চিকিৎসা সংবাদ , স্বাস্থ্য সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম প্রসঙ্গে

3

ডা. হাসান শহীদুল আলম

(৩য় পর্ব) (পূর্ব প্রকাশিতের পর)

স্বাস্থ্য সাংবাদিকতার নেতিবাচক ভূমিকা পরিহারে করনীয় :
সরকারের কর্তব্য :
১। আইনগত পদক্ষেপ :
চিকিৎসাধীন রোগী সম্পর্কিত সংবাদ পরিবেশনের জন্য জাতীয়ভাবে নীতিমালা প্রনয়ন এবং নীতিমালা লংঘিত হলে দায়ী সাংবাদিক ও মিডিয়ার বিরুদ্ধে আইনানুগ শাস্তির ব্যবস্থা রাখা।
২। বিদেশী হাসপাতালের এদেশীয় এজেন্টদের তৎপরতা রোধ করা :
(ক) রাজধানী ও বিভাগীয় শহরসমূহে কর্মরত বিদেশী হাসপাতালের প্রতিনিধি এবং লিয়াঁজো অফিসসমূহের কার্যক্রম সরকারী তদারকিতে নিয়ে আসা যাতে তারা এদেশের রোগীদেরকে ফুসলিয়ে বিদেশী হাসপাতালে নিয়ে যেতে না পারে এবং এ দেশের চিকিৎসা বা চিকিৎসককে বিতর্কিত করার জন্য কোন ষড়যন্ত্র করতে না পারে।
(খ) হাসপাতালসমূহকে বিদেশীদের দালালমুক্ত রাখতে হবে।
৩। চিকিৎসকদের সুরক্ষার আইন প্রণয়ন ও কার্যকর করা :
রোগীর মৃত্যু চিকিৎসকের ভুলে হয়েছে কিনা এটা বিশেষজ্ঞ তদন্ত ছাড়া কোন ননমেডিকেল ব্যক্তির সিদ্ধান্ত হতে পারে না।সেজন্য রাষ্ট্রীয় আইনে তদন্ত হবে।
এ প্রসংগে একটি সংবাদচিত্র তুলে ধরছি পাঠক সমীপে : ‘চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগে চিকিৎসকদের মারধর, মামলা, হয়রানি, হাসপাতাল ভাংচুর ইত্যাদি সম্পর্কে ভারতের সুপ্রীম কোর্ট ২০০৯ সালে এক যুগান্তকারী রায় দেয়। সেই রায় অনুযায়ী কোন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ তোলা হলে তার প্রাথমিক সূত্রতা ছাড়া ঐ চিকিৎসককে গ্রেফতার করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে প্রথমে কোন যোগ্য বিশেষজ্ঞ বা বিশেষজ্ঞ প্যানেলের মতামত নিতে হবে। এর পরেই শুধু সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের বিরুদ্ধে নোটিশ জারি করা যাবে। আদালত মনে করে চিকিৎসাপেশাকে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষন আইনের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করায় অত্যন্ত তুচ্ছ ঘটনায়ও চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে (বাংলাদেশ প্রতিদিন,০৯-০২-২০)।”
৩। আইনের উদ্দেশ্য হতে হবে চিকিৎসক ও রোগীর মধ্যে দূরত্ব কমানো :
স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইন-২০১৯ এর খসড়া চূড়ান্ত করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ।সচেতন মহলের প্রত্যাশা হচ্ছে, আইনটিতে এমন কোন বিধান থাকা উচিৎ হবে না যাতে চিকিৎসক ও রোগীর মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধি পায়।
সাংবাদিকদের কর্তব্য :
১। অসত্য,অতিরঞ্জিত,উদ্দেশ্যমূলক সংবাদ প্রচার করা উচিৎ নয়। এমন খবর প্রচারে মুখরোচক জনপ্রিয়তার চেয়েও দেশ ও দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি সংবাদকর্মীদের দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়া উচিৎ।
২। চিকিৎসা সংক্রান্ত রিপোর্টিং সুষ্ঠু,নিরপেক্ষ ও দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নের সংগে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। সুচিকিৎসা যেমন সবার মৌলিক অধিকার,তেমনি তা সুনিশ্চিতকরণে সংশ্লিষ্ট প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্বশীল হওয়া একান্ত জরুরী।
