চট্টগ্রাম-কাপ্তাই মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করা সময়ের দাবি

10

যিকরু হাবিবীল ওয়াহেদ

চট্টগ্রাম দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী নামে খ্যাত। চট্টগ্রাম বন্দর দেশের রাজস্বের উল্লেখযোগ্য অংশের জোগানদাতা। সেই হিসেবে বর্তমান সরকার বন্দর কেন্দ্রিক এবং চট্টগ্রাম ঘিরে মহা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে হাঁটছে। ইতিমধ্যে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম টানেল বঙ্গবন্ধু টানেল। নির্মিত হয়ে চলাচলের অপেক্ষায় আছে লালখান বাজার থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত মহিউদ্দিন চৌধুরী এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে। এমন হাজার কোটি টাকার প্রকল্প একের পর এক বাস্তবায়ন হলেও চট্টগ্রাম-কাপ্তাই মহাসড়ক এখনো স্বাধীনতা পূর্বের অবস্থায় রয়ে গেছে। চট্টগ্রাম-কাপ্তাই মহাসড়ক চট্টগ্রাম বিভাগের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক হিসেবে বিবেচিত।
তথ্য মতে, ৫২ কিলোমিটারের দুই লেনের চট্টগ্রাম-কাপ্তাই মহাসড়ক নির্মিত হয় ১৯৬৩ সালে। চট্টগ্রাম-কাপ্তাই মহাসড়ক চট্টগ্রাম নগরীর চাঁন্দগাও থেকে শুরু হয়ে জেলার হাটহাজারী উপজেলা, রাউজান উপজেলা ও রাঙ্গুনিয়া উপজেলার মধ্য দিয়ে রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তাই পর্যন্ত গেছে। যার ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি বান্দারবানের সাথেও চট্টগ্রাম শহর বন্দর এয়ারপোর্টের যোগাযোগ ত্বরান্বিত এবং সহজ হয়। পাশে বিভিন্ন উপজেলার সংযুক্ত সড়কের মাধ্যমে যুক্ত হয়েছে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার বেশ কিছু উপজেলা। এমনকি এসব সংযুক্ত সড়ক হয়ে যাওয়া যায় কক্সবাজার জেলার টেকনাফ পর্যন্ত। যার ফলে বৃদ্ধি পায় ব্যবসা বাণিজ্য, সহজ হয় চিকিৎসা পড়ালেখা। গড়ে উঠে নতুন নতুন মার্কেট শপিং সেন্টার বাজার কল-কারখানা এবং বিভিন্ন অবকাঠামো। কর্মসংস্থান হয় হাজার হাজার মানুষের। শুরুতে যাত্রী কম যাতায়াত করলেও তথ্যমতে বর্তমানে বছরে অন্তত ৯০ লাখের অধিক যাত্রী এই মহাসড়ক ব্যবহার করে।
সময়ের ব্যবধানে এই মহাসড়কে যাত্রী, যানবাহন এবং বিভিন্ন উপজেলার সাথে সংযুক্ত সড়ক বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু সেই তুলনায় রাস্তা প্রশস্ত না হওয়াতে ঘন্টার পথ পারি দিতে লেগে যায় কয়েক ঘন্টা। আর দুর্ঘটনা হতাহতের ঘটনা যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
চট্টগ্রাম-কাপ্তাই মহাসড়ক দুই লেন হওয়ার কারণে এবং বড় বড় গাড়ীর চাপে পুরাতন চাঁন্দগাও থানার মুখে, দক্ষিণ চট্টগ্রামের একাংশ বোয়ালখালী পটিয়াসহ বিভিন্ন উপজেলার সংযোগ স্থল কাপ্তাই রাস্তার মাথা এলাকায় যানজট লেগেই থাকে। মহাসড়কটি দুই লেন হওয়ার কারণে ওইসব স্থানে প্রতিনিয়ত যানজটের পাশাপাশি দুর্ঘটনা যেন স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। ওইসব স্থানে নারী শিশু বৃদ্ধের রাস্তা পারাপার করতেও মুশকিল হয়ে যায়।
