কোটা আন্দোলন, সহিংসতা এবং আমাদের ভবিষ্যৎ

10

সাফাত বিন ছানাউল্লাহ্

মহান মুক্তিযুদ্ধের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের জন্য ৩০% কোটা নির্ধারণ করেছিলেন। কারণ তখনকার হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা পরিবার ছিলো অসচ্ছল। দুবেলা দুমুঠো কোনরকমে দিনে এনে দিনে খেতো। ১৯৭৫ এর ভয়াল কালরাত্রির পর সেই কোটা বাতিল করা হয়। এবার আপনারাই বলেন, কারা মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলো? ১৯৯৬ সালে দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে আবারও কোটা পদ্ধতি চালু করে। ২০০১ সালে সেই মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তি ক্ষমতা দখল করে বাতিল করে দেয়। ২০০৮ সালে আবারও জনসমর্থন নিয়ে রাষ্ট্র সরকার গঠন করে ফিরিয়ে আনে কোটা পদ্ধতি। ২০১৮ সালে সরকারের মনে হলো দেশ যখন ডিজিটাল হচ্ছে মেধাবীদের সুযোগ দেয়া উচিত। কারণ, মেধাবীদের হাতেই দেশ এগিয়ে যাবে। আইনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারই সেসময় কোটা পদ্ধতি বাতিল ঘোষণা করে। এরপর মুক্তিযোদ্ধাদের আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে রায় দেয় আদালত। আবারো রিভিউ আবেদন করা হয় সরকারের পক্ষ থেকে। শুনানি শেষে রায়ের অপেক্ষায় ছিলো পুরো দেশ। অনেকেই আশ্বস্ত করেছে রায় মেধাবীদের পক্ষেই যাবে। কিন্তু কোনকিছু না শুনেই মাঠে নেমে গেলো শিক্ষার্থীরা। চারদিকে শুরু হলো আন্দোলনের নামে দাঙ্গা-মারামারি। অসংখ্য নিরীহ মানুষ, ছাত্র-ছাত্রী প্রাণ হারালো পুলিশের গুলিতে। আন্দোলন ঠেকাতে গিয়ে সরকারি দলের অনেকের মৃত্যু হলো। হামলা হলো রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে। ধ্বংস করা হলো নথিপত্র।
এই দায় কার? এমন তো হওয়ার কথা ছিলোনা? বর্তমান সরকারের ভুলগুলো আমিও একবাক্যে স্বীকার করি। দেশের মানুষ মনে করছেন, সরকারের পক্ষ থেকে আগেই যদি কোন প্রতিনিধি কিংবা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আন্দোলনকারীদের আশ্বস্ত করতেন তাহলে পরিস্থিতি চরম পর্যায়ে যেতো না। তবে ১৭ জুলাই প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দ্যেশ্যে দেয়া ভাষণে আন্দোলনকারীদের এতটুকই আশ্বাস্থ করেছিলেন, শুনানী এগিয়ে আনা হবে, রায় ছাত্রদেও পক্ষে যাবে। দেশের নির্বাহী প্রধান যখন এমনটি আশ্বাস্থ করেন, তখন আর আন্দোরন কেন? অথচ দেশের মানুষ দেখর প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলার পর আন্দোলন সহিংস হয়ে উঠল। ছাত্রদের শুরুর দাবি ছিলো কোটা সংস্কার, এরপর বৈষম্য বিরোধী পরে যোগ হল সরকার পতন। আপনি একটা দলের বিরোধীতা করতেই পারেন। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদী হয়ে দেশের বিপক্ষে যেতে পারেন না। স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারেন না। কথায় কথায় জাতির পিতার অবমাননা করতে পারেন না।
এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন ‘কোটা কি মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিরা না পেয়ে রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে’! এমন দুঃসাহসিক উত্তর দেয়া শেখ হাসিনার পক্ষেই সম্ভব। ছোট্ট এই বাক্যের ব্যাখ্যা যারা করতে জানেনা ওরা নাকি মেধাবী? প্রশ্ন রেখে গেলাম। আমি আরো বিশদভাবে বলি। যারা এই দেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া পাকিস্তানি হায়েনার কবল থেকে রক্ষা করে স্বাধীন করেছে ওদের নাতিপুতিরা না পেয়ে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে? ঘরে নববধূকে রেখে যৌবনের চেয়ে যার দেশের মায়া বেশি ছিলো তাদের নাতিপুতিরা না পেয়ে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে? লাল-সবুজের পতাকা কপালে বেঁধে শত্রুমুক্ত করার শপথ নিয়ে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে গিয়ে আর ফিরে আসেনি ওদের নাতিপুতিরা না পেয়ে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে? মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল সেই অপরাধে পাকিস্তানি হায়েনা ও এদেশীয় সহযোগীদের নির্মম নির্যাতনের পর বাঘের খাঁচায় ছেড়ে দেয়া হয়েছিল যাকে (এরপরের করুণ ইতিহাস সবাই কমবেশি জানে), সেই বীরযোদ্ধার নাতিপুতিরা না পেয়ে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে? চোখের সামনে স্ত্রী, কন্যাকে ধর্ষিত হতে দেখেছে যেজন, তার নাতিপুতিরা না পেয়ে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে? অদ্ভুত এই দেশের মেধাবীদের ঘিলু মগজ। ওদের অত্যন্ত সুকৌশলে মগজ ধোলাই করছে নরপশুদের প্রেতাত্মারা।
সাইদ, তাহমিদ, মুগ্ধ, ছোট ছোট বাচ্চা, কয়েকজন বোন, সেসব সময়ের শ্রেষ্ঠ মেধাবী মুখ অকালে ঝরে পড়েছে তাদের মৃত্যুর জন্য দায় কার? কয়েকজনের ভাষ্য মতে, মানলাম সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভেতর জঙ্গি, সন্ত্রাসী প্রবেশ করেনি, কিন্তু তাদের আচরণ কেন উগ্র? এদের ছাত্র-ছাত্রী বললে পড়া-লেখাকে অপমান করা হবে। যেদিন স্কুল-কলেজ থেকে বেতের বাড়ি উঠে গেছে ছাত্র-ছাত্রীদের আচরণগত পরিবর্তন এসেছে কয়েকগুণ। এসবের জন্য সরকারও কম দায়ী নয়। আন্দোলনকারীদের বক্তব্য, ফেসবুক পোস্টে বুঝা যায় এরা সরাসরি দেশ বিরোধিতায় নেমেছে। এরা কারা? আসলেই কি এরা কোটা নিয়ে মাঠে নেমেছে নাকি ইস্যু বানিয়ে ১৯৭৫ এবং ২০০৪ সালের চাইতেও ভয়াবহ কোন কিছু করতে চেয়েছে? জনমনে একটা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে! কোটা আন্দোলন করতে গিয়ে ধর্মের দিক দিয়ে মুসলমান ছাড়াও হিন্দু, বৌদ্ধও নিহত হয়েছে। সকলের আত্মার শান্তি কামনা করছি। স¤প্রতি কয়েকটা পেইজ, একাধিক জনের টাইমলাইনে দেখলাম নামের আগে ‘শহীদ’ শব্দ ব্যবহার করেছে। অনেকে লিখছে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী যারা মারা গেছে তাদের নামের তালিকা আলাদা করা উচিত। দরদ যেন উথলায় পড়ে। ব্যাপারটা ভালো লাগলো। অথচ ওরাই মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ভিন্ন ধর্মাবলম্বী যারা শহীদ হয়েছে তাদের শহীদ বলা যাবেনা এই কথা বিভিন্ন লেখায় তুলে ধরে ধর্মীয় পুস্তকের দলিল দিয়ে। বিভিন্ন সময় হিন্দু, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সম্পর্কে বিদ্বেষ পোষণ করে। আরো দেখেছি ফেসবুক আইডিতে গুজব ছড়িয়েছে শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছে! খালেদা জিয়ার মৃত্যু হয়েছে! সেই সাথে, আন্দোলন প্রতিহত করার জন্য নাকি ভারত থেকে গুন্ডা বাহিনী আনা হয়েছে! যারা প্রায় ৬৫% হিন্দি ভাষায় কথা বলে! ওরা বাংলা জানেনা। একবার চিন্তা করে দেখুন, একটি দেশকে ধ্বংস করার জন্য কিভাবে জঘন্যসব অপপ্রচার বা গুজব রটানো হয়েছে। এই ঘটনাগুলো থেকে কি আমাদের বোধোদয় হবেনা কারা এরা? আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। স্রোতে গা ভাসিয়ে দিলে হবেনা। আমার বুঝে আসছেনা আওয়ামী লীগ শাসনের বিগত ১৫টি বছর পাঠ্যবইয়ে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস, বঙ্গবন্ধুর জীবনের নানাদিক আর আওয়ামী লীগের গুণগান পড়েও সম্পূর্ণ আওয়ামী লীগ আর স্বাধীনতা বিরোধী একটা প্রজন্ম কিভাবে তৈরি হলো? সহজেই প্রতীয়মান হয় মেধাবীদের কাজে লাগিয়েছে ১৯৭১ এর পরাজিত শক্তি। এইক্ষেত্রে বলা যায়, বর্তমান সরকার ব্যর্থ। সরকারের সহযোগী ছাত্র সংগঠন ব্যর্থ। ছাত্রলীগ তাদের আদর্শ দিয়ে ছাত্র সমাজকে আকর্ষণ করতে পারে নি। বললে অত্যুক্তি হবে না, বৃহৎ একটা প্রজন্ম বিপথগামী হচ্ছে শাসকদলের উদাসীনতার ফলশ্রুতিতে। এর পরিণতি ভবিষ্যত বাংলাদেশে ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। এমনও দিন আসতে পারে দাদা দেখেছে ব্রিটিশ-শাসিত দেশ, বাবা দেখেছে পাকিস্তানি শোষণ, আমরা আছি স্বাধীন বাংলাদেশে আর আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম আবারো পরাধীন বর্বর জনপদে বেড়ে উঠবে। চক্রটির পরিকল্পনা খুবই সুদূরপ্রসারী। বাংলাদেশ যদি ৯ মাসে স্বাধীন না হয়ে ৯ বছর বা বছরের পর পর যুদ্ধ শেষে বিজয় অর্জন করতো তবেই সবাই স্বাধীনতাকে মূল্যায়ন করতো। মায়ের মধুর ভাষা বাংলার বদলে উর্দু আর নরপিশাচদের বুটজুতোর লাথি ভালো ছিলো এই জাতির জন্য! আপনি যদি দেশকে ভালোবাসেন, পরিষ্কার মানসিকতা ধারণ করে একবার গোটা বিষয়টা মগজে সাজিয়ে নিলে দিনের আলোর মতো সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।
সরকার চাইলেই সব দ্রুততম সময়ের মধ্যে সব ঠিক করতে পারে। আবার দেখা যায় পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসলে উসকানিমূলক কথা বলে সাধারণ জনগণকে খেপিয়ে দিচ্ছে কয়েকজন নেতা-মন্ত্রী। এই অবস্থায় পরিস্থিতি দিনের পর দিন আরো ঘোলাটে আকার ধারণ করছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উচিত শিক্ষার্থীদের উপর যে পুলিশ সদস্যরা গুলি ছুড়েছে, সরকার দলীয় রাজনৈতিক কর্মীদের যারা হত্যা করেছে, রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন প্রকল্প যারা নষ্ট করেছে তাদেরকে বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা।
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক, সংগঠক