ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ জহুর আহমেদ চৌধুরী

3

মো. শফর আলী

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সহকর্মী তাঁর মন্ত্রীপরিষদের শ্রম-সমাজকল্যাণ-স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রী জননেতা আলহাজ¦ জহুর আহমেদ চৌধুরীর সাথে আমাদের ছোট বেলার পরিচয় হয়। জহুর আহমেদ চৌধুরীর জ্যেষ্ঠপুত্র, শহীদ সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী ছিলেন আমাদের সাথী। আমরা জহুর আহমেদ চৌধুরীর বাড়ীর পড়ার ঘরে স্যারের নিকট প্রাইভেট পড়তাম এবং বাড়ীর সম্মুখের মাঠে আমরা ফুটবল সহ বিভিন্ন খেলাধুলা করতাম। ছোট বেলা থেকে নেতার ¯েœহ পেয়েছি। চৌধুরী সাহেব ছিলেন একজন সমদুত শ্রমিক নেতা। কলকাতায় জাহাজি শ্রমিকদের সংগঠিত করেন শ্রমিক রাজনীতি আরম্ভ করেন। পাকিস্তান সৃষ্টি পর পুলিশের দাবী নিয়ে তিনি আন্দোলন করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছিল, পুলিশের আন্দোলন সফল হয় রেশন ও বেতন বৃদ্ধি পায়। জেল থেকে বের হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে শ্রমিক সংগঠন আরম্ভ করেন গণতান্ত্রিক শ্রমিক ফেডারেশন নামে তিনি একটি শ্রমিক সংগঠক গড়ে তুলেন। সে ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন জামশেদ আহমেদ চৌধুরী। এই ফেডারেশনের অধিন সমগ্র তৈল সেক্টর সহ জুট টেক্সটাইল মিলস ছিল।
পাহাড়তলী জুট, টেক্সটাইল, আমিন জুট মিলস, কালুরঘাট জুট, কর্ণফূলী পেপার মিলস, নারায়ণগঞ্জ নৌযান শ্রমিক ইউনিয়ন, গরুর গাড়ী, লবণ শ্রমিক সংগঠন তিনি করেছেন। জহুর আহমেদ চৌধুরী কেবল একজন শ্রমিক নেতা ছিলেন না, তিনি ১৯৪৬ সালে হোসেন শহীদ সৌহরাওয়ার্দীর নির্বাচনী প্রচারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহিত কলকাতায় প্রচারণায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে, যে নির্বাচনের জয় লাভের ফলে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল। সিলেট জেলাকে বাদ দিয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হলে চট্টগ্রামের মুজাফ্ফর আহমেদ-কে নিয়ে তিনি সিলেটকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্তির জন্য লংমার্চ করেন। এই আন্দোলনের ফলে ভারতের অন্তর ভুক্তি থেকে সিলেট পূর্ব পাকিস্তান অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। আজ সিলেট বাংলাদেশের একটি বৃহত্ত জেলা। পাকিস্তানী নেতারা সে সময়ে ছিল নীরব।
জহুর আহমেদ চৌধুরী লম্বা চোড়া, মোটাতাজা না হলেও তাঁর অসিম সাহস সাংগঠনিক প্রতিভা তাঁকে ক্ষনজন্মা মহাপুরুষে পরিন করেছে। জহুর আহমেদ চৌধুরীর সাংগঠনিক দক্ষতা আমরা এখনো হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি। শহর এলাকা ভুক্ত ওয়ার্ডসমূহ এখনো সাংগঠনিক কর্মকান্ডে অগ্রভাগে। যে সকল ইউনিয়ন (ওয়ার্ড) পূর্বে শহর আওয়ামী লীগের অন্তর্ভুক্ত ছিল না সে সকল ওয়ার্ডে নির্বাচনের ফলাফল কি হবে আওয়ামীলীগ নেতারা নিশ্চিত নয়। কিšদ জহুর আহমেদ চৌধুরীর সংগঠিত করা ওয়ার্ডসমূহে নির্বাচনে জয় লাভ করবে এটা নিশ্চিত। তার কোন কর্মী সংগঠন স্বাধীনতার পর দল ত্যাগ করেনি। অন্যরা জাসদ সহ বিভিন্ন দলে গিয়েছে।