নগরীর অক্সিজেন এবং অনন্যা আবাসিক সংযোগ মুখ অক্সিজেন রাস্তার মাথা বঙ্গবন্ধু এভিনিউ দিয়ে শত শত সিএনজি অটোরিকশা কার হাইস ট্রাক চলাচল করাতে যানজট যেন স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে উল্লিখিত স্থানে। আর অনন্যায় আন্তর্জাতিক মানের এভায়কেয়ার হাসপাতাল এবং ফ্রোভেলের মতো অভিজাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হওয়ায় দিনের ভিন্ন ভিন্ন সময়ে এই স্থানে যানজট মারাত্মক আকার ধারণ করে। তাছাড়া মহাসড়কটির হাটহাজারী উপজেলার অংশ নজুমিয়াহাটে বিভিন্ন মার্কেট শপিং সেন্টার বাজার গড়ে ওঠায় ওই স্থানেও যানজট লেগে থাকার পাশাপাশি দুর্ঘটনায় পতিত হয় সাধারণ মানুষ। মহাসড়কটির হাটহাজারী উপজেলার আরেক সংযোগ স্থল মদুনাঘাট। হাটহাজারী উপজেলার আকবর শাহ, উরকিরচরসহ কয়েকটি ইউনিয়নের লক্ষ বাসিন্দার যাবতীয় যোগাযোগ মদুনাঘাট দিয়ে। যার ফলে ওই স্থানেও যানজট নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়া বাজারকে ঘিরে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বিভিন্ন সূত্রে মানুষের যাতায়াত বৃদ্ধি পেয়েছে। দিন দিন গাড়ী ও মানুষের যাতায়াত বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে প্রাইভেট গাড়ি, বাস, পিকআপ, মিনিবাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যানের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে নোয়াপাড়া সংযোগ সড়কে। যার কারণে ১০ মিনিটের পথ পাড়ি দিতে সময় চলে যায় ঘন্টাখানেক। এভাবেই হাজার মানুষের প্রতিনিয়ত অযুত কর্মঘন্টা নষ্ট হচ্ছে।
চট্টগ্রাম-কাপ্তাই মহাসড়কের রাউজান অংশের পাহাড়তলী বাজার স্টেশন আরেক বিড়ম্বনার নাম। চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইমাম গাজ্জালী ডিগ্রি কলেজ লাগোয়া এই স্টেশন কেন্দ্রিক গড়ে উঠেছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, মার্কেট, ক্লিনিক, বাজার, কারখানা। পাহাড়তলী বাজার মোড়ে সংযোগ হয়েছে রাউজানের মূল অংশের সাথে। যার ফলে প্রতিনিয়ত হাজারো মানুষের যাতায়াত এই স্টেশন দিয়ে। কিছু দিন পর পর এই স্টেশন এবং এর আশপাশে দুর্ঘটনা ঘটে। গাড়ি এক্সিডেন্টে হতাহতের মতো ঘটনাও ঘটেছে বেশ ক’বার। মাসখানেক আগেও চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই মেধাবি শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে শাহ আমানত নামক বাসের ধাক্কায়। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এবং সামাজিক প্রশাসনিক বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে কিছুদিন গাড়ি চালানোয় বেপরোয়াভাব কমলেও কিছুদিন যেতে না যেতেই গাড়িগুলোর বেপয়োরাভাব আবারও ফিরে আসে।
চট্টগ্রাম-কাপ্তাই মহাসড়কের শান্তির হাট স্টেশন এবং গোছরা স্টেশনে তুলনামূলকভাবে কিছুটা হালকা যানজট হলেও গোডাউন স্টেশন যেন যানজটের স্টেশনে পরিণত হয়েছে। দুইলেনের সরু রাস্তা, এলোমেলো গাড়ি রাখা, তার উপর দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়ার ৩/৪ ইউনিয়নের অন্যতম চলাচলের স্টেশন হওয়ায় গাড়ির জ্যাম লেগে উভয় পাশে গাড়ির ২/৩ কিলোমিটার পর্যন্ত দীর্ঘ লাইন হয়ে যায়। এতে যাত্রীদের অবর্ণনীয় কষ্ট পোহাতে হয়। বিশেষত, বৃদ্ধ শিশু নারী এবং অসুস্থ মানুষের কষ্ট দেখলে বিবেকবান যে কারোরই কষ্ট লাগবে। সড়কের ইছাখালী এবং ঘাটচেক অংশে যানজট কিছুটা সহনীয় হলেও রোয়াজারহাট স্টেশনে যানজট লেগে থাকা যেন অতি স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। তাছাড়া রোয়াজারহাটে সাপ্তাহিক বাজারবার সোমবার এবং শুক্রবারে শত শত গাড়ি যানজটে আটকে থাকে। এভাবে রোয়াজারহাট স্টেশনে মানুষের দুর্ভোগ পোহানোর সাথে সাথে নষ্ট হচ্ছে হাজারো কর্মঘন্টা। মরিয়ম চৌমুহনী স্টেশন উত্তর রাঙ্গুনিয়া রাণিরহাট হয়ে যুক্ত হয়েছে পার্বত্য জেলা রাঙামাটির সাথে। অপরদিকে নদী পার হওয়ার ব্যবস্থা থাকায় দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়ার শিলক কোদালা পদুয়ার মানুষের যাতায়াতও আছে মরিয়ম নগর চৌমুহনী দিয়ে। তাছাড়া মরিয়ম নগর স্টেশন রাঙ্গুনিয়ার একমাত্র সরকারি কলেজ রাঙ্গুনিয়া কলেজ, নূরুল উলুম কামিল মাদ্রাসা, শতবছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী দরবার রাহাতিয়া দরবার লাগোয়া স্টেশন হওয়াতে মানুষের যাতায়াত অন্যান্য স্টেশন থেকে অনেকটা বেশি। তাই সঙ্গত কারণেই মরিয়মনগর চৌমুহনী স্টেশন এমনিতেই যানজট প্রবণ স্টেশন। এর উপর সরু রাস্তা অসংখ্য দোকানপাট হওয়ার কারণে গাড়ির জ্যাম লেগেই থাকে। আর রাঙ্গুনিয়া অংশের সর্বশেষ স্টেশন লিচুবাগান পর্যন্ত পৌঁছাতে এভাবে নষ্ট হচ্ছে হাজার হাজার মানুষের লক্ষ লক্ষ কর্মঘণ্টা। অথচ, সময় হলো অমূল্য সম্পদ। বর্তমান বিশ্ব যেখানে সময় বাঁচাতে নানামুখী সৃজনশীল পদক্ষেপ গ্রহণ করছে, সেখানে চট্টগ্রাম-কাপ্তাই মহাসড়কে চলাচল করতে গিয়ে যানজট এবং সড়ক সরু হওয়ার কারণে বানের পানির মতো মানুষের সময় অপচয় হচ্ছে। মাত্র ৫২ কিলোমিটারের চট্টগ্রাম-কাপ্তাই মহাসড়ক পাড়ি দিতে যেখানে সময় লাগার কথা বড়জোর ঘণ্টা খানেক, সেখানে ৩ ঘণ্টারও অধিক সময় লেগে যায়। দ্রুত পৌঁছাতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় ঘটছে মর্মান্তিক মৃত্যু। প্রতিনিয়ত বাড়ছে মৃত্যু ঝুঁকি।
একসময়ের পিছিয়ে পড়া বাংলাদেশ সময়ের সাথে সাথে অনেক দূর এগিয়েছে। দেশের আনাচেকানাচে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে সারাদেশে। আঞ্চলিক সড়ক যোগাযোগে যুগান্তকারী মাইলফলক উন্মোচন করতে পারে, এমন একটি সড়ক হলো চট্টগ্রাম-কাপ্তাই মহাসড়ক। এই চট্টগ্রাম-কাপ্তাই মহাসড়ককে যদি দুই লেন থেকে চার লেনে উন্নীত করা হয়, তাহলে চট্টগ্রাম-কাপ্তাই মহাসড়ক লাগোয়া নগরীর চাঁন্দগাও, অন্যন্যা আবাসিক হয়ে নগরীর অক্সিজেন বায়েজিদ, জেলার হাটহাজারী রাউজান রাঙ্গুনিয়া এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের মধ্যে আঞ্চলিক সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে দারুণ সম্ভাবনা উন্মোচিত হতে পারে। তাছাড়া কাপ্তাই রাস্তার মাথা হয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রামের বৃহৎ অংশের সাথেও চট্টগ্রাম-কাপ্তাই মহাসড়কের সংযোগ ঘটেছে, যার ফলে দক্ষিণ চট্টগ্রামের বৃহৎ একটি অংশের এমনকি কক্সবাজার টেকনাফের সাথেও ব্যবসা বাণিজ্য বৃদ্ধির পাশাপাশি যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ এবং ত্বরান্বিত হবে সুনিশ্চিতভাবেই। দুই লেনের চট্টগ্রাম-কাপ্তাই মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীত না করে দুই লেনের চট্টগ্রাম কাপ্তাই সড়ককে জোড়াতালি দিয়ে কয়েক বছর পর-পর যতোই মেরামত করা হোক না কেন, আখেরে কাজের কাজ কিছুই হয়না; হবেনা। উপরন্তু ১৯৬৩ সালে নির্মিত দুই লেনের চট্টগ্রাম-কাপ্তাই মহাসড়ক বড় বড় ডিস্ট্রিক যাত্রীবাহী বাস, মালবাহী ট্রাক, কাভার্ড ভ্যানের ওজন সহ্য করতে না পারার কারণে মেরামতের কয়েক মাস পরই এই মহাসড়কে খানাখন্দের সৃষ্টি হচ্ছে এবং জায়গায় জায়গায় বড় বড় গর্তেরও সৃষ্টি হচ্ছে। যার ফলে গাড়ি এক্সিডেন্ট হওয়ার পাশাপাশি দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণে, জীবন এবং সময় বাঁচাতে চট্টগ্রাম-কাপ্তাই মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীত করা সময়ের চাহিদায় পরিণত হয়েছে।
চট্টগ্রাম-কাপ্তাই মহাসড়ককে যদি দুই লেন থেকে চার লেনে উন্নীত করা হয় এবং এই মহাসড়কে থাকা সেতুগুলোও চার লেন করা হয়, তাহলেই সব সমস্যার সমাধান হবে সুন্দর এবং সহজভাবে। তখন মহাসড়কটি অধিক মাত্রায় যান চলাচলের উপযোগী হবে এবং দুর্ঘটনাও অনেকাংশে হ্রাস পাবে নিশ্চিতভাবে। তাছাড়া সরকারের সড়ক বিভাগ এবং বিভিন্ন সরকারি দপ্তর সংস্থার বহু জায়গা চট্টগ্রাম-কাপ্তাই মহাসড়কের দুই পাশে দখল বেদখল পতিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। সেই জায়গাগুলির যথাযথ ব্যবহার করে সড়কটিকে চার লেনে উন্নীত করা যেতে পারে সহজেই। তাই সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে চট্টগ্রাম-কাপ্তাই মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করণ এবং মহাসড়কটিতে থাকা সেতুগুলোও চার লেনে করাসহ চট্টগ্রাম-কাপ্তাই মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করা হলেই মহাসড়কটি বড় বড় যান চলাচলের উপযোগী হবে, দুর্ঘটনা হ্রাস পাবে এবং যাতায়াত করা লক্ষ মানুষের জীবন এবং সময় বাঁচবে। যা সময়ের এবং যাতায়াতকারী লক্ষ মানুষের দাবিও বটে।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা সংগঠক, চট্টগ্রাম-কাপ্তাই মহাসড়ক চারলেন বাস্তবায়ন সংগ্রাম কমিটি