গাহি সাম্যের গান

1

সাঈফী আনোয়ারুল আজীম

সাম্য, দ্রোহ, প্রেম ও মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫ তম জন্মবার্ষিকী আজ। ১৮৯৯ সালের ২৫ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোলের চুরিলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম জনপ্রিয় এই বাঙালি কবি। বহুগুণে গুণান্বিত, অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম এই উপমহাদেশে সাম্য ও বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত। তিনি ঔপনিবেশিক শাসন- শোষণের বিরুদ্ধে ছিলেন চির বিদ্রোহী। তার খুরধার লিখনীর মাধ্যমে তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। রচনা করেন বিদ্রোহী কবিতা ও গান। কবির বিদ্রোহী কবিতা ও গান ছিল ব্রিটিশদের জন্য বড়ো আতংক। তার প্রতিবাদী কবিতার মাধ্যমে নড়েচড়ে বসতো ব্রিটিশদের রাজদরবার। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে রচিত বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি ভারতবাসীকে জাগিয়ে তুলেন। উপাধি পান বিদ্রোহী কবি হিসেবে। আবির্ভূত হন বিদ্রোহী নজরুল হিসেবে। ঔপনিবেশিক শাসনের অপশক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে কবি লিখেছিলেন,
‘মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, / অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত!’
নজরুলের এসব সাহসী উচ্চারণের কবিতা আজও আমাদের চলার পথে অন্তহীন প্রেরণার উৎস। মুক্তিকামী মানুষের সাহস ও অনুপ্রেরণা। তার কবিতা মুক্তিকামী মানুষকে উজ্জীবিত করে তোলে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নজরুলের কবিতা ও গান ছিলো শক্তি আর সাহসের জয়গান। অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক দ্রোহের প্রতীক।
নজরুল তার সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে অন্যায় আর শোচনের প্রতিবাদ করে গেছেন, মানবতার পক্ষে কথা বলেছেন, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তার কবিতা ও গান যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেছে। উজ্জীবিত করেছে এই উপমহাদেশের অবহেলিত ও শোষিত মানুষকে। একারণে কবি ব্রিটিশ শাসকদের চক্ষুশূলে পরিণত হন। ব্রিটিশরা তাঁকে কারাবন্দী করেন। অসীম সাহসী কবি কারাগারেও বসে থাকেননি, তিনি কারাগারে থাকাবস্থায় লিখেছিলেন ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’
নজরুলের সাহিত্য রচনা আমাদেরকে স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। সমাজে শান্তি, সাম্য ও মানবতা প্রতিষ্ঠার আত্মনিয়োগে উৎসাহিত করে।মানবতা ও সাম্যের কবি লিখনীর মাধ্যমে আহ্বান করেছেন অন্যায়ের শৃঙ্খল ভেঙে ফেলতে। কবির রচিত ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গানটি তার ঐতিহাসিক প্রমাণ। ব্রিটিশ শাসনকালে ১৯২২ সালের ২০ জানুয়ারি ‘ভাঙার গান’ শিরোনামে ‘ বাঙ্গলার কথা’ পত্রিকায় গানটি প্রকাশিত হয়। তখন ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে গানটি এতই উত্তাপ ছড়িয়েছিল যে, শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার গানটি বাজেয়াপ্ত করতে বাধ্য হয়। নজরুলের এই সাহসী উচ্চারণ ছিলো মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে, নিপীড়িত মানুষের পক্ষে। ব্রিটিশদের অন্যায় শাসন ও শোষণের নির্মমতা দেখে কবি লিখেছিলেন,
‘কারার ঐ লৌহ কপাট
ভেঙে ফেল কর রে লোপাট
রক্ত জমাট শিকল পুজোর পাষাণ বেদী
ওরে ও তরুণ ঈষাণ
বাজা তোর প্রলয় বিষাণ
ধ্বংস নিশান উক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি।’
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পর বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামেও কবির এই গান জুগিয়েছে অনুপ্রেরণা ও উদ্দীপনা। আজও এই গান মুক্তিকামী বাঙালির চেতনার প্রতীক হয়ে আছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তার লেখনী ধূমকেতুর মতো আঘাত হেনে ভারতবাসীকে জাগিয়ে দিয়েছিল। কবি সাম্রাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদ, নিপীড়ন, অনাচার, বৈষম্য, শোষণ ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে অগ্নিকণ্ঠে সোচ্চার হয়ে লিখে গেছেন অসংখ্য কবিতা। এখানেই বিদ্রোহের স্বার্থকতা।
২. কবি নজরুল ছিলেন সাম্যবাদ চর্চার প্রকৃত প্রবাদ পুরুষ। সাম্যবাদের সাহসী বক্তা। তিনি মানুষের মাঝে কোনো ভেদাভেদ খুঁজতেননা। তার মাঝে জাতপাতের কোনো বিভেদ ছিলনা। সকল মানুষকে শুধু মানুষ পরিচয়তিনি দেখতে চেছেন। এই বিশ্বাস ধারণ করার ফলে তিনি হয়ে ওঠেন মানবতাবাদী কবি। নজরুল লিখেছেন,
‘গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড়কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান,
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,
সব দেশে, সব কালে, ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।’
নজরুল সব মানুষকে নিয়ে ভাবতেন। সমাজের সব মানুষের অধিকার ও মর্যাদার কথা বলতেন। তার কবিতায় উঠে এসেছে সব শ্রেণির মানুষের কথা। কবির রচিত সাম্যবাদী, সাম্য, বিদ্রোহী, কাÐারী হুঁশিয়ার, সবর্হারা, কুলি-মজুর, সাম্যের গান, মানুষ, ভাঙার গান, বন্দি বন্দনা, রণভেরী, আত্মশক্তি, মরণ বরণ, বন্দনাগান, আগমনী, ধুমকেতু, , কৃষাণের গান, দীপান্তরের বন্দিনী, শ্রমিকের গান, মুক্তিসেবকের গান, ইত্যাদি কবিতা সমূহে উঠে এসেছে সাম্যের কথা। কবিতাগুলোতে তিনি সব শ্রেণি পেশার মানুষের কথা তুলে ধরেছেন। তিনি বাধা-ব্যবধান ভুলে গিয়ে লিখেছেন,
‘গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়েগেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্‌লিম-ক্রীশ্চান।
গাহি সাম্যের গান!’
এই কবিতা দিয়েই নজরুল তার সাম্যবাদী আদশের্র জানান দেন। অন্য এক কবিতায় কবি লিখেছেন,
‘সকল কালের সব দেশের সব মানুষ আসি
এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শুন এক মিলনের বাঁশি।’
হিন্দু হোক, মুসলমান হোক, বৌদ্ধ হোক, কিংবা খ্রিস্টান হোক; তিনি বিশ্বাস করতেন সবাই মানুষ। তিনি অনুভব করেন মানবীয় চেতনা ও মানুষকে। তার এই অনুভব থেকে সাম্যবাদই তার কাছে প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে, যেটি তার কবিতা ও লেখায় উঠে এসেছে বারবার। নজরুল আমাদের অনুপ্রেরণা তিনি তার লেখনী দিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। মানুষের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে তিনি শাসকশ্রেণীর অভিঘাতের শিকার হয়েছেন। কারাবন্দী হয়েছেন, অত্যাচারের শিকার হয়েছেন।নজরুল মানুষের হৃদয়কে মন্দির, মসজিদ, গির্জা বা অন্যান্য তীর্থক্ষেত্রের মতো পবিত্র মনে করেছেন। মানুষ আর মানুষের হৃদয়কে সবকিছুর ঊর্ধ্বে রেখে তিনি লিখেছিলেন- ‘এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই’।
আজ আমাদের সাহস আর অনুপ্রেরণার উজ্জ্বল প্রদীপ সাম্যের কবি, বিরহ ও বেদনার কবি, বিদ্রোহের কবি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী। কবির জন্মদিনে একটাই প্রত্যাশা, আমাদের মাঝে ফিরে আসুক নজরুলের সাম্যবাদ চর্চা। কবি যেভাবে বলে গেছেন,
‘গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে বড়ো কিছু নাই,
নহে কিছু মহীয়ান।’
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী
উপক‚লীয় পাবলিক লাইব্রেরি, চট্টগ্রাম