গুমের ঘটনা জাতিসংঘের অধীনে তদন্ত চান ফখরুল

4

পূর্বদেশ ডেস্ক

বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে ‘গুমের’ যেসব অভিযোগ উঠেছে, জাতিসংঘের অধীনে তার তদন্তের উদ্যোগ নিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে গতকাল শুক্রবার বিকালে রাজধানীতে এক সংহতি সভায় তিনি গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারকে সরকারের তরফ থেকে ভাতা দেওয়ারও দাবি জানিয়েছেন।
ফখরুল বলেন, ‘দীর্ঘকাল রাজনীতিতে আছি, অ্যারেস্ট হওয়া জানতাম, হত্যা করা জানতাম কিন্তু গুম করে দেওয়া এটা আমাদের জানা ছিল না। এই আওয়ামী লীগ তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবহার করে ভয়াবহ মানবতাবিরোধী যে অপরাধ, সেই অপরাধ সংঘটিত করেছে। আজকে অত্যন্ত ভালো কথা, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস গুমবিরোধী জাতিসংঘের যে সনদে সই করেছেন। আমরা জানতাম আগের সরকার এটাতে (জাতিসংঘ সনদ) সই করে নাই’। খবর বিডিনিউজের
ফখরুল বলেন, ‘আরও ভালো লাগছে যে,এই প্রথম বাংলাদেশে এই স্বৈরাচারের অপকর্মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা করবার জন্য জাতিসংঘ থেকে একটি দল এসেছে; এটা প্রাথমিক দল, ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং টিম। কিন্তু এদের যে টার্মস অব রেফারেন্স, গত দুই মাসে যে হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে, সেটা তারা তদন্ত করবে। আমি সরকারের কাছে আহ্বান জানাতে চাই, যে আপনারা জাতিসংঘের যে মানবাধিকার কমিশন আছে, তাদের সাথে কথা বলেন। গত ১৫ বছর ধরে আজ পর্যন্ত যতগুলো মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে, হত্যা হয়েছে, গুম হয়েছে প্রত্যেকটির তদন্তের ব্যবস্থা করুন। এটা আপনারা (অন্তর্বর্তীকালীন সরকার) বললে জাতিসংঘ অবশ্যই করবে’।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘আমরা অত্যন্ত জোরের সঙ্গে, দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই, ২০০৯ সাল থেকে আজ পর্যন্ত যে অত্যাচার-নিপীড়ন-হত্যাকান্ড, গুমের ঘটনা হয়েছে, প্র্রত্যেকটির তদন্ত এই জাতিসংঘের কমিটি দিয়ে করতে হবে এবং তার ব্যবস্থা সরকারকে নিতে হবে’।
গুমের শিকার ব্যক্তিদের সন্ধানে তদন্ত কমিশন গঠনের প্রসঙ্গ টেনে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘আমি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ধন্যবাদ জানাতে চাই, একটা কমিশন গঠন করেছেন। এটা একটা ভালো উদ্যোগ। কিন্তু একই সঙ্গে আজকে আমি আহ্বান জানাতে চাই, আপনারা প্রত্যেকটি গুম হওয়া পরিবারকে ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। কারণ আমরা জানি এখানে অনেক পরিবার আছে, যারা অনেক কষ্ট করে তাদের পরিবার চালাচ্ছে, ছেলে-মেয়েদেরকে মানুষ করছে, স্কুল-কলেজে পড়াচ্ছে। এটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব এই পরিবারগুলোর পাশে এসে দাঁড়ানো। গণতন্ত্র এসেছে, আমরা গণতন্ত্র উপভোগ করব। কিন্ত এই গুম হওয়া পরিবারের বাচ্চাগুলো তাদের যে লস হয়েছে, পিতাকে হারিয়েছে তা কোনোদিন ফেরত পাবে না। যে নারী তার স্বামীকে হারিয়েছে সে তা ফেরত পাবে না। তাই এই রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে এই পরিবারগুলোর দায়িত্ব গ্রহণ করা’।
গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের ‘বেদনা-কষ্টে’র সঙ্গে সহমর্মিতা প্রকাশ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এই বাচ্চাটা, সাফা, সে যখন বলছে, ‘আমি আমার বাবার হাত ধরে রাস্তায় হাঁটতে চাই, ঈদের নামাজ পড়তে যেতে চাই’, তখন পিতা হয়ে আমি তার কষ্ট সংবরণ করতে পারি না। আজকে তাদের সেই অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। যারা গুমের ঘটনার জন্য দায়ী, আমরা তাদের কমবেশি চিনি। যারা দায়িত্বে ছিলেন, র‌্যাবের দায়িত্বে ছিলেন, পুলিশের বিশেষ বাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন, তাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে, তাদেরকে শাস্তি দিতে হবে’।

‘কেন গ্রেপ্তার হচ্ছে না?’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমরা খুব কষ্ট পাই যখন দেখি রাজনৈতিক নেতাদেরকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু ওই সমস্ত ভয়ঙ্কর ব্যক্তি, যারা আমাদের হত্যা করেছে, খুন করেছে, গুম করেছে, তাদের একজনকেও গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। আমরা আশা করি, খুব অল্প সময়ের মধ্যে তাদের গ্রেপ্তার দেখতে পাব, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দেখতে পাব। সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশ যেন একটা জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে, সেজন্য আমরা কাজ করতে সক্ষম হব’।
আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে গতকাল শুক্রবার নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এই সংহতি সভা হয়। বিএনপিসহ অঙ্গসংগঠনের ‘গুম হওয়া’ ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা তাদের কষ্টের কথা অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন।

‘শেখ হাসিনার ক্ষমতায় থাকার প্রকল্প গুম’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘এই গুম-হত্যার প্রকল্প; আমি এটা বলি একটা প্রকল্প। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকার জন্য একটা সার্বিক প্রকল্প করেছিলে, গুম তার একটি প্রকল্প ছিল। অর্থাৎ গুমের মাধ্যমে ভয়-ভীতি সঞ্চার করে সাধারণ মানুষ যাতে তার (শেখ হাসিনা) স্বৈরশাসনের বিরোধিতা করতে না পারে সেজন্য এই প্রকল্পে সে নিয়েছিল। সুতরাং এই প্রকল্পের মূল উদ্যোক্তা মূল নায়ক শেখ হাসিনা। এই প্রকল্পের যারা নেতৃত্বে দিয়েছেন, তাদের স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে হবে, এই প্রকল্পে যারা সহায়তা দিয়েছে, সেই সত্য উদ্ঘাটন করতে হবে। যারা জেনেশুনে চোখ বন্ধ করে ছিল, জেনেও না জানার ভান করে ছিল, দেখেও না দেখার ভান করে ছিল, তাদেরকেও সামনে আনতে হবে। মোট কথা এই প্রকল্পের সার্বিক সত্যতা জনসম্মুখে আনতে হবে’।

‘সর্ষের মধ্যে ভূত’
৬১ দিন নিখোঁজ থাকার পর ভারতের শিলংয়ে উদ্ধার হওয়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদও উপস্থিত ছিলেন গুম প্রতিরোধ দিবসের এ অনুষ্ঠানে। তিনি বলেন, ‘আমি আজকে খোলাসা করে বলতে চাই, আয়নাঘরের প্রধান খলনায়ক ছিল বেনজীর (সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ) ও জিয়াউল আহসান (এনটিএমসির সাবেক মহাপরিচালক)। একজন চাকুরিচ্যুত (জিয়াউল আহসান) হয়েছে, গ্রেপ্তার হয়েছে। এখানে একজন বলে গেছেন, জিয়াউল আহসানকে কোনো ইন্টারোগেশন করা হচ্ছে না। আমি একমত। আপনারা সংবাদপত্রের বন্ধুরা কেউ কি দেখেছেন জিয়াউল আহসান আজ পর্যন্ত কারো গুমে তার ভ‚মিকার কথা স্বীকার করেছে? করে নাই। কারণ জিয়াউল আহসানের পেছনে যারা ফ্যাসিবাদকে রক্ষা করার জন্য, হাসিনাকে রক্ষা করার জন্য, ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার জন্য যারা কাজ করেছিল, তারা এখনো রাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় আছে। আমি বলতে চাই সরিষার মধ্যে ভ‚ত রেখে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কোনো কিছু অর্জন করতে পারবে না’।
সালাহ উদ্দিন বলেন, ‘জিয়াউল আহসানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, এখন এমনভাবে তাকে ইন্টারোগেশন করা হোক, তার নেতৃত্বে বাংলাদেশে যত গুম-খুন-অপহরণ হয়েছে, আগামি ২/৩ দিনের মধ্যে তা বলতে যেন সে বাধ্য হয়। অন্যথায় জেনে রাখবেন, চাপ দিচ্ছি না সরকারের ওপরে, ছাত্র-জনতা এখনো আন্দোলনে আছে, যথাযথ ইন্টারোগেশন করা হবে’।
এক সময় র‌্যাবের নেতৃত্বে থাকা বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে ধরে এই বিএনপি নেতা বলেন, ‘বেনজীর এই গুম-খুনের জন্য একজন মহা খলনায়ক। হাসিনার দুঃশাসন টিকিয়ে রাখার জন্য যার ভূমিকা ছিল অপরিসীম। সে এখন কোথায়? তাকে খুঁজে বের করতে হবে। সে যেখানেই আছে, পৃথিবীর যেখানে থাকুক, সেখান থেকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এসে আমাদের কাছে সোপর্দ করতে হবে, বাংলাদেশে তার ন্যায়বিচার করতে হবে। ডিবির হারুণ (অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হারুন অর রশীদ), মনিরুল ইসলাম (সাবেক এসবি প্রধান) কোথায়? চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন (সাবেক আইজিপি) কোথায়? তাদের গ্রেপ্তার করে, তদন্ত করতে হবে, বিচার করতে হবে এটা শত শহীদের রক্তের অঙ্গীকার’।
সালাহ উদ্দিন বলেন, ‘এই গুম-খুনের রাজত্ব কয়েম করেছে তিনি হলেন শেখ হাসিনা। নাম্বার ওয়ান থেকে শুরু করতে হবে। শেখ হাসিনা দিল্লি গিয়ে পালিয়ে আছে। আমি দাবি করছি, দিল্লির সরকার, তাকে ফেরত দেন। যদি ফেরত না আনা হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক আদালতে তার বিচার করা হবে। সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ (আজিজ আহমেদ) বাংলাদেশে বহু গুম-খুনের নায়ক। তাকে গ্রেপ্তার করতে হবে’।
তুলে নেওয়ার পর ‘আয়না ঘরে’ নির্মম নির্যাতনের বিভীষিকাময় দিনগুলোর কথাও তুলে ধরেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী সালাহ উদ্দিন আহমেদ।

‘এখনো পূর্ণ গণতন্ত্র পাইনি’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এখানে যারা আছে, আমাদের দলের নেতা-কর্মীরা অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে এখন পর্যন্ত আমরা পূর্ণ গণতন্ত্র পাইনি। আসুন আমরা এই সরকারের সঙ্গে, যেটা আমাদের আন্দোলনের ফসল, তাকে আমরা সর্বাত্মক সহযোগিতা করি এবং এই সহযোগিতার মধ্য দিয়ে এই সরকার যেন সক্ষম হয় সফলভাবে একটি সংস্কারের মধ্য দিয়ে একটি নির্বাচন করতে, যে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের প্রতিনিধি নির্বাচিত হবে, তারা একটা পার্লামেন্ট গঠন করবেন, সরকার গঠন করবেন, জনগণের সমস্যার সমাধান করা যাবে’।
দলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্যে ফখরুল বলেন, ‘সন্তুষ্টির কোনো কারণ নাই। এখনো অনেক ষড়যন্ত্র হচ্ছে, এখনো দেশে-বিদেশে ষড়যন্ত্রের অভাব নেই। অপেক্ষা করে আছে, কখন সুযোগ পাবে, সেই সুযোগে তারা স্বাধীনতাকামী মানুষের ওপর অ্যাটাক করবে। তাই আজকে যে ঐক্য, ইস্পাতকঠিন ঐক্য তৈরি হয়েছে, সেটাকে আরও সুদৃঢ় করতে হবে। আমরা এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাফল্য চাই, আমরা চাই, তারা অতিদ্রæত এই গণতন্ত্র ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করবেন, সংস্কারের ব্যবস্থা করবেন’।
বিএনপির মহাসচিবের সভাপতিত্বে ও প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর সঞ্চালনায় সমাবেশে বিএনপির মানবাধিকার কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট ফারজানা শারমিন পুতুল, গুম হওয়া ইলিয়াস আলী স্ত্রী তাহসিনা রুশদির লুনা, চৌধুরী আলমের মেয়ে খাদিজা আখতার, মায়ের ডাকের সমন্বয়ক সানজীদা ইসলাম তুলিসহ গুম হওয়া পরিবারের কয়েকজন সদস্য বক্তব্য দেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্মরণ করে বিশেষ মোনাজাত হয়।