চট্টগ্রামের থানাগুলোয় যেভাবে কাজ চলছে

7

পূর্বদেশ ডেস্ক

কোতোয়ালী থানার ‘যাত্রী সেবা’ ঘরে বসে আছেন এক পুলিশ সদস্য। তাকে ঘিরে বসে আছেন কিছু সাধারণ মানুষ, যাদের বেশিরভাগই থানায় এসেছেন সাধারণ ডায়েরি বা জিডি করতে। ডিউটি অফিসারের দায়িত্বে থাকা এএসআই মাহবুব বললেন, থানার ভেতরে বসার অবস্থা নেই। পরিষ্কার আর সংস্কারের কাজ চলছে। তাই এই কক্ষে বসেই কাজ করতে হচ্ছে। পুলিশের এই কর্মকর্তার ভাষ্য, ৮ অগাস্ট থেকে তারা স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু করেছেন। লোকজন আসছেন সেবা নিতে তবে বেশিরভাগ জিডি করতে। এর মধ্যে আবার মোবাইল হারানোর জিডিই বেশি।
গত ৫ অগাস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে দেশান্তরী হন শেখ হাসিনা। এরপর দেশের বিভিন্ন স্থানের মত চট্টগ্রামেও পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা হয়।
আগুনে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে কোতোয়ালী, পাহাড়তলী, পতেঙ্গা, ইপিজেড থানা। লুটপাট হয়েছে অস্ত্রাগার, মালখানা। কোতোয়ালী, পাহাড়তলী থানা ভবনের অবকাঠামো ছাড়া অবশিষ্ট কিছুই নেই। আর পতেঙ্গা ও ইপিজেড থানা একেবারেই ব্যবহারের অনুপোযোগী হয়ে গেছে। খবর বিডিনিউজ’র
এক পুলিশ কর্মকর্তার ভাষ্য, পুলিশ এখন ‘ঢাল তলোয়ারবিহীন নিধিরাম সর্দার’। অস্ত্র, গাড়ি, লজিস্টিক- কিছুই নেই। পুলিশ লাইন্স থেকে নতুন জিনিসপত্র পাঠানো হচ্ছে, তবে সেগুলো প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। পরিস্থিতির কারণে কোথাও কোনো অভিযান নাই, কোনো তদন্তে যেতে পারছে না। কারো সমস্যা হলেও পুলিশ দ্রুত সাপোর্ট দিতে পারছে না। তবে হতাশার মধ্যেও আবার ঘুরে দাঁড়ানোর আশার আলো দেখছি, এটাই আমাদের সান্ত্বনা,” বলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই পুলিশ কর্মকর্তা।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পুলিশ দাপ্তরিক কার্যক্রম পরিচালনা করলেও ঘটনার ১০ দিন পরও এককভাবে টহলে যাচ্ছে না। প্রতিদিন সেনাবাহিনীর সঙ্গে যৌথ টহল পরিচালনা করছে থানার টিমগুলো।
বৃহস্পতিবার বেলা ১২টার দিকে পাহাড়তলী থানায় গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন শ্রমিক মূল ফটক মেরামতের কাজ করছেন। কোতোয়ালীর মত এ থানাটিও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ভবনের অবকাঠামো ছাড়া অবশিষ্ট কিছুই নেই।
থানার ভেতরে ঢুকতেই দেখা যায়, একটি বড় কক্ষে বসে আছেন ওসি কেপায়েত উল্লাহ। একই রুমে বসে আছেন আরও পাঁচ-ছয়জন কর্মকর্তা, পুরুষ ও নারী কনস্টেবলরা, নিজেরা গল্প করছেন।
ওসি কেপায়েত উল্লাহ বলেন, থানা আক্রমণের পর তাদের অস্ত্রাগার লুট করে নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে থানার সব গাড়ি।
তিনি বলেন, “থানার সব নথিপত্র পুড়ে গেছে। কম্পিউটার থেকে শুরু করে বিভিন্ন জিনিসপত্র লুটপাট করে নিয়ে গেছে। আমরাতো কোথাও মুভ করতে পারছি না। দৈনন্দিন দাপ্তরিক কাজগুলো কম্পিউটারের পরিবর্তে কাগজে কলমে এবং মোবাইলে লিখে চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। তবে সেনাবাহিনীর সাথে প্রতিদিন থানার পুলিশ সদস্যরা পেট্রোলিং ডিউটি করছে। গত এক সপ্তাহে থানায় কেউ জিডি কিংবা মামলা করেনি বলেও জানান ওসি।
হালিশহর থানার ওসি কায়সার হামিদ বলেন, থানার বাইরে গাড়িতে আগুন দিয়েছে। থানা ভবনে আগুন না দিলেও আসবাবপত্র থেকে শুরু করে সবকিছুই লুটপাট করে নিয়ে গেছে। থানায় কোনো কম্পিউটার নেই, কাগজে-কলমে দাপ্তরিক কার্যক্রম চলছে। অনলাইন না থাকায় সাধারণ ডায়েরি নেওয়া হচ্ছে পুরনো পদ্ধতিতে।
শেখ হাসিনা সরকারের ক্ষমতা ছাড়ার পর নগরজুড়ে পুলিশের স্থাপনায় যে হামলার ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে পতেঙ্গা ও ইপিজেড থানা ভবন ব্যবহারের অনুপোযোগী হয়ে গেছে। পতেঙ্গার ওসি মাহফুজুর রহমান থানায় হামলার আগের দিন ৪ অগাস্ট থানায় যোগ দেন। পরদিনই থানা আক্রমণের ঘটনা ঘটে।
ওসি মাহফুজ বলেন, “থানা ভবন আর ব্যবহারের উপযোগী নেই। কর্ণফুলী টানেলের পশ্চিম প্রান্তে যে ফাঁড়ি নির্মাণ করা হয়েছিল সেখানে থানার দাপ্তরিক কাজ চলছে। লোকজন জিডি করতে আসলে আমরা সেগুলো গ্রহণ করছি।”
ইপিজেড থানার ওসি মোহাম্মদ হোসেন বলেন, শনিবার থেকে তাদের থানার দাপ্তরিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। গত ছয় দিন ধরে বন্দর ৫ নম্বর গেইট সংলগ্ন নিউমুরিং পুলিশ ফাঁড়িতে দাপ্তরিক কাজ করেছেন তারা। শুক্রবার থেকে ফ্রি পোর্ট সংলগ্ন ইপিজেড পুলিশ ফাঁড়িতে তাদের দাপ্তরিক কাজ করবেন।
“পুরনো একটি ভবনে আগে থানার কার্যক্রম পরিচালিত হত। এখন সেটি ব্যবহারের অনুযোযোগী। থানার কাছে ইপিজেড ফাঁড়ি সংস্কার করা হয়েছে। সেখানে আমরা শুক্রবার থেকে আমাদের কার্যক্রম পরিচালনা করব,” বলেন তিনি।
থানায় যারা জিডি করতে আসছেন তাদের জিডি গ্রহণ করা হচ্ছে বলেও জানান ওসি মোহাম্মদ হোসেন। তবে যেসব থানায় হামলার ঘটনা ঘটেনি সেগুলোতে কার্যক্রম চলছে স্বাভাবিক।
চান্দগাঁও থানায় গত ৫ অগাস্ট এই থানায় হামলার চেষ্টা হলেও ভেতরে ঢুকতে পারেনি লোকজন। থানার ফটক ও ঢিলের আঘাতে জানালার কয়েকটি কাঁচ ভাঙ্গলেও স্বাভাবিক অবস্থায় আছে থানা ভবন।
গত বৃহস্পতিবার দুপুর দুইটার দিকে চান্দগাঁও থানায় গিয়ে দেখা যায়, ডিউটি অফিসারের কক্ষে কয়েক জন নারী দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলছেন ডিউটি অফিসার। নিজ কক্ষে পাওয়া যায় ওসি জাহিদুল কবীরকে। থানা ভবন অক্ষত থাকায় নিজ নিজ কক্ষে বসে কাজ করতে দেখা গেছে অন্যান্য কর্মকর্তাদেরও।
ওসি জাহিদুল কবীর বলেন, “থানা অক্ষত থাকায় আমরা প্রতিদিন অফিসে এসেছি। ৯ তারিখ থেকে আমরা আমাদের কার্যক্রম শুরু করেছি। লোকজন আসছেন, তাদের সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি। চারটি মাদক ও একটি মারামারিসহ এক সপ্তাহে পাঁচটি মামলা রেকর্ড হয়েছে। সাতটি হারানো জিডি ও পাঁচটি নন জিআর জিডি হয়েছে। থানায় কোনো সমস্যা না হওয়ায় অনলাইনে জিডি গ্রহণ করা হচ্ছে।”
ওসি বলেন, “আমরা স্বাভাবিক কার্যক্রম করার চেষ্টা করছি। প্রতিদিন সেনাবাহিনীর সাথে যৌথ অভিযানে যাচ্ছে আমাদের সদস্যরা।”