৩। সংবাদ প্রতিবেদনের বিষয় হিসাবে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের অনেক ইস্যু অন্যান্য ক্ষেত্র যেমন রাজনীতি, ব্যবসা ,অর্থনীতি,পররাষ্ট্রনীতি প্রভৃতি থেকে ভিন্ন,যথেষ্ট সংবেদনশীল ও গতিশীল বিধায় স্বাস্থ্য সংবাদ পরিবেশনে সংবাদকর্মীকে যত্নশীল থাকা প্রয়োজন। লক্ষ্য রাখতে হবে কোন সংবাদ যেন মিথ্যা প্রত্যাশা অথবা অতি জরুরী কোন চিকিৎসা নিতে ভীতি সৃষ্টি না করে যেমন :
ক) ২০০৪ সালে তিনটি প্রভাবশালী সংবাদ মাধ্যমে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয় যে,মাতৃগর্ভ থেকে নবজাতকে এইচআইভি ভাইরাস ছড়ানোর প্রতিষেধক নেভিরাপিন নামক ওষুধের অনেক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া জনসাধারণের কাছে গোপন রাখা হয়েছে।অনেক চিকিৎসক এই খবরে উৎকন্ঠা প্রকাশ করেন যে, এতে নবজাতকের এইচআইভি আক্রান্তের হার বেড়ে যেতে পারে।
খ) বাংলাদেশে পোলিও, ডিপথেরিয়া, ধনুষ্টংকার, হুপিং কাশি ইত্যাদি নির্মূলে ইপিআই কর্মসূচীর বৈপ্লবিক সাফল্যে সংবাদ মাধ্যমের খবর এবং প্রচারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। একইভাবে নিরাপদ মাতৃত্ব, নিরাপদ পানীয় জল এবং খাওয়ার আগে হাতধোয়া, খাবার সেলাইনের মাধ্যমে কলেরা, ডায়রিয়া রোগের চিকিৎসায় গনমাধ্যম বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।
গ) বাংলাদেশে যখন কয়েকটি সরকারী হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট কিডনী প্রতিস্থাপনে সফলভাবে সুনামের সংগে এগিয়ে যাচ্ছিল,তখন কিডনী বিক্রির সংগে জড়িত দালাল চক্র ও ভুক্তভোগী দরিদ্র কিডনী বিক্রেতাদের দুর্দশা নিয়ে যে সংবাদ পরিবেশন করা হলো তাতে পরবর্তী সময়ে বৈধ কিডনীদাতা এবং সার্জনরা বাংলাদেশে কিডনী প্রতিস্থাপনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এমন সংবেদনশীল ক্ষেত্রগুলো নিয়ে সংবাদ পরিবেশনায় আরো সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
ঘ) স্বাস্থ্য বিষয়ে সংবাদ পরিবেশনায় চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রায়োগিক ও পরিভাষাগত দিকটির কথা বিবেচনায় রাখতে হবে। যেমনÑস্টেম সেল বিশেষ ধরনের কোষ,যা থেকে বহু ধরনের কোষ জন্মানো যেতে পারে। স্টেম সেল দিয়ে কিডনী রোগের চিকিৎসায় অস্ট্রেলীয় বিজ্ঞানীর সাফল্য নিয়ে রিপোর্ট করতে গিয়ে বলা হয়েছে,’গাছের কান্ড দিয়ে কিডনী রোগের চিকিৎসা’। আবার ডায়রিযা চিকিৎসায় ব্যবহৃত শিরায় দেয়া সেলাইনের নাম যদিও ’কলেরা সেলাইন’; কিন্তু ভুল রিপোর্ট করা হয়েছেÑ ডায়রিয়ার রোগীকে কলেরা স্যালাইন দিলেন।’ সময়ের আগে জন্ম নেয়া প্রিম্যাচিউর নবজাতকের রক্তক্ষরন রোধ করার জন্য ’ভিটামিন কে’ ইনজেকশন খাওয়ানো হয়।এক নবজাতকের মৃত্যুর পর একটি সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে লিখা হয়Ñ’শরীরে ইনজেকশন না দিয়ে খাইয়ে দেওয়ায় নবজাতকের মৃত্যুর আভিযোগ’।তাই স্বাস্থ্য সংক্রান্ত খবর পরিবেশনে কারিগরী বা পেশাগত পরিভাষায় দখল থাকতে হবে।
৪। স্বাস্থ্যখাতে কতগুলি পক্ষ রয়েছে,যারা কোন একটি খবরকে প্রভাবিত করতে পারে এবং এই খবরগুলো কারও উপর প্রভাব ফেলতে পারে।এর মধ্যে রয়েছে এই খাতে বিনিয়োগকারী ওষুধ কোম্পানী,হাসপাতাল-ডায়াগনসটিক সেন্টারের মালিক, এই খাতের পেশাজীবী (চিকিৎসক,নার্স,টেকনোলজিস্ট), সরকার,বীমা কোম্পানী ও জনগণ। সংবাদকর্মীরা খবরের সূত্র খোঁজার পাশাপাশি অনুসন্ধান করবে যে সংবাদ সৃষ্টিতে এই পক্ষগুলির স্বার্থ বা প্রভাব রয়েছে কিনা। (চলবে)

লেখক : চর্মরোগে ¯œাতকোত্তর
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক