চিকিৎসা সংবাদ, স্বাস্থ্য সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম প্রসঙ্গে

6

ডা. হাসান শহীদুল আলম

(৪র্থ পর্ব)
৫] স্বাস্থ্য সাংবাদিককে যে সব বিষয় মেনে চলতে হবে : ক) সংবাদসূত্রের সংগে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে। তা হতে পারে চিকিৎসক,হতে পারে হাসপাতালের কোন কর্মী বা কর্মকর্তা অথবা কোন ওষুধ প্রতিনিধি। খ) কোন চিকিৎসক বা হাসপাতাল সম্পর্কে তথ্য যাচাই করে তা প্রকাশ করা। এ কারণে একাধিক সূত্রের সংগে ক্রস চেক করতে হবে। গ) কোন ওষুধ বাজারে এলে তা সংগে সংগে উপস্থাপন না করে এর কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কিনা, তা যাচাই করে প্রতিবেদন লেখা, ঘ) স্বাস্থ্যবিষয়ক কোন শব্দ বা পরিভাষা না বুঝে বা না জেনে প্রকাশ/উপস্থাপন না করা, ঙ) চিকিৎসা সংক্রান্ত কোন বিভৎস ছবি (সার্জারীর সময়ের বা পোড়া মুখের ছবি বা আঘাতপ্রাপ্ত/থেতলে যাওয়া কোন ছবি) প্রকাশ না করা, চ) মানসিকভাবে অসূস্থ রোগী,স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসা ধর্ষিতা বা এ জাতীয় রোগীর সাক্ষাৎকার না নেওয়া, ছ) চিকিৎসা ক্ষেত্রে নুতন গবেষণা হলে তা ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা। জ) রোগীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা, ঝ) সংবাদসূত্র সম্পর্কে সতর্ক থাকা, ঞ) প্রতিবেদন তৈরী ও স্বপক্ষতা বা ওকালতির মধ্যে পার্থক্য নির্নয় করা, ট) ফাইল ছবি ও ভিডিও ফুটেজ ব্যবহারে সতর্কতা।
স্বাস্থ্য সাংবাদিকতার নেতিবাচক ভূমিকা পরিহারে গণমাধ্যমের দায়িত্ব :
১. প্রতিটি গণমাধ্যমে স্বাস্থ্যখাতের জন্য নির্দিষ্ট সাংবাদিককে স্বাস্থ্যখাতের ছযটি মূল নিয়ামক (প্রয়োজনীয় অর্থায়ন,জনবল,চিকিৎসা সরঞ্জাম, তথ্য-উপাত্ত,সেবাদানের সঠিক নির্দেশিকা ও যথাযথ ব্যবস্থাপনা ) সম্পর্কে পরিষ্কার ধারনা দিতে হবে। এর যে কোন একটির অনুপস্থিতিতে অন্যটি ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না এটা সাংবাদিকদের কাছে পরিষ্কার হতে হবে।যেমন ধরা যাক,কোন একটি উপজেলায় স্বাস্থ্যসেবা দিতে যে পরিমান ওষুধ ও যন্ত্রপাতি দরকার সেটা না থাকলে সেখানে কয়েক ডজন চিকিৎসক বসিয়ে রাখলে কোন লাভ হবে না। অর্থ, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও জনবলের সবকিছু থাকলেও যদি ‘কিভাবে কাজ করতে হবে’ এবং ‘কে কতটুকু করবেন’- এ সব নির্দিষ্ট না করা হয়,তাহলে নামকা ওয়াস্তে স্বাস্থ্য কাঠামো টিকে থাকবে বটে, কিন্তু কাক্সিক্ষত মানের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া সম্ভব হবে না।এ ব্যাপারটুকু সাংবাদিকের কাছে পরিস্কার থাকলে তাঁর প্রতিবেদনে ভুলত্রুটি এবং ভুল বুঝাবুঝি কমে আসবে বলে আশা করা যায়। স্বাস্থ্য সাংবাদিকদের সংগঠন বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টারর্স ফোরাম এ সব আয়োজনে বিশেষ সহায়তা দিতে পারে।
২. আজকাল মূলধারার সংবাদমাধ্যমসমূহের মধ্যে টেলিভিশনের প্রভাব তুলনামূলকভাবে বেশী। এ ক্ষেত্রে বিষয়টির তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া মাথায় রাখতে হবে।
৩. আজকাল স্বাস্থ্যবিষয়ক সংবাদ প্রতিবেদনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ’ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু’। চিকিৎসা সঠিক না ভুল হয়েছে,তা একজন সংবাদকর্মীর তাৎক্ষণিক জানতে পারার কথা নয়। তবে এর উপর তথ্যানুসন্ধান করা যেতে পারে এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞের মতামত প্রকাশ করা যেতে পারে।
৪. কোন চিকিৎসক বা কোন হাসপাতাল সম্পর্কে তথ্য দেয়ার সময় ভাবতে হবে তা সত্য কিনা।ভুল তথ্যের উপর ভিত্তি করে তৈরী প্রতিবেদনটি ঐ চিকিৎসক বা ঐ হাসপাতালের প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট করে দিতে পারে।সমাজে বা পরিবারে ঐ চিকিৎসকের ব্যক্তিগত ইমেজ নষ্ট হতে পারে।
