কী ছিলেন- কোথায় নিপতিত হলেন?

2

মোহাম্মদ সফিউল আলম

ছিলেন দোর্দন্ড প্রতাপশালী পুলিশ অফিসার। ছিলো বর্ণাঢ্য সিভিল সার্ভিস ক্যারিয়ার। ছিলো ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন আকর্ষণীয় ফিগারের সাথে সরকারি কর্মকর্তা হবার প্রয়োজনীয় সব গুণাবলী। ছিলেন দেশের গুরুত্বপূর্ণ দুই আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সর্বোচ্চ পদাধিকারী- আইজিপি, র‌্যাবের মহাপরিচালক। কিন্তু দিনশেষে প্রমানিত হলো- ওই পদগুলো আপনি অলংকৃত করতে পরেন নি বরং করেছেন চরমভাবে কলংকিত। আপনার ছিলো অপরিসীম ক্ষমতা। টইটম্বুর অহংকার। কিন্তু ছিলো না সততা। অন্তরে ছিলো না বিন্দু পরিমাণ বিবেক, মানবতা। সেখানে শুধুই ছিলো উচ্চ পদের উচ্চাভিলাস আর অপরিসীম অবৈধ সম্পদের লোভ। পদ ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে টাকা বানানোর সীমাহীন লালসা। জানা ছিলো ক্ষমতাসীন প্রভুদের প্রিয়ভাজন হবার সমস্ত অপকৌশল।
অঢেল টাকা আর প্রমোশনের লোভে ক্ষমতাসীনদেরকে লাগাতার দিয়ে গেছেন সীমাহীন অতি উৎসাহী সব সার্ভিস। বিনিময়ে যা ছেয়েছেন সবই পেয়েছেনও। ‘গোপালী কর্মকর্তা’ হিসেবে চাকরি জীবনের পুরোটা সময়ই শুধু নয়, অবসরেও ভোগ করেছেন রাষ্ট্রীয় যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা। নাগরিক অধিকার ও গণতন্ত্রকে দিনের পর দিন পিষ্ট করেছেন বুটের তলায়। বিরোধী দল-মত নিধনযজ্ঞ চালিয়েছেন অপরিসীম দানবিকতায়। নিদারুণ নিষ্ঠুরতায় খালি করেছেন হাজারো মায়ের বুক। ‘পাবলিক সার্ভেন্টের’ দায়িত্বকে বুটের তলায় পিষিয়ে দেশের নাগরিকদের উপর চালিয়েছেন নির্যাতনের স্টিম রোলার। শাপলা চত্বরে কয়েক শত আলেম হত্যা এবং হাজার হাজার আলেমকে আহত ও পঙ্গু করার কাজে যে নৃশংসতার পরিচয় দিয়েছেন ইতিহাসে সেটা নজিরবিহীন। নিবেদিত প্রাণ সার্ভিসে তুষ্ট ক্ষমতাসীনরাও আপনাকে মাথায় তুলে রেখেছিলো। আর সেই সুযোগে করেছেন সীমাহীন দুর্নীতি। সরকারি টাকা মেরেছেন।
সাধারণ মানুষকে টকিয়ে, অস্ত্র ঠেকিয়ে, জোর জবরদস্তি করে আটকিয়ে, ভয়-ভীতি দেখিয়ে, জুলুম-নির্যাতন করে আদায় করেছেন অঢেল টাকা। চাকরি জীবনের পুরো সময়ে বেতন-ভাতা হিসেবে বৈধভাবে আয় করেছেন প্রায় দু’কোটি টাকা। অথচ অবসরে যাবার পরপরই অনুসন্ধানী মিডিয়া খুঁজে পেলো নগত টাকা, দামি জমি, বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, গরু-মাছের খামার, বিলাসী ইকোপার্ক, সঞ্চয়পত্র, এবং বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার ইত্যাদি মিলিয়ে হাজার কোটিরও বেশি টাকার সম্পদ।
অপকর্ম বেশি দিন লুকানো যায় না। চাকরিরত অবস্থায় ক্ষমতার দাপট আর ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে দানবীয় প্রতিশোধের ভয়ে কেউ টু শব্দও করতে না পারলেও এখন সবাই ঢেকে থাকা অপকর্ম শুধু প্রকাশই করছে না, বরং ‘বেনজিরের দুর্নীতি’ই হয়ে উঠেছে ‘টক অফ দ্য কান্ট্রি’। সাহসী প্রতিবেদন ‘বেনজিরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ’এর জন্য দৈনিক কালের কন্ঠকে ধন্যবাদ। সেটাই ছিলো এ ক্ষেত্রে ‘পাইওনিয়ারিং রিপোর্ট’। এর পর প্রায় প্রতিদিনই বেরিয়ে আসছে অবৈধভাবে উপার্জিত সম্পদের নতুন নতুন সংবাদ। জেলায় জেলায়, শহরে শহরে মিলছে ফ্ল্যাট আর জমির হদিস। শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও পাওয়া যাচ্ছে কোটি কোটি টাকার সম্পদের তথ্য।
নিজের মেয়েগুলোর জীবন নিজেই কলংকিত করে দিলেন। বাবার পরিচয়কে ব্যবহার করে নিজেদের প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে ওরা ঠিকই প্রতিষ্ঠিত হতে পারতো। কিন্তু তাদেরকে সম্মানজনকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে না দিয়ে তাদের গলায় ঝুলিয়ে দিলেন কোটি কোটি টাকার কলংকিত সম্পদ। অবৈধ টাকা হাতানোর কাজে ওদের তেমন কোন দায় না থাকলেও আপনার সাথে ওদেরকেও অসম্মানজনকভাবে দেশ থেকে পালাতে হলো। নিজেরা অপরাধ না করলেও বাকি জীবনে ওরা কি কখনও এসব অবৈধ সম্পদের দায় আর অপরাধবোধ থেকে মুক্ত হতে পারবে?
পূর্বাচলে ৪০ কাঠার সুবিশাল জায়গাজুড়ে আপনার বিলাসী ডুপ্লেক্স বাড়িটির মূল্য নাকি কমপক্ষে ৪৫ কোটি টাকা। অথচ একটি সুখী, সুন্দর, সম্মানজনক জীবনের জন্য ৪৫ কোটি টাকার বাড়