গণতন্ত্র ও বিএনপি একই সূত্রে গাঁথা

2

মুহাম্মদ শওকত আলী নুর

১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর শহীদ রাষ্ট্রপতি, বীর মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত হয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। মহান স্বাধীনতাযুদ্ধকালীন এবং ৭০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে জাতির ক্রান্তিকালে জিয়াউর রহমান এর সাহস, দৃঢ়তা এবং দূরদৃষ্টি জাতিকে অভিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। পরবর্তীকালে দূরদর্শী রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তার অবস্থান এবং সিদ্ধান্ত জাতিকে কাক্সিক্ষত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দান করে। রাজনীতিতে জিয়াউর রহমানের আবির্ভাব অনেকটা বৈপ্লবিক। কোন সামরিক অভ্যুত্থান অথবা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বা কোন পূর্ব পরিকল্পনার মাধ্যমে তিনি ক্ষমতায় আসেননি। সিপাহী জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে তিনি ক্ষমতাসীন হন। তারই নেতৃত্বের পরশমনির স্পর্শে রাজনীতি হয়ে উঠে সৃজনশীলমুখী, আত্মপ্রত্যয়ী এবং বলিষ্ঠ। বিএনপি গঠনের পিছনে রয়েছে ঐতিহাসিক পটভূমি।
বৃটিশ শাসিত ভারতীয় উপমহাদেশে রাজনৈতিক পুনর্জাগরণ কোন একটি ঘটনা প্রসূত বা কোন একক ব্যক্তিত্বের অবদানের ফল নয়। বিভিন্ন সংস্কার আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, সামাজিক ও রাজনৈতিক সচেতনতার প্রক্রিয়ায় এ উপমহাদেশে আধুনিক রাজনীতির বিকাশ শুরু হয়। সে পথ ধরেই ১৮৮৫ সালে অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক সংগঠন ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯০৬ সালে ঐতিহাসিক প্রয়োজনে ঢাকার শাহবাগে নবাব ভিকার-উল-মূলক এর সভাপতিত্বে পৃথক একটি রাজনৈতিক দলের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করা হয়। আলোচনা শেষে ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ্র প্রস্তাবে এবং হাকিম আজমল খানের সমর্থনে ‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগ’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। উলে­খিত দু দলের নেতৃত্বে ১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। কিন্তু দেশ বিভাগের পর মুসলিম লীগ সরকার ও মুসলিম লীগের স্বৈরাচারী ও অগণতান্ত্রিক মনোভাবের বিরুদ্ধে ২৩ জুন ১৯৪৯ সালে ঢাকার রোজ গার্ডেন হল কামরায় আরেক ঐতিহাসিক প্রয়োজনে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম আওয়ামীলীগ’ গঠন করার প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। যা পরবর্তীকালে ‘আওয়ামীলীগ’ নামে পরিচিতি লাভ করে। বাংলাদেশের জনগণের মুক্তি সংগ্রাম তথা স্বাধীনতা সংগ্রামে এ দল প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বিভিন্নভাবে নেতৃত্ব প্রদান করে। এ সময় আওয়ামীলীগ থেকে বের হয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী) ও ন্যাপ (মোজাফ্ফর) সহ আরো অনেক রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব ঘটে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর হানাদার পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্যদিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সত্যিকার কার্যক্রম শুরু হয়। ১০ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করার পরপরই ইচ্ছা প্রকাশ করেন যে, দলমত নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক দলের সাথে আলাপ-আলোচনা করে ঐক্যমতের ভিত্তিতে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলবেন। তদানুযায়ী ১১ জানুয়ারি জারি করা হয় অন্তবর্তীকালীন শাসনতন্ত্র আদেশ এবং সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে ১২ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি পদে বসিয়ে নিজে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরই মধ্যে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ৩৫ সদস্য বিশিষ্ট খসড়া সংবিধান প্রণয়নের কমিটি গঠন করা হয়।
১৯ জুলাই ১৯৭২ সালে কেন্দ্রীয় ছাত্র সম্মেলনের মধ্যদিয়ে ভাগ হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী অন্যতম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। মেজর জলিল ও আ স ম আব্দুর রবকে আহবায়ক করে গড়ে ওঠে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ‘জাসদ’ নামের নতুন রাজনৈতিক দল। দলটি প্রথম অবস্থাতেই সরকারের দমন পীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হয়। ফলে সরকার বিরোধী আপসহীন জঙ্গি আন্দোলন সংগ্রামের সংগঠন হিসাবে দ্রুত পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা লাভ করে ‘জাসদ’। জাসদ ছাড়াও মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ন্যাপ, আতাউর রহমান খানের জাতীয় লীগ, অলি আহাদের বাংলা জাতীয় লীগ আওয়ামীলীগ সরকার বিরোধী আন্দোলনে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। অন্যদিকে সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টি ও অন্যান্য নকশালী দলগুলো গুপ্ত হত্যাসহ সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা অব্যাহত রাখে। ফলে সরকার বিভিন্ন দমননীতি ও ধরপাকড়ের মাধ্যমে আন্দোলন মোকাবেলা করতে থাকে। এমনকি দলগুলোর আন্দোলন মোকবেলায় দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেয়া হয়। ৭ মার্চ ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচন ব্যাপক কারচুপি, কেন্দ্র দখল, বল প্রয়োগ, সংঘর্ষ ইত্যাদির জন্য ব্যাপক সমালোচিত হয়।
১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ভিয়েতনাম সংহতি দিবস উপলক্ষে মার্কিন তথ্যকেন্দ্র অভিমুখে ছাত্র ইউনিয়নের মিছিলে পুলিশের গুলিতে মতিউর ও কাদের নামে ২জন ছাত্র কর্মী নিহত হন। ফলে ছাত্র সমাজ এই প্রথম শেখ মুজিব শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং ছাত্র জনতা তাদের ক্ষোভ ও ঘৃণার স্বতঃস্ফুর্ত বহিঃপ্রকাশ প্রমাণ করে। পরদিন সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। ৫ জুন ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়ন মশাল মিছিল বের করলে আওয়ামীলীগ কর্মীরা গাজী গোলাম মোস্তফার নেতৃত্বে হামলা চালায়। লাঞ্ছিত হন তৎকালীন ন্যাপ নেতা বেগম মতিয়া চৌধুরী ও পঙ্কজ ভট্টাচার্য। মশালের আগুনে জ্বালিয়ে দেয়া হয় ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কার্যালয়।
মাওলানা ভাসানী এই সময় খাদ্য সংকট এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ৩দফা দাবীতে অনশন শুরু করেন। সকল বিরোধী দলের অনুরোধে মাওলানা ভাসানী অনশন ভঙ্গ করেন। মাওলানা ভাসানী শর্ত দেন যে, ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে সকলকে অংশগ্রহণ করতে হবে। সেই মোতাবেক বিরোধীদলসমূহ একটি যুক্ত বিবৃতি দিয়ে বিকেলে পল্টনের জনসভায় যোগ দেন। আওয়ামীলীগের লোকজন পল্টনের সেই জনসভা মঞ্চ ভেঙ্গে ফেলে এবং নেতাকর্মীদেরকে মারধর ও লাঞ্ছিত করে। দেশের প্রতিটি স্থানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। এসময় জাসদসহ ৯টি ছাত্র সংগঠন ডাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনায় ও ব্যাপক অংশগ্রহণের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হলেও ৬০ ভাগ ভোট গণনার পর সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠনের ভরাডুবি আচ করতে পেরে; প্রকাশ্য দিবালোকে মুখোশপরা সশস্ত্র ব্যক্তিরা সব ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নেয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ছাত্র সংসদ নির্বাচন, কলকারখানাসহ বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি অফিসের সি বি এ নির্বাচন সবখানেই সরকার প্রশাসনিক ও গায়ের জোর খাটিয়ে তাদের দলীয় লোকজনকে বসিয়ে দেয়।
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে লুটপাট, চোরাকারবারী, মজুতদারী বেড়ে যেতে থাকে। বাজারে দেখা যায় তীব্র খাদ্য সংকট। শিল্প অঞ্চল, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে বাড়তে থাকে দিন দিন ক্ষোভ ও চরম অসন্তোষ। দুর্ভিক্ষে মারা যায় অনেক লোক। চলতে থাকে আন্দোলন, ধর্মঘট। সরকার এগুলো কঠোর হস্তে দমনের চেষ্টা চালালে অসন্তোষ ব্যাপক আকার ধারণ করে। সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের বিরাজমান অন্তদ্বন্দ্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হলে নির্মম খুনের ঘটনা ঘটে। জাসদ ১৭ এপ্রিল ১৯৭৪ পল্টনে এক সমাবেশ শেষ করে বিরাট মিছিল সহকারে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাও করে। ফলে পুলিশের সাথে বিক্ষুব্ধ জনতার সংঘর্ষ শুরু হয় এবং ঘটনাস্থলেই নিহত হন প্রায় ৩০ জন। মেজর জলিল, আ স ম আব্দুর রবসহ অনেক নেতাকর্মী আহত ও গুলিবিদ্ধ হয়ে গ্রেফতার হন। আন্দোলন ঠেকাতে সরকার সর্বদলীয় ঐক্যফন্টের নেতাকর্মীসহ বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীদেরকে ১৯৭৪ সালে জারী করা বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেফতার করে। মাওলানা ভাসানীকে সন্তোষে তার নিজ গৃহে বন্দী করে রাখা হয়। তিনি জনগণকে আন্দোলন চালিয়ে যাবার জন্য আহবান জানান।
৩১ ডিসেম্বর ১৯৭৪ সালে চট্টগ্রাম থেকে সিরাজ সিকদারকে গ্রেফতার করা হয় এবং ২ জানুয়ারি ১৯৭৫ সালে চোখ বাঁধা অবস্থায় অজ্ঞাতস্থানে নিয়ে যাবার সময় ঢাকার সাভারে নিহত হন। সরকার পক্ষ থেকে বলা হয়, পালিয়ে যাবার সময় গুলিতে সিরাজ সিকদার মারা যায়। ২৩ নভেম্বর ১৯৭৪ সালে ক্যাপ্টেন হালিম, কাজী জাফর, রাশেদ খান মেনন গড়ে তোলেন ইউপিপি। ইতিমধ্যে জাসদ তাদের উপর নানা ধরনের ফ্যাসীবাদী হামলা থেকে দল ও দেশের সাধারণ মানুষদেরকে রক্ষার জন্য সশস্ত্র গণবাহিনী গঠনের মাধ্যমে প্রকাশ্য রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডের রাজনীতিতে ঢুকে পরে। এই সশস্ত্র গণবাহিনীর প্রধান ছিলেন কর্ণেল আবু তাহের, ডেপুটি ছিলেন হাসানুল হক ইনু। তাদের নেতৃত্বে গণবাহিনীর সাথে জাসদ সেনাবাহিনীতে গোপনে গড়ে তুলে বিপ্লবী সৈন্য সংস্থা। এরই মধ্যে দেশে প্রায় ৩৭ হাজার মুক্তিযোদ্ধা রাজনৈতিক নেতা-কর্মী বর্বর হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়। রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিক নির্মল সেন লিখতে বাধ্য হলেন, “স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই।” দেশের এই ক্রান্তিকালে সরকার ২৮ ডিসেম্বর ১৯৭৪ দেশে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে।
রাজনীতি বিজ্ঞানের একটি কথা আমরা সবাই জানি, ক্ষমতা দুর্নীতিগ্রস্ত করে আর নিরংকুশ ক্ষমতা চরমভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত করে। তদানীন্তন সরকারের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে অনেক ভালো কথা থাকলেও সেই ভালো কথা সংবিধান প্রণেতারা বাস্তবে প্রয়োগ হতে দিলেন না। যা প্রয়োগ হলে হয়তো সেই সংবিধান গণতন্ত্র চর্চার একটি মর্যাদাপূর্ণ দলিল হতে পারত। কিন্তু এদেশের জনগণের ভাগ্য এমন যে, আওয়ামীলীগ দেশ ও দলের সর্বময় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে ৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের পাতায় যতটুকু গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা ছিল তার শেষ সুবিধাটুকুও বন্ধ করে দিল। নিজেদের প্রণীত সংবিধানের ব্যবচ্ছেদ করে দেশের উপর, দেশবাসীর উপর একদলীয় স্বৈরশাসন চাপিয়ে দেয়া হলো। সকল রাজনৈতিক দলের তৎপরতা, পত্র পত্রিকা নিষিদ্ধ করে মত প্রকাশের অধিকার হরণ করা হল। আদালতের স্বাধীনতা বিলুপ্ত করা হলো। স্বাধীনতার জন্য, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য, জনকল্যাণকর অর্থনীতির জন্য বাংলাদেশের জনগণ সেদিন এই নারকীয় পরিস্থিতি ও বিবেকহীন দুঃশাসন থেকে পরিত্রাণ পেতে চেয়েছিলেন। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে, পরিত্রাণ ও পরিবর্তনের নিয়মতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক সব পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিল আওয়ামীলীগ।
২০ এপ্রিল বাকশালে যোগদানের ফরমান জারি করা হয়। ২০ জুন বাংলাদেশকে ৬১ জেলায় বিভক্ত করে ১৬ জুলাই প্রতিটি জেলায় একজন করে ৬১ জন জেলা গভর্নর নিযুক্ত করা হয়। তাছাড়া প্রতিটি জেলায় জেলা গভর্নরের সমান ক্ষমতা দিয়ে ৬১ জন বাকশাল সম্পাদকও নিযুক্ত করা হলো। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘটে ইতিহাসের নৃশংসতম ও বর্বরতম হত্যাকান্ড। সামরিক অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে তাঁরই সহকর্মী আওয়ামীলীগ নেতা খন্দকার মোশতাক আহমদ ক্ষমতা দখল করেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আরেকটি অধ্যায়ের শুরু হলো। মোশতাক মন্ত্রী পরিষদে অধিকাংশ সদস্যই পূর্ববর্তী রাষ্ট্রপতির মন্ত্রীসভার সদস্য ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী নতুন রাষ্ট্রপতির সামরিক উপদেষ্টা হন। জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ৭৫ সালের আগস্ট মাসের শেষের দিকে সেনাবাহিনীর প্রধান করা হয়। মোশতাক সরকার ক্ষমতায় এসেই দেশে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে রাজনৈতিক তৎপরতা, সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ, বাকশাল ও ৬১ প্রশাসনিক জেলা বিলুপ্ত করেন। জেলখানায় প্রেরণ করেন বঙ্গবন্ধুর অনুগত জাতীয় নেতা তাজ উদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানকে।
২ অক্টোবর ১৯৭৫ এক বেতার ভাষনে মোশতাক ১৫ আগস্ট ৭৬ থেকে রাজনৈতিক তৎপরতা এবং ১৯৭৭ সালের ২৭ আগস্ট জাতীয় নির্বাচন ঘোষণা করে। ঐদিন জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা দেশের সেনাবাহিনীর সেনানিবাসগুলোতে হাজার হাজার লিফলেটের মাধ্যমে দেশের সার্বিক পরিস্থিতির উপর তাদের সংগঠনের মূল্যায়ন তুলে ধরে। মোশতাক সরকার রক্ষী বাহিনীকে সেনাবাহিনীতে একুভুত করে নেন ১৫ অক্টোবর ১৯৭৫ সালে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারীদের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহনের নামে তৎকালীন বিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে ৩ নভেম্বর একটি অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়। অভ্যুত্থানের সূচনালগ্নেই সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বন্দি করা হয় এবং সেনাবাহিনী প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে খালেদ মোশারফ নিজেকে মেজর জেনারেল পদোন্নতি দিয়ে সেনাবাহিনী প্রধান ঘোষণা করেন। একথা সত্য যে, ৩ নভেম্বর থেকে ৬ নভেম্বর মধ্যরাত পর্যন্ত দেশে কোন প্রশাসন ছিল না। সেনাবাহিনীর মধ্যে ছিল না চেইন অব কমান্ড। গোটা দেশটাই ছিল সরকার বিহীন এক অন্ধকারে।
৩ নভেম্বরের সেনা অভ্যুত্থানের সংবাদ পেয়ে বঙ্গভবনে অবস্থানরত মোশতাক-রশীদ গং পূর্ব পরিকল্পনা মতে জেলখানার অভ্যন্তরে নৃশংসভাবে হত্যা করেন জাতীয় চার নেতাকে। এক পর্যায়ে খালেদ মোশারফের সঙ্গে মোশতাকের সমঝোতা হলে ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের হোতারা দেশত্যাগ করতে সক্ষম হন। ইতিমধ্যে খালেদ মোশারফের অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে ঘটতে থাকে নানামুখী টানাপোড়ন ও নাটকীয়তা। ওয়ার্কাস পার্টির নেতা হায়দার আকবর খান রনো লিখেছেন, সকলেই ধরে নিল খালেদ ভারতপন্থী এবং জিয়া বাকশাল ও ভারত বিরোধী (মার্কসবাদ ও সশস্ত্র সংগ্রাম ১৯৮২, পৃষ্ঠা: ১৭৭)
৩ নভেম্বর থেকে একদিকে ভারতীয় পত্রপত্রিকায় উল্লাস, ঢাকায় জয় বাংলার মিছিল, অভ্যুত্থান বিষয়ে বিবিসির সাংবাদিক আরিফুল আলম ও হলিডে সম্পাদক এনায়েত উল্লাহ খানের নেতিবাচক ভাষ্য ৪৮ ঘন্টার মধ্যে খালেদ মোশারফের ক্ষমতার ভিত নড়বড় করে তুলে। জেনারেল জিয়ার ছিল সেনাবাহিনীতে পপুলার ইমেজ। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সিপাহীরা জেগে ওঠে। দলে দলে ঢাকায় এসে সমবেত হয় এবং ৭ নভেম্বর’৭৫ সিপাহী বিপ্লবের মাধ্যমে খালেদ মোশারফের পতন হয়। বিক্ষুব্ধ সিপাহীদের রোষানলে পড়ে তিনি প্রাণ হারান। সিপাহী জনতা অত:পর জিয়াউর রহমানকে বন্দীদশা থেকে মুক্ত করে। পুনরায় দেশে এক নতুন বিপ্লবের সূচনা হয়। যে বিপ্লবের নাম সিপাহী জনতার বিপ্লব। এই দিন দেশের মানুষ বাংলাদেশি জাতীয়তার প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছিল বলেই এ দিবস “বিপ্লব ও সংহতি দিবস।”
সে দিনের ঢাকা শহরের বর্ণনা দিতে গিয়ে এন্থনী ম্যাসকারেনহাস বাংলদেশ : এ লিগ্যাসি অব ব্লাড গ্রন্থে (অনুবাদ গ্রন্থ, পৃষ্ঠা ১২২) লিখেছেন, “উল্লসিত কিছু সৈনিক আর বেসামরিক লোক নিয়ে কতগুলো ট্যাঙ্ক ঢাকা শহরের মধ্যবর্তী এলাকায় চলাচল করতে দেখা যায়। এবার এই ট্যাঙ্ক দেখে লোকজন ভয়ে না পালিয়ে ট্যাঙ্কের সৈনিকদের সাথে একাত্ম হয়ে রাস্তায় নেমে আসে এবং উচ্ছাসে ফেটে পড়ে। চারদিন ধরে তারা মনে করেছিল যে, খালেদ মোশারফকে দিয়ে ভারত তাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা খর্ব করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে। ততক্ষণে তাদের দুঃস্বপ্ন কেটে গেল। জনতা সৈনিকদের তাদের ত্রাণকর্তা বলে অভিনন্দন করল। সর্বত্রই জোয়ান আর সাধারণ মানুষ খুশিতে একে অপরের সাথে কোলাকুলি শুরু করে। রাস্তায় নেমে সারা রাতভর তারা স্লোগান দিতে থাকে আল্লাহু আকবর, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। সিপাহী বিপ্লব জিন্দাবাদ, জেনারেল জিয়া জিন্দাবাদ ইত্যাদি। অবস্থা দেখে মনে হয়েছিল, ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের গণ জাগরণের মত জনমত আবার জেড়ে উঠেছে। এটা ছিল সত্যিই এক স্মরণীয় রাত। ”
৭ নভেম্বরের বিপ্লবে কর্ণেল আবু তাহের এবং জাসদ সমর্থিত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। কিন্তু তাহের কিংবা সৈনিক সংস্থার বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের লক্ষাভিসারী রাজনীতি এবং শ্রেণিহীন সেনাবাহিনী অথবা গণবাহিনী সম্পর্কিত ধারণার সঙ্গে ব্যাপক সেনিক জনতা বিশেষ কোন পরিচয় ছিল না। মুক্ত জিয়ার ব্যাপক জনপ্রিয়তার সামনে তাহের ও সৈনিক সংস্থাকে ম্রিয়মান ও কোণঠাসা হয়ে পড়তে হয়। জিয়া ক্ষমতা সুসংহত করতে সক্ষম হন।
বিপ্লবের পর বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। তিনি সংসদ বাতিল করেন, ১৫ আগস্ট থেকে জারিকৃত সামরিক আইন বহাল, ইনডেমনিটি বিলসহ সকল কালা কানুনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, ১৯৭৭ সালের ২৮ ফেরুয়ারি জাতীয় সংসদের নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন। প্রেসিডেন্ট সায়েম ১৯৭৬ সালের ২৮ জুলাই রাজনৈতিক দল বিধি আদেশ জারি করেন এবং ৩০ জুলাই ঘরোয়া রাজনীতি শুরু হবে বলে ঘোষণা দেন। এই সময় রাজনৈতিক দলবিধির আওতায় ৬৩ দল আবেদন করে। আওয়ামী লীগ, জাসদ, ন্যাপ, মুসলিম লীগ, জনতা পার্টি, জাতীয় লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, আই ডি এল সহ প্রায় ১৭টি দল অনুমোদন লাভ করে।
বিভিন্ন দল তাদের রাজনৈতিক কর্মকান্ড শুরু করেন। ২৬ আগস্ট ১৯৭৬ সালে আওয়ামীলীগের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে খোন্দকার মোশতাক, কে এম ওবায়দুর রহমান, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন প্রমুখকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। ইতিমধ্যে প্রেসিডেন্ট সায়েম শারীরিক অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে জেনারেল জিয়াকে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব অর্পণ করেন। ২২ এপ্রিল ১৯৭৭ সাল জেনারেল জিয়া বেতার ভাষনে জাতির উদ্দেশ্যে ঘোষণা করেন যে, ৩০ মে সারাদেশে গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। গণভোটে জনগণ জেনারেল জিয়াকে চায় কি না- হ্যা বা না। জনগণ এই প্রক্রিয়ায় জেনারেল জিয়ার পক্ষে ভোট প্রদান করে। ইতিমধ্যে রাজনৈতিক তৎপরতা চলতে থাকে।
৪ ফেরুয়ারি ১৯৭৮ সালে বিচারপতি আবদুস সাত্তারের সহযোগিতায় ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল জাগদলের আবেদন করেন এবং ২৩ ফেরুয়ারি এ দল অনুমোদন লাভ করে। ২৩ ফেরুয়ারি বিচারপতি সাত্তারকে আহবায়ক ও জেনারেল জিয়াকে ১নং সদস্য করে ১৬ সদস্যের জাগদলের আহবায়ক কমিটি গঠিত হয়। অন্যান্য সদস্যরা হলেন ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমদ, এনায়েত উল­াহ খান, আবুল হাসনাত, শামসুল হুদা চৌধুরী, সৈয়দ আলী আহসান প্রমুখ। ২১ এপ্রিল ১৯৭৭ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়া বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেন। ২৪ এপ্রিল’৭৮ প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দেন যে, ৩ জুন ১৯৭৮ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে এবং ১ মে থেকে ঘরোয়া রাজনীতি। ১মে ১৯৭৮ নির্বাচনকে সামনে রেখে জাগদল, মশিউর রহমান যাদু মিয়ার ন্যাপ, কাজী জাফরের ইউপিপি, শাহ আজিজুর রহমানের মুসলিম লীগ, লেবার পার্টি ও তফসিলি দল নিয়ে গঠন করা হয় “জাতীয়তাবাদী ঐক্য ফ্রন্ট”। অন্যদিকে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে ন্যাপ (মো). ড. আলীমুর রাজী’র পিপলস লীগ, জনতা পার্টি ও গণ আজাদী লীগ গড়ে তুলে গণতান্ত্রিক ঐক্য ফ্রন্ট (গজ)। একদিকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জেনারেল জিয়া অন্যদিকে জেনারেল এম এ জি ওসমানী। ৩ জুন ১৯৭৮ অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেনারেল জিয়া বিপুল ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত নাজুক হয়ে উঠে। কোনো জাতীয় নেতা তখন দেশের নেতৃত্বে সমাসীন ছিলেন না। সরকার অনুমোদিত রাজনৈতিক দলগুলো ভেঙ্গে খান খান হয়ে যাচ্ছিল। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সায়েম দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হলে সৈনিকদের মধ্যে শুরু হয় কোন্দল। ঐ সময় দেশের সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় সাধারণ মানুষ ও দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী আস্থা রেখেছিল জেনারেল জিয়ার উপর। দেশের চরম ক্রান্তিকালে জেনারেল জিয়া হাজির হলেন কান্ডারীরূপে। জিয়া কে পেয়ে জনগণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ নিয়ে জাগদল গঠন করা হয়েছিল। জিয়াউর রহমান একজন ব্যক্তি হিসেবে এদলে যোগদান করেছিলেন, যদিও তারই অনুপ্রেরণায় ‘জাগদল’ গঠিত হয়েছিল। কিন্তু জাগদল জিয়ার আস্থা ও আকাঙ্খা পুরোপুরি পূরণ করতে পারেনি বলেই পরবর্তীকালে জাতীয়তাবাদী দল গঠনের মাধ্যমে তিনি নিজেকে একজন দূরদর্শী রাজনীতিবিদের পরিচয় দেন, ঘোষণা করেন ঐতিহাসিক ১৯ দফা কর্মসূচি। জেনারেল জিয়া বলেছিলেন, “আই উইল মেক পলিটিক্স ডিপিকাল্ট” ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, “আমি বলছি গণতন্ত্রকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেব। সেক্ষেত্রে পেশাদার শহর কেন্দ্রিক রাজনীতিবিদদেরকে অসুবিধায় পড়তে হবে।”
জেনারেল জিয়া সিদ্ধান্তগ্রহণে তড়িৎ, প্রত্যয়ী ও প্রজ্ঞাবান ছিলেন। তিনি জাতির ক্রান্তিকালে সেনাবাহিনীকে ঐক্যবদ্ধ করেন। পরবর্তীতে দেশে রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণে ঐক্যবদ্ধ নাগরিক শ্রেণিকে নিয়ে জাতীয় ঐক্য ও সংহতির জন্য গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, সামাজিক ও ন্যায়বিচারের সমাজতন্ত্র জাতীয় জীবনে সর্বস্তরে প্রতিফলিত করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে নতুন রাজনৈতিক দল “বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল” প্রতিষ্ঠা করেন।
জিয়াউর রহমানের রাজনীতিতে আবির্ভাব এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা সম্পর্কে বলা যায় যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে গঠিত হলেও বাকশাল পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরকে সর্বপ্রথম বাকশালের সদস্যপদ দেয়া হয়। সেই সময় সেনবাহিনীর উপপ্রধান হিসেবে জিয়াউর রহমানও বাকশালের সদস্য হয়েছিলেন। কিন্তু দেশ পরিচালনায় পর্যায়ক্রমে জিয়া বহুদলীয় গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার পথে অগ্রসর হয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে বেগম খালেদা জিয়া লিখেছেন, “বাংলাদেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমানের আবির্ভাব অনেকটা বৈপ্লবিক। এটি দুই অর্থেই প্রযোজ্য। এক, তিনি ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ক্ষেত্রে সামরিক অভ্যুত্থান ও প্রতি অভ্যুত্থানের ফলে সৃষ্ট ক্ষমতা শূন্যতা পূরনের ক্ষেত্রে। কেননা পূর্ণ পরিকল্পনার মাধ্যমে তিনি ক্ষমতাসীন হননি। দুই, তিনি ক্ষমতাসীন হয়ে দেশে এক গুচ্ছ বিপ্লবাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।”
জিয়াউর রহমান জাতীয় জীবনের ঐ সন্ধিক্ষনে দাঁড়িয়ে একজন বিজ্ঞ রাষ্ট্রনায়কের মতো বাংলাদেশকে নতুনভাবে দিক নির্দেশনা দানে সক্ষম হন। এক দলীয় শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তে তিনিই বহুদলীয় গণতন্ত্রের দিক নির্দেশনা দেন। তিনি বিচারবিভাগ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেন। তিনি রুশ ভারতের কক্ষপথ থেকে বাংলাদেশকে টেনে এনে স্বাধীনভাবে চলার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতার বন্ধন সুদৃঢ় করার জন্য তিনি আঞ্চলিক সহযোগিতার ভিত্তি পত্তন করেন। চীনসহ মুসলিম বিশ্বের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কোন্নয়নে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশের জনসমষ্টির জন্য তিনিই ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের’ ঠিকানা নির্ধারণ করে সকল নাগরিককে একসূত্রে গ্রথিত করেন।
প্রেসিডেন্ট জিয়ার রাজনৈতিক মেধার মধ্য দিয়ে দেশের রাষ্ট্রীয় দর্শন, রাজনীতি, জাতিসত্তার পরিচয় নির্ণয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে নবধারার সূচনা হয়। এ ধারার সঙ্গে দেশের জনগণের আশা আকাক্সক্ষা ও প্রত্যাশা যে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল জিয়ার রাজনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ইত্যাদির প্রতি জনগণের সমর্থন ও সহযোগিতা এবং অদ্যবদি তার প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি’র প্রতি জনগণের ভালোবাসা তারই প্রমাণ বহন করে। জিয়ার প্রতিষ্ঠিত দল জনগণের মেন্ডেট নিয়ে অনেকবার রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ লাভ করেছে। অত্যাচার, জেল-জুলুম, হামলা-মামলা, গুম-খুন, আয়নাঘর (চরম নির্যাতন সেল) সৃষ্টির ইত্যাদির পরও সাংবিধানিক রাজনীতির বলয় থেকে বিএনপির নীতি-আদর্শের ন্যূনতম বিচ্যুতি ঘটেনি। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের সংঘটিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্রের আড়ালে আওয়ামীলীগের ফ্যাসিবাদী সরকারের পদচ্যুতিতে বিএনপির দীর্ঘকালের আন্দোলন সংগ্রাম সফলতা পায়। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়ার বহুদলীয় গণতন্ত্রের চর্চা পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ইতিহাসের আলোকে নির্দিধায় বলা যায় যে, আওয়ামীলীগ মুখে গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বললেও কার্যক্ষেত্রে তারা একদলীয় স্বৈরশাসন কায়েম করে বারংবার গণতন্ত্র, সুশাসন ও ভোটাধিকারকে হত্যা করেছে। পক্ষান্তরে বিএনপি সবসময় প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম করেছে।
ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, আওয়ামীলীগ এর চেয়ে বিএনপি’র রাজনৈতিক সাফল্য অনেকাংশে বেশি।

লেখক: কলামিস্ট ও রাজনৈতিক কর্মী
সাবেক আহবায়ক, রাঙ্গুনিয়া উপজেলা বিএনপি