চট্টগ্রাম ছাড়িয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে গণির বেলা বিস্কুট

76

 

নিজস্ব প্রতিবেদক

চন্দনপুরা এলাকার বিস্কুট বিক্রেতা বেলায়েত আলীর নামে নামকরণ হয়েছে বেলা বিস্কুটের। এই বিস্কুট এখন চট্টগ্রাম ছাড়িয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। এখানকার গণি বেকারির হাত ধরে বেলা বিস্কুটের প্রচলন শুরু হলেও বর্তমানে দেশের বিভিন্ন বেকারিতে তৈরি হচ্ছে এই বিস্কুট।
ইতিহাস বলছে, আড়াইশ বছর পূর্বে চট্টগ্রাম শহরে বেকারি শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চট্টগ্রামে এই শিল্পের প্রসার ঘটে। গণি বেকারি থেকে ব্রিটিশ সৈনিকদের জন্য বেকারির পণ্য তৈরি হতো। ব্রিটিশ আমল থেকে পাকিস্তান আমল পর্যন্ত ১৭টি বেকারিতে তৈরি হতো বেলা বিস্কুট। সেই হিসেবে ২০০ বছর আগে উপমহাদেশে এই বেকারিতে প্রথম বেলা বিস্কুট তৈরি হয়েছিল বলে গবেষকদের ধারণা।
গবেষক আহমদ মমতাজ জানান, মোগল ও পর্তুগিজদের পছন্দ ছিল রুটি, পাউরুটি, বিস্কুটসহ বেকারি পণ্য। তখনকার উদ্যোক্তারা বেলা বিস্কুট নামে বিশেষ ধরনের বিস্কুট তৈরি করেন।
জানা যায়, ১৮৭৮ সাল থেকে গণি বেকারির যাত্রা শুরু হয়। পশ্চিবঙ্গের বর্ধমান জেলার বাসিন্দা আবদুল গণি সওদাগরের পূর্বপুরুষ লাল খাঁ সুবেদার ও তার ছেলে কানু খাঁ মিস্ত্রির উদ্যোগে বেকারি পণ্য তৈরি শুরু হয় চট্টগ্রাম অঞ্চলে। তারা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে চট্টগ্রামে আসেন। পূর্বপুরুষের মাধ্যমে বেকারিশিল্পে যুক্ত হন আবদুল গণি সওদাগর। ১৯৭৩ সালে ১০৫ বছর বয়সে মারা যান আবদুল গণি।
তার মৃত্যুর পর ব্যবসা পরিচালনার দায়িত্ব নেন ভাইয়ের ছেলে দানু মিঞা। দানু মিঞা মারা যান ১৯৮৭ সালে। এরপর ব্যবসার হাল ধরেন তার ছেলে অ্যাডভোকেট জামাল উদ্দিন। পরবর্তীতে জামাল উদ্দিনের ছেলে আবদুল্লাহ মোহাম্মদ এহতেশাম ব্যবসা পরিচালনা করছেন, ধরে রেখেছেন গণি বেকারির নাম।
চন্দনপুরা কলেজ রোডে গণি বেকারির শো-রুম। গণি বেকারি শপিং কর্নার। পেছনে কারখানায় দুটি মাটির তৈরি তন্দুরে বেলা বিস্কুট তৈরি করেন কারিগররা। ময়দা, চিনি, লবণ, ভোজ্যতেল, ডালডা, গুঁড়ো দুধ পানিতে মিশিয়ে খামি তৈরি করা হয়। এই খামিতে মাওয়া মিশিয়ে একদিন রেখে দেওয়ার পর তন্দুরে দুই দফায় সেঁকে বেলা বিস্কুট তৈরি করা হয় বলে জানান তারা। চাহিদা অনুযায়ী প্রতিদিন ৬ থেকে ৮ হাজার পিস বেলা বিস্কুট তৈরি হয় এখানে। গণি বেকারির মালিক আবদুল্লাহ মোহাম্মদ এহতেশাম পূর্বদেশকে বলেন, ৮-১০ বছর আগেও প্রতিদিন গড়ে ৩০ হাজার পিস বেলা বিস্কুট বিক্রি হতো। এখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বেলা বাজারে এসেছে। তাই আমাদের বিস্কুটের চাহিদাও কমে গেছে। এখন প্রতিদিন গড়ে ১০০-১২০ প্যাকেট বেলা বিস্কুট বিক্রি হয়। তিনি জানান, করোনাকালে ব্যবসা আরও কমে গেছে। কানাডার একটি প্রতিষ্ঠান গণি বেকারির বেলা বিস্কুট আমদানি করতো। শিপিংসহ নানা জটিলতার কারণে তারাও আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। তবুও ঐতিহ্য ধরে রাখতে আমরা এ ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছি। এখনো মাটির তন্দুরে সনাতন পদ্ধতিতে বেলা বিস্কুট তৈরি হচ্ছে এখানে। এছাড়া বেকারিতে ৩০ ধরনের খাদ্যপণ্য বানানো হয়।
দেশে বিস্কুটের বাজারের আকার এখন প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা, যা প্রতিবছর গড়ে ১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। বিস্কুট কোম্পানিগুলো বলছে, গত কয়েক বছরে বিস্কুটের উপকরণের দাম বেড়েছে, পাশাপাশি দেশে প্রতিযোগিতাও বেড়েছে। কিন্তু বিস্কুটের দাম তেমন বাড়েনি। এতে দেশের মানুষ সস্তায় নাগালের মধ্যে বিস্কুট পাচ্ছে। অলিম্পিক, হক, নাবিস্কো, ইস্পাহানি, ড্যানিশ, রোমানিয়া, কোকোলা, প্রাণ, কিষোয়ান, ওয়েল ফুড-এগুলোই বিস্কুটের বাজারে এখন বড় ব্র্যান্ড। তবে এখন বেলা বিস্কুটের স্বাদ আগের মতো নেই। একেক কোম্পানির বেলার আকার একেকরকম। গণি বেকারির হাত ধরে বেলা বিস্কুট জনপ্রিয় হলেও হরেক বেকারির ভিড়ে কমেছে এখানকার বিস্কুটের কদর। তবুও গণি বেকারি মোড় হয়ে পথ চলতে গিয়ে চা-প্রেমিদের মনে পড়ে যায় পুরনো দিনের কথা, চায়ের কাপে বেলা বিস্কুট ভিজিয়ে খাওয়ার কথা।