৫. স্বাস্থ্যবিষয়ক সংবাদ প্রতিবেদনের কিছু ক্ষেত্রে আরও বেশী সংবেদনশীল হওয়া উচিৎ। যেমনÑ আত্মহত্যার সংবাদ পরিবেশনে। এই ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। আত্মহত্যার কারন ও পদ্মতির কাহিনী প্রচার এবং কোন ছবি, ভিডিও, লিংক প্রচার করা উচিৎ নয়। সংবাদটি এমনভাবে প্রচার করা উচিৎ যাতে এটিকে কোন স্বাভাবিক ব্যাপার মনে না হয়। অথবা কেউ যেন এটাকে কোন সমস্যর সমাধান হিসাবে না ভাবেন। আত্মীয় পরিজনের সাক্ষাৎকার নেয়ার সময় প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে বিশেষ নজর রাখা উচিৎ। এটিও একটা রোগ। আত্মহত্যা প্রতিরোধে সমাজকে সংবেদনশীল করার ক্ষেত্রে প্রতিবেদনটি ভূমিকা রাখতে পারে তা মাথায় রাখতে হবে।
৬. নতুন ওষুধ বা চিকিৎসা পদ্ধতির খবর দিতে চাইলেও কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হবে। দু-একটি গবেষণায় প্রমান হলে বা সাময়িকীতে প্রকাশ পেলেই তা ব্যাপক হারে জনগণের মাঝে প্রচার করা যাবে না। কারণ একটি নুতন ওষুধ যে কার্যকর ও নিরাপদ তা প্রমানের জন্য অনেকগুলো ধাপে গবেষণার পর সাধারণের জন্য সেটি প্রকাশ করা উচিৎ। যেমন- সম্প্রতি ডেংগু জ্বরে পেঁপে পাতার রসের উপকারিতার উপর সংবাদ প্রকাশের পর মানুষ ব্যাপক হারে নির্বিচারে তা খাওয়া শুরু করে। প্রকৃতপক্ষে এগুলো কেবল প্রাথমিক প্রতিবেদন। অধিক সংখ্যক রোগী এবং প্রাণীর উপর এর কাংখিত ও অনাকাক্সিক্ষত প্রভাব গবেষণার পরই এমন খবর প্রকাশ করা উচিৎ। এ ক্ষেত্রে সংবাদের সূত্রও অত্যন্ত জরুরী।
৭. ক্যানসার সহ বেশ কিছু বিশেষ রোগের খবর প্রকাশ এমনকি বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রেও বিশেষ বিবেচনা রাখা উচিৎ যেন জনগন সহজলভ্য বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসা রেখে অপচিকিৎসার দিকে না ঝোঁকে। যেমন- বাংলাদেশের কোন কোন টেলিভিশন চ্যানেলে বেশকিছু অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসার প্রচার করা হয়। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমগুলোর কাছ থেকে দায়িত্বশীল আচরণ আশা করা যেতে পারে।
৮. চিকিৎসা গবেষণার উপর রিপোর্ট করতে গেলে আরও কিছু বিষয় অনুধাবন করতে হয়। যেমন- এই গবেষণার পরিসংখ্যানগত তাৎপর্য। কতজন মানুষের উপর তা করা হযেছে। এর পেছনে ওষুধ কোম্পানীর কোন স্বার্থ রয়েছে কিনা অথবা এই গবেষণা প্রতিবেদনের উপর সাধারণ মানুষের ভুল বোঝার কোন অবকাশ থাকে কিনা। যেমনÑ ২০০৫ সালে যুক্তরাজ্যের অরল্যান্ডোর ৪০ হাজার নারীর উপর গবেষণা করে একটি প্রথম সারির সংবাদ মাধ্যম সংবাদ পরিবেশন করে যে, রক্তে কোলেস্টেরল কমানোর স্ট্যাটিন জাতীয় ওষুধ গ্রহণে নারীর স্তন ক্যানসার যারা স্ট্যাটিন গ্রহন করেন না, তাদের তূলনায় অর্ধেক কমে যায়। প্রকৃতপক্ষে তাদের মধ্যে মাত্র ১২ শতাংশ নারী ওষুধ গ্রহণ করেছিল এবং ১.৪ শতাংশ স্তনের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছিল। অর্থাৎ খুব সামান্য সংখ্যক ক্যানসার রোগীর মাঝে স্ট্যাটিনের প্রভাব দেখা যায়,যা পরিসংখ্যানগত তেমন তাৎপর্য বহন করে না।আবার কোন ক্যানসার রোগী এই প্রতিবেদন পাঠ করে যদি ক্যানসারের কেমোথেরাপী গ্রহন না করে স্ট্যাটিন খেতে চায় তবে তার ক্ষেত্রে বিষয়টি যথেষ্ট বিপত্তির কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে।
উপসংহার : এ পর্যন্ত যেটুকু আলোচনা হলো তার সারমর্ম হিসাবে উপসংহারে বলতে চাই যে, চিকিৎসাধীন রোগী সম্পর্কিত সংবাদ পরিবেশনের জন্য জাতীয়ভাবে নীতিমালা প্রণয়ন এবং নীতিমালা লংঘিত হলে দায়ী সাংবাদিক ও মিডিয়ার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা রাখা জনস্বাস্থ্য রক্ষায় এবং চিকিৎসার জন্য অহেতুক বিদেশগামিতা কমিয়ে দেশের মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রার অপচর রোধে একান্তভাবে কাম্য। (সমাপ্ত)
লেখক: ডায়াবেটিস ও চর্মযৌনরোগে স্নাতকোত্তর
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক চট্টগ্রাম