চট্টগ্রামের ৫৯ শতাংশ রোগীই বাবা-মা’র জিন থেকে আক্রান্ত

3

আসহাব আরমান

চট্টগ্রামের থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে প্রায় ৫৯ শতাংশ রোগী হিমোগ্লোবিন ই-বি থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত। পিতামাতার কাছ থেকে সন্তান যদি হিমোগ্লোবিন ই এবং বিটা থ্যালাসেমিয়ার জিন উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হয়, পরবর্তীতে শিশুটি হিমোগ্লোবিন ই-বিটা থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হয়। বিটা থ্যালাসেমিয়া জিন শরীরকে স্বাভাবিক পরিমাণের চেয়ে কম হিমোগ্লোবিন তৈরি করতে নির্দেশ দেয়। এই দুটি জিন একটি শিশুর মধ্যে একত্রিত হয়ে লোহিত রক্ত কণিকা ধ্বংস করে দেয়। ফলে শিশুটি ই-বিটা থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত হয়। অসচেতনতার কারণে থ্যালাসেমিয়া আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানা যায়, মানুষের রক্তে তিন ধরনের কোষ থাকে। লোহিত রক্তকণিকা তার একটি। সেখানে হিমোগ্লোবিন নামে বিশেষ ধরনের রঞ্জক পদার্থও থাকে। এই হিমোগ্লোবিনের কাজ হলো শরীরের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেন সরবরাহ করা। আর হিমোগ্লোবিন তৈরি হয় আলফা চেইন ও বিটা চেইন নামক দুই রকম চেইনের সমন্বয়ে। এর কোনোটাতে সমস্যা হলে হিমোগ্লোবিনের উৎপাদন ব্যাহত হয়। তৈরি হয় ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন। স্বাভাবিক লোহিত কণিকার আয়ুষ্কাল ১২০ দিন। ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিনের কারণে লোহিত কণিকার আয়ুষ্কাল কমে যায় এবং লোহিত কণিকাগুলো সহজেই ভেঙে যায়। এ অবস্থায় শরীরে রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। সেখান থেকে দেখা দেয় নানা রকম উপসর্গ। পরবর্তীতে রোগী থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হয়।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের হেমাটোলজি বিভাগের এক হিসাবে দেখা গেছে, গত এক বছরের বিভাগে ২৩০ জন থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে ১৩৬ জনই ই-বিটা থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত। যা মোট রোগী ৫৯ শতাংশ। এছড়া বিটা থ্যালাসেমিয়া ২১ শতাংশ, হিমোগ্লোবিন-ই থ্রেইট ১০ শতাংশ, বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজর ৬ দশমিক ৪৩ শতাংশ, হিমোগ্লোবিন ই ডিজিজ ১ দশমিক ৭৩ শতাংশ এবং হিমোগ্লোবিন এইচ ডিজিজ শূন্য দশমিক ৪৩ শতাংশ রোগী।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বে প্রায় ১০ কোটির বেশি লোক বিভিন্ন ধরনের বিটা থ্যালাসেমিয়ার জিন বহন করে। প্রতিবছর প্রায় এক লাখ শিশুর জন্ম হচ্ছে জটিল থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ে। বাংলাদেশে ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ থ্যালাসেমিয়ার জিন বহন করছে। ৩ শতাংশ লোক বিটা থ্যালাসেমিয়ার বাহক, ৪ শতাংশ অন্যান্য ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন রোগের বাহক। প্রতিবছর ৭ হাজার শিশু বিভিন্ন রকমের থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই রোগ থেকে বাঁচতে দরকার সচেতনতা। বিয়ের সময় স্বামী-স্ত্রী দুজনেই যাতে থ্যালাসেমিয়ার বাহক না হয় সেটা খেয়াল রাখা জরুরি। সে জন্য বিয়ের আগে দুজনের শরীর পরীক্ষা করে নেয়া উত্তম। শিশুর রক্তশূন্যতার সমস্যা তৈরি হলে রক্তরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে চিকিৎসা নিতে হবে। রোগীকে পর্যাপ্ত রক্ত সাঞ্চালন করতে হবে। এসব বিষয়গুলো মেনে চললে থ্যালাসেমিয়া নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
এ বিষয়ে চমেক হাসপাতালের হেমাটোলজি বিভাগের প্রধান প্রফেসর ডা. মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী পূর্বদেশকে বলেন, থ্যালাসেমিয়া একটি রক্তরোগ। এই রোগের বিভিন্ন প্রকারভেদ রয়েছে। তবে চমেক হাসপাতালের আসা রোগীদের মধ্যে প্রায় ৫৯ শতাংশ রোগী হিমোগ্লোবিন ই-বি থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত। পিতামাতার কাছ থেকে সন্তান যদি হিমোগ্লোবিন ই এবং বিটা থ্যালাসেমিয়া জিন উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হয়, পরবর্তীতে শিশুটি হিমোগ্লোবিন ই-বিটা থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হয়। থ্যালাসেমিয়া রোগের চিকিৎসা রক্তশূন্যতা দূর করতে রক্তসঞ্চালন ও বোনমেরো ট্রান্সপ্ল্যান্ট। অতিরিক্ত রক্ত সঞ্চালনের কারণে রোগীর শরীরে আয়রনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। অন্যদিকে বোনমেরু ট্রান্সপ্ল্রান্ট করতে হলে কমপক্ষে ৩৫ থেকে ৪০ লাখ টাকা প্রয়োজন হতে পারে।
তিনি বলেন, আমাদের দেশে অসচেতনতার কারণে এই রোগ আরও জটিল হয়ে ওঠে। একজন শিশুর দেড় বছর বয়স থেকে থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণ দেখা দেয়। কিন্তু অভিভাবকরা রোগী রক্তরোগ বিশেষজ্ঞের পরিবর্তে একজন সাধারণ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। ফলে ভুল চিকিৎসায় কারণে শিশুর শরীরে মাথা, মুখ, লিভার ও হার্টসহ বিভিন্ন অঙ্গে জটিলতা তৈরি হয়। তখন চিকিৎসায় অনেক সময় রোগী মারা যায়। তাই রক্তরোগের বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে। রক্তরোগ বিশেষজ্ঞের কাছেই এসব রোগের চিকিৎসা নিতে হবে।
চমেক হাসপাতালে হেমাটোলজি বিভাগ প্রতিষ্ঠা হয় ২০০৮ সালে। এরপর থেকে বিভাগটিতে থ্যালাসেমিয়াসহ বিভিন্ন রক্তরোগের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ২০১৯ সালে থ্যালাসেমিয়া রোগ পরীক্ষার জন্য ল্যাব প্রতিষ্ঠা হয়। বর্তমানে এই ল্যাবে ৮০০ টাকায় থ্যালাসেমিয়া পরীক্ষা করা হয়। যা বাইরের ল্যাবে করতে গেলে প্রায় দুই হাজার টাকা লাগে। বোনমেরু ট্রান্সপ্ল্যান্ট কর্নারের কাজ চলমান রয়েছে। এটি সম্পন্ন হলে চমেক হাসপাতালে থ্যালাসেমিয়া চিকিৎসা আরও গতিশীল হবে। বিভাগটিতে তিন চিকিৎসকের মধ্যে দুটি পদ দীর্ঘদিন খালি ছিল। সম্প্রতি একটি পদে চিকিৎসক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অবশিষ্ট পদ এখনও শূন্য। চট্টগ্রামের রক্তরোগের চিকিৎসক তৈরি করা অতীব জরুরি বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে ডা. মোহম্মদ গোলাম রাব্বানী বলেন, আমি ৩০ বছর ধরে রক্তরোগের চিকিৎসা দিচ্ছি। আমার অবসরের আর কয়েকমাস বাকি আছে। রক্তরোগের অধিকাংশ ডাক্তার ঢাকায়। তাই চট্টগ্রাম থেকে রক্তরোগের চিকিৎসক তৈরিতে কাজ করতে হবে। হেমাটোলজি বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত ক্লাসরুম ও ল্যাব সুবিধা রাখতে হবে।
বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস: আজ ৮ মে বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস। প্রতি বছরের মত এ বছরও সারা বিশ্বে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুদের জন্য এ দিবস আনন্দের সাথে পালিত হয়। ১৯৯৪ সাল থেকে থ্যালাসেমিয়া ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন প্রতি ৮ মে এ দিবস পালন করার জন্য সকলকে আহবান করে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হয়।