১৯৬৬ সালে পাকিস্তানের লাহোড়ে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় সভা থেকে ফিরে ঢাকা বিমান বন্দরে বঙ্গবন্ধু বলেন বাঙালিরা দিতে দিতে রিক্ত হয়ে গেছে, বাঙালিদের দেবার মত আর কিছুই নাই। এখন আমাদের দাবী তিনি ৬ দফা বললেন। চট্টগ্রাম থেকে সাথে সাথে জহুর আহমেদ চৌধুরী বাঙালির মুক্তি সনদ অবহিত করে ৬ দফার প্রতি সমর্থন ঘোষণা করেন। একই সাথে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক এম.এ. আজিজও সমর্থন জ্ঞাপন করেন। ফেব্রæয়ারীতে ৬ দফা নিয়ে মাঠে নামলেন আওয়ামীলীগ। চট্টগ্রামের শহর গ্রামে ৬ দফার তরঙ্গ সৃষ্টি করলেন-জহুর-আজিজ। মার্চে গ্রেপ্তার হন জহুর আহমেদ চৌধুরী। গ্রেপ্তার করে তাঁকে পাঠানো হয়েছিল সিলেট কারাগারে। পাকিস্তানিদের অত্যাচারে দু’কান নষ্ট হয়।
মুক্তিযুদ্ধে কোন এমএলএ, এমপির সন্তান শহীদ হয়নি। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র দেশ মাতৃকায় জীবন দিয়েছে। প্রিয় পুত্রকে হারানোর পরও তিনি মুক্তিযুদ্ধে ইস্টান লিবারেশন কাউন্সিলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে খোন্দকার মোস্তাকের প্ররোচনায় ডানপন্তিরা এমএলএ – এমপিদের একটি ক্ষুদ্র অংশকে নিয়ে ইস্টান লিবারেশন কাউন্সিলের নেতৃত্ব থেকে জহুর আহমেদ চৌধুরী সরানোর ষড়যন্ত্র করে সফল হয়নি। শেখ জহুল হক মনি-৪ ছাত্র নেতা নুরে সিদ্দিকি, আ.শ.ম আবদু রব, আবদুল কুদ্দুছ মাখন, শাহজান সিরাজের দৃঢ় সমর্থনের কারনে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা যে সাফল্য মুক্তি যোদ্ধারা কখনো ভুলবে না।
জহুর আহমেদ চৌধুরীর দূরদর্শিতা সম্পর্কে দেখেছি। বঙ্গবন্ধু আগরতলা মামলা থেকে মুক্তি লাভের পর চট্টগ্রামে ৪ টা এপ্রিল পলোগ্রাউন্ড ময়দানে জনসভায় ভাষণ দিবে ঠিক হলো। প্রচার চলছে, পোস্টার ছাপানো হয় লাগানো বাকী এমন সময় ২৪ মার্চ সন্ধ্যায় হঠাৎ রেডিওতে পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত বেজে উঠল সাথে সাথে প্রেসিডেন্ট আয়ুব খাঁন কাউমের উদ্যোগে ভাষণ দিয়ে পদত্যাগ করলেন, বক্তৃতা শুনছিলেন জহুর আহমেদ চৌধুরীর বাসভবনের বৈঠকখানা এম. আজিজ সহ দু’জনে, তারা বসেছিল সভা সফল করার জন্য। ভাষণ শুনে এমএ আজিজ সাহেব বললেন স্পিকার জব্বার খাঁন প্রেসিডেন্ট হয়ে গেল। জহুর আহমেদ চৌধুরী বললেন কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেন, আর এফ জেনারেল আসছে। ৫ মিনিট পর জেনারেল ইয়াইয়া খাঁন জাতিকে শান্ত থাকার আহবান জানিয়ে সামরিক শান জারি করে নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসাবে ঘোষণা দিলেন।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো বাংলাদেশ সফরে আসলে তখন জহুর আহমেদ চৌধুরী পি জি হাস পথালে মৃত্যুর প্রহড় গুনছে। ভুট্টোর আগমনের খবর শুনে বলেন, ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পারোয়ানা নিয়ে এসেছে তাঁর চিন্তা চেতনা এত প্রখর ছিল তিনি অগ্রিম চিন্তা করতেন।
২৫শে মার্চ বিকাল বেলা চট্টেশ^রী রোডস্থ ওয়াপদা রেস্ট হাউজে কেপ্টেন মনসুর আলী সাহেব ফোন করেন। জহুর আহমেদ চৌধুরী ওয়াপদা শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন। তিনি জরুরী প্রয়োজনে সে রেস্ট হাউজে থাকতেন। মনসুর আলী সাহেব যখন ফোন করেন তখন জহুর আহমেদ চৌধুরী আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর কুজকাওয়াজে প্রধান অতিথি হিসাবে সেলুয়েট নিচ্ছিলেন। মনসুর আলী সাহেবের খবর পেয়ে দ্রæত তিনি রেস্ট হাউজে আসেন। কিন্তু ততক্ষণে ফোন বন্ধ হয়ে যায়। অনেক প্রচেষ্টায় টিএন্ডটির কর্মচারীদের প্রচেষ্টায় তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথে কথা বলেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে কথা বলে চট্টগ্রামের তখনকার এডিসি এবি চৌধুরী পুলিশের এসপি কয়েকজন এমএমএ, এমপি-কে নিয়ে বৈঠক করে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার কথা জানিয়ে দেন এবং সিতাকুন্ডের এখানে অধ্যাপক সামসুল হককে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা সাইক্রেফাইশ করার জন্য টাকা দিয়ে পাঠান। অধ্যাপক সামসুল হক পরে মালেক মন্ত্রী সভার রিলিফ মন্ত্রী হন। বঙ্গবন্ধুর কেমন বিশ^স্ত বন্ধু বা সহকর্মী যার নিকট স্বাধীনতার ঘোষণা প্রেরণ করেন।
তিনি শ্রমমন্ত্রী থাকা কালে প্রথম শ্রমনীতি ঘোষণা করেন। পে-কমিশন এবং মজুরী কমিশন একই সাথে ঘোষণা করেন। মজুরী কমিশনের মজুরী পে-কমিশন থেকে অধীক ছিল। বঙ্গবন্ধু তাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার জন্য বলেন। তিনি যেতে রাজি হয়নি। তিনি বঙ্গবন্ধুকে বলেন আমি স্বাস্থ্যমন্ত্রী আমি যদি বিদেশে চিকিৎসা করি তাহলে আমার দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর মানুষের আস্থা হারাবে। বর্তমানে পিজি হাসপাতালে চট্টগ্রাম চিকিৎসা হাসপাতাল তিনি প্রতিষ্ঠা করে। ৫৪ সালের নির্বাচনে গরীবের নেত জহুর আহমেদ চৌধুরী চট্টগ্রামের অন্যতম ধনকুব রেয়াজউদ্দিন বাজারের মালিক রফিক উদ্দিন সিদ্দিকিকে হারিয়ে পাকিস্তানের এমএলএ নির্বাচীত হন। দুঃখের বিষয় চট্টগ্রাম মহানগরীর একটি প্রধান সড়কের নামকরণ প্রয়োজন ছিল। এমএল হওয়ার পূর্বে তিনি বাগমনিরাম, লালখান বাজার, চকবাজার নিয়ে গঠিত চট্টগ্রাম পৌর সভার ১নং ওয়ার্ডের কমিশনার নির্বাচিত হন। আজকাল ছোট একটি পদ পদবী পেলে কোটি কোটি টাকা তার হাতের মুঠোয়। জহুর আহমেদ চৌধুরীর মৃত্যুকালে পকেটে ছিল ১২০০/- টাকা। এমন ক্ষণজন্মা পুরুষ কি আমরা আর পাবো।
লেখক : রাজনীতিক ও প্রাবন্ধিক