গিয়াছিলাম। গৃহস্বামী তাহার ছেলেকে চাকরি দিবার জন্য আমাকে অনুরোধ করাতে আমি বলিলাম, “কেন রে, ছেলেকে চাষবাস ছাড়াইয়া পরের অধীন করিবার চেষ্টা করিস কেন।” সে কহিল, “বাবু, একদিন ছিল যখন জমিজমা লইয়া আমরা সুখেই ছিলাম। এখন শুধু জমিজমা হইতে আর দিন চলিবার উপায় নাই। আমাদের চাল বাড়িয়া গেছে। পূর্বে বাড়িতে কুটুম্ব আসিলে চিড়াগুঁড়েই সন্তুষ্ট হইত, এখন সন্দেশ না পাইলে নিন্দা করে। আমরা শীতের দিনে দোলাই গায়ে দিয়া কাটাইয়াছি, এখন ছেলেরা বিলাতি রাপার না পাইলে মুখ ভারী করে। আমরা জুতা পায়ে না দিয়াই শ্বশুরবাড়ি গেছি, ছেলেরা বিলাতি জুতা না পরিলে লজ্জায় মাথা হেঁট করে।” এর অর্থনৈতিক পরিণাম কী? রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “ইহাতে ফল হইতেছে দেশের ভোগবিলাসের স্থানগুলি সমৃদ্ধিশালী হইয়া উঠিতেছে, শহরগুলি ফাঁপিয়া উঠিতেছে, কিন্তু পল্লীগুলিতে দারিদ্র্যের অবধি নাই।ৃ দেশের অধিকাংশ অর্থ শহরে আকৃষ্ট হইয়া, কোঠাবাড়ি গাড়িঘোড়া সাজসরঞ্জাম আহারবিহারেই উড়িয়া যাইতেছে। অথচ যাঁহারা এইরূপ ভোগবিলাসে ও আড়ম্বরে আত্মসমর্পণ করিয়াছেন, তাঁহারা প্রায় কেহই সুখে স্বচ্ছন্দে নাই; তাঁহাদের অনেকেরই টানাটানি, অনেকেরই ঋণ, অনেকেরই পৈতৃক সম্পত্তি মহাজনের দায়মুক্ত করিবার জন্য চিরজীবন নষ্ট হইতেছে।” পরিত্রাণের উপায়ও ওই প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন রবীন্দ্রনাথ, “প্রত্যেকে জীবনযাত্রাকে সরল করুন, সংসারভারকে লঘু করুন, ভোগের আড়ম্বরকে খর্ব করুন, তবে লোকের পক্ষে গৃহী হওয়া সহজ হইবে। গৃহই আমাদের দেশের সমাজের ভিত্তি। তাহাকে ত্যাগের দ্বারা যদি নির্মল না করি, তবে অর্থোপার্জনের সহস্র নূতন পথ আবিষ্কৃত হইলেও দুর্গতি হইতে আমাদের নিষ্কৃতি নাই।” একুশ শতকের পৃথিবীতে, ‘সোশ্যাল স্টেটাস’ প্রদর্শন করতে গিয়ে যখন আমরা ভোগবাদের চোরাস্রোতে একটু একটু করে তলিয়ে যাচ্ছি, মানবসভ্যতার প্রাচুর্যের স্পর্ধা যখন প্রকৃতিরও রোষের কারণ হয়ে উঠছে বলে দেখতে পাচ্ছি— তখন শতকাধিক কাল আগে রবীন্দ্রনাথের লিখে-যাওয়া এই অমোঘ কথাগুলিকে ফিরে ফিরে পড়া জরুরি, যথাসম্ভব ছড়িয়ে দেওয়াও জরুরি। এহেন বিলাসী জীবন যা মানুষকে নিজ অস্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে দিতে হয় তা কখনো রবীন্দ্রনাথের কাম্য ছিল না। আড়ম্বরে থেকেও রবীন্দ্রনাথ কেটেছেন অনাড়ম্বর জীবন। সাধারণের সহযোগী সহভাগী হতে তাদের স্বরূপ চিনিয়ে তদনুগ চলনায় প্রবৃত্ত করতে কাজ করেছেন প্রতিনিয়ত। বিলাসী জীবন যে অনর্থ ডেকে আনে এবং বিশ্বব্যাপী শান্তি বিনষ্টের কারণ হয়ে উঠে তা উপলব্ধি করেছেন অত্যন্ত দরদী হৃদয়ে। সেই সময়েও বিশ্বব্যাপী অশান্তির যে দামামা তা ব্যথিত করেছে দ্রষ্টা পুরুষ রবীন্দ্রনাথকে। কখনো যুদ্ধ বা শান্তি বিনষ্টকারীদের সাথে আপোষ করেননি, তাদের কাজে সমর্থন দেননি সর্বোেরি ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। যেখানে সাধারণের স্বস্তি বিঘিœত হয় এবং যা তাদের দুঃখের কারণ হয়ে উঠে তা কখনো রবীন্দ্রনাথ ভালোভাবে নেননি। জীবনের শেষবেলায় পৃথিবী জুড়ে যে বিপণ্ণতা তৈরি হয়েছিল, তা কতখানি তাঁকে বিচলিত করেছিল, সে তথ্য তো আমাদের হাতে আছে। যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি জানার জন্য সব সময়ই উদগ্রীব হয়ে থাকতেন। কোথায় বন্যা, কোথায় খরা, কোথায় দুর্ভিক্ষ মানুষের বিপন্নতা তাঁকে উদ্বিগ্ন করত। রবীন্দ্রনাথ কখনোই কল্পজগতে বাস করেননি। বাস্তবের মাটিতে পা ছিল। তিনি চেয়েছিলেন, আর কিছু নয়, আমাদের লোক এটাই তাঁর পরিচয় হয়ে উঠুক। লেখায়, কাগজ-কলমে অনেকেই মানুষের জন্য কাতরতা দেখান। আসলে সেসব লোক-দেখানো, সমাজসংসার, বৃহত্তর মানুষ কোনও কিছুই তাঁদের ভাবায় না। রবীন্দ্রনাথ সে দলের নন, তিনি অনন্য। বরাবরই আর্ত-পীড়িত বিপন্ন মানুষের জন্য তাঁর অন্তরাত্মা কেঁদে উঠেছে। সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেও নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে কার্পণ্য করেননি। মানুষের সংকট কখনো জেলায়, কখনো বা জেলার বাইরে রাজ্য-দেশ ছাড়িয়ে হয়তো দেশান্তরে। যুদ্ধবিধ্বস্ত রাশিয়ার দুর্ভিক্ষ বা জাপানের টোকিও-ইয়োকোহামার ভূমিকম্পও রবীন্দ্রনাথকে ভাবিয়েছে। ১৯২২ যুদ্ধ-বিধ্বস্ত রাশিয়ায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। মানুষের বিপন্নতার কথা জানিয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পল ভিনোগ্লাডফ রবীন্দ্রনাথের কাছে আর্থিক সাহায্যের আবেদন জানিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথও অর্থ-সংগ্রহে নেমে পড়েছিলেন। দেশের মানুষের কাছে অর্থ- সাহায্যের আবেদন জানিয়েছিলেন কবি। শান্তিনিকেতনের ঠিকানায় সাহায্য পাঠাতে বলা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের স্নেহের পাত্ররা, বন্ধুরা অনেকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এই তালিকায় অমল হোম এবং ড. দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্রের মতো সুপরিচিত বিশিষ্টজনেরা ছিলেন। সংবাদসূত্র থেকে জানা যায়, জনগণের কাছে সাহায্যের আবেদন জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ আড়াই হাজার টাকা সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন। জাপানের ভূমিকম্প নিয়েও একইভাবে তিনি সাহায্য-ভাÐার তৈরি করেছিলেন। আশ্রমের ছাত্র-শিক্ষকরা সে অর্থ-ভান্ডারে কিছু কিছু সাহায্য করেছিলেন। আশ্রম থেকে সাতশো পঞ্চাশ টাকার মতো সংগৃহীত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ নিজেও কিছু টাকা দিয়েছিলেন। সংগৃহীত অর্থ পাঠানো হয়েছিল জাপানে। এসব কোনও বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়, এমন ঘটনা বারবার ঘটেছে। কখনো তিনি পীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য জনগণের কাছে আবেদন জানিয়েছেন, কখনো নিজে সক্রিয়ভাবে অর্থ সংগ্রহে নেমে পড়েছেন। জীবনভরই এই সক্রিয়তা লক্ষ করা গিয়েছে। তখন তাঁর যুবক-বয়স। নানাভাবে ব্যস্ত। লেখার ব্যস্ততা, সম্পাদনার ব্যস্ততা। ঠাকুরবাড়ি থেকে সেসময় জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর সম্পাদনায় ‘বালক’ পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। সম্পাদক হিসেবে কবির বউঠানের নাম ছাপা হলেও পত্রিকা- সম্পাদনার যাবতীয় কাজ একাই সামলাতেন রবীন্দ্রনাথ। সে সময় পরপর দু’বছর অনাবৃষ্টির ফলে বীরভূমের নলহাটি-সংলগ্ন অঞ্চলে মানুষজনের খুবই দুর্গতি হয়। দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে সে সময় আদি ব্রাহ্মসমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। বিপন্ন মানুষের কথা ভেবে ব্রাহ্মসমাজের তরফে একটি সভা আহŸান করা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, আর্ত-পীড়িত মানুষজনের কথা ভেবে গানও রচনা করেছিলেন। গানটি ছিল এ রকম, ‘আজি কাঁদে কারা ওই শুনা যায়, অনাথেরা কোথা করে হাহাকারৃ।’ রবীন্দ্রনাথ পীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আবেদন জানিয়ে একটি প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। প্রবন্ধটি ওই সভায় পাঠও করেছিলেন। পরে সেটি ‘তত্ত¡কৌমদী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এটা কোনও বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়, রবীন্দ্রনাথ যুবক বয়স থেকে আর্ত-পীড়িত মানুষের পাশে এই ভাবে দাঁড়িয়েছেন। যুবক-বয়সে কখনো সুন্দরবনের দরিদ্র মানুষজনকে ঘরবাড়ি বানানোর জন্য, কৃষিকাজে সহায়তা করার জন্য অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছেন, আবার কখনো-বা বাঁকুড়ার দুর্ভিক্ষ-কবলিত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। অর্থ-সংগ্রহের জন্য ‘ফাল্গুনী’ অভিনয়ের ব্যবস্থা করেছেন। তখন তিনি ছিলেন দূরে, শিলাইদহে। নাট্যাভিনয়ের জন্যে দ্রæত ফিরে এসেছিলেন জোড়াসাঁকোয়। ঠাকুরবাড়ির প্রাঙ্গণে টিকিট কেটে ‘ফাল্গুনী’ অভিনীত হয়েছিল। সাধুবাদ জানিয়ে ছিলেন সকলে। নাট্যাভিনয়ের মধ্য দিয়ে সংগৃহীত অর্থ বিপন্ন মানুষের কাছে প্রেরিত হয়েছিল। মানুষই ছিল কবির পরম ধ্যেয়। মানুষের অন্তরে যে সৌন্দর্য তাহা অবগাহন ছিল কবির সাধনা। তাই কবির কণ্ঠে শোনা যায় – যাহার হৃদয়ে যত সৌন্দর্য বিরাজ করিতেছে সে তত সৌন্দর্য উপভোগ করিতে পারে। সৌন্দর্যের সহিত তাহার নিজের ঐক্য যতই সে বুঝিতে পারে ততই সে আনন্দ লাভ করে। এই পৃথিবীকে এবং পৃথিবীর সকল মানুষকে আত্মার আত্মীয় বলে মনে করতেন কবি। জগতের রূপ রস সৌন্দর্যে এত বিমোহিত ছিলেন কবি, তাই বলেছেন – মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবার চাই। এই সূর্য করে এই পুষ্পিত কাননে জীবন্ত হৃদয়-মাঝে যদি স্থান পাই!

লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক