গান কবিতা নাচ আর কথামালাসহ বর্ণাঢ্য আয়োজনে কবিকে স্মরণ

3

ডেইজী মউদুদ

গত ২৪, ২৫ ও ২৬ মে তিনদিনব্যাপী এক মহা আয়োজনের মধ্য দিয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় পালিত হলো বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫ তম জন্মজয়ন্তী। আগরতলা মৈত্রী সংসদ এবং আগরতলা পুরানিগমের সহায়তায় এই কিব নজরুলকে নিয়ে তিনদিনব্যাপী নানা আয়োজনে বাংলাদেশ সহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে সাহিত্যমোদী, শিল্পী, নাট্যকর্মী, সাংবাদিকসহ সুশীল সমাজের ব্যক্তিবর্গ আমন্ত্রিত হয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। আগরতলার নজরুল অনুরাগীরা তো ছিলেন ই। এসেছিলেন কলকাতা থেকে, শান্তিনিকেতন থেকে, আসামের শিলচর থেকে, বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে যেমনঃ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল আর কুমিল্লা থেকে। চট্টগ্রামের প্রতিনিধি দলে আমি ছিলাম, টিম লিডার ছিল ডিজাইনার আমিনা রহমান লিপি, সাথে ছিল নাট্যকর্মী শুভ্রা বিশ্বাস, বেতারের উপস্থাপক শাওন পান্থ আর নাসরীন ইসলাম, শিল্পী সুবর্ণা রহমান আর পংকজ বাবু। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম রাজন্য শাসিত বৃহত্তর ত্রিপুরা অর্থাৎ কুমিল্লায় এসেছিলেন মোট পাঁচবার। কবির অসাম্প্রদায়িক চেতনা, সাম্যবাদী দর্শন এবং ধর্ম নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী এই অঞ্চলের মানুষকে তীব্রভাবে প্রভাবিত করেছে। বৃহত্তর ত্রিপুরার ঘরে ঘরে কবি নজরুল এক অনন্য মর্যাদা ও আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ব্রিটিশ শাসিত রাজন্য ত্রিপুরার মানুষ যেভাবে কবির সৃজন ও মননের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন, ঠিক একই ভাবে স্বাধীন ভারতের ছোট্ট ত্রিপুররার মানুষ ও কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি দারুণভাবে শ্রদ্ধাশীল। যার প্রমাণ পেলাম তাদের তিনদিনব্যপী অত্যৗন্ত আন্তরিক আর অসাধারণ আয়োজনে। বাংলাদেশ বর্ডার পার করে যখন আগরতলা ইমিগ্রেশনে প্রবেশ করি, সেখানে আয়োজকরা এসেছেন অতিথিদেও বরণ করতে। কি আন্তরিক আর অকৃত্রিম অভ্যর্থনা। ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত ফর্মালিটিজ শেষ করে তারা আমাদেরকে গাড়ি করে নিয়ে গেলেন ভগৎসিং নিবাসে, যেখানে একটি অনুষ্ঠান এবং আমাদের থাকার আর খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বিশাল ভবন, চমৎকার অডিটারিয়াম। আমরা যার যার রুম বুঝে নিয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ সেরে আবার প্রস্তুত সূচনা অনুষ্ঠানে যাবার জন্য। চতুর্দিকে যেন সাজ সাজ রব। ব্যনারে , তোরণে, কবির কবিতা আর প্রতিকৃতি শোভা পাচ্ছিল। আর কবিতা, গান আার সংগীত তো ছিল ই পুরো তিনদিনের আয়োজনে। আগরতলার নানা স্থানে প্রোগ্রাম সাজানো ছিল। প্রথমদিনে বিকেলের আয়োজন ভগৎসিং অডিটরিয়ামে। দ্বিতীয় দিনের প্রভাত ফেরি রবীন্দ্র ভবন থেকে শুরু হয়ে বেশ কিছু পথ পেরিয়ে আবার রবীন্দ্র ভবনে এসেই কবির প্রতিকৃতিতে ফুলের শুভেচ্ছা নিবেদন। বিকালে যোগেন্দ্র নগরে কবির আবক্ষ মূর্তি উন্মোচন, এবং আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আগরতলার মুখ্য মন্ত্রী মানিক সাহা, মেয়র দীপক মজুমদার, পর্যটন মন্ত্রী সুশান্ত বাবু, প্রধান বিচারপতি বিশ্বজিৎ পালিত প্রমুখ উপস্থিত থেকে অনুষ্ঠানকে জমকালো আর প্রাণবন্ত করে রেখেছিলেন। রাতে বিচারপতির দেয়া ভোজ আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিল আন্তরিকতা আর প্রাণপ্রাচুর্য্যে ভরা চমৎকার এক আয়োজন। মুখরোচক নানা রসনা বিলাসের পাশাপাশি চলছিল নজরুল গীতির সুর মূর্ছণা। রাজ্যের প্রধান বিচারপতি কি পরিমাণ সংস্কৃতিমনা এবং নজরুল ভক্ত তা, উনাকে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করতে পারবেনা। রীতিমতো তিনি গবেষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ। নিজে গাইলেন নজরুল গীতি, ছেলে সৌম্যদীপ গাইলো নজরুল গীতি, আর তাঁর স্ত্রী মধুমিতা তো আয়োজক কমিটির একজন কর্মী ছিলেন। তিনদিনের অনুষ্ঠানের শেষ রাগিনীর বীণা বাজে প্রণাম অনুষ্ঠান অর্থাৎ নজরুল ইসলামের গান, কবিতা নাচ, কথামালা আর এওয়ার্ড প্রদানের মধ্য দিয়ে। সেই মনোরম সন্ধ্যাটি রবীন্দ্র ভবনের সুরম্য অডিটরিয়ামে সম্পন্ন হয়। কবির প্রিয় ঋতু বর্ষা। প্রকৃতিতে তখন তুমল বাতার, বৃষ্টি, ঝড়ো হাওয়া সাথে বাজছিল মেঘের ডমরু। আর মঞ্চে তখন শিল্পীদেও কণ্ঠে বাজছিল নৃত্যের তালে তালে কবির গান। মেঘের গান, প্রেমের গান। আহা ! নাচের কি মুদ্রা, গানের কি সুর আর তাল। মেঘের ডমরু ঘন বাজে, নিশি নিঝুম ঘুম নাহি আসে, তুমি সুন্দর, তাই চেয়ে থাকি প্রিয়, সেকি মোর অপরাধ? এসব গানের সুর আর বাণীতে মুগ্ধতা আর সম্মোহনীর রেশ কে সাথে নিয়ে তিনদিনব্যাপী অনুষ্ঠানের পর্দা নামলো। শেষ হলো ১২৫তম নজরুল জন্ম জয়ন্তীর রাজকীয় অনুষ্ঠানমালার। তিনদিনের প্রোগ্রাম শেষে পরেরদিন দেশে ফিরছিলাম প্রচন্ড বৃষ্টিকে সাথে নিয়ে। সেই ফেরাতেই প্রতি মুহূর্তেই ছিল কবি নজরুল। কোন এক শ্রাবণের রাতে কবি নার্গিসকে নিয়ে যাবার কথা বলে গিয়েছিলন। সেই না আসা শ্রাবণধারাকে মনে পড়লো।আমরা ভিজে চুপসে যখন ট্রেনে চাপলাম, ৪ ঘণ্টার ট্রেন জার্নিতে চেতনায় ছিল নজরুল। আমি আর শুভ্রা পাশাপাশি আসনে বসেছি। আর মৃদু কণ্ঠেই চলছিল নজরুল বন্দনা। যেসব গান আমরা আগে গাইতাম, সেই সব গান মনে করে করে দু,চার লাইন গাইতে গাইতে কখন যে চট্টগ্রাম এসে পড়লাম টের ও পেলাম না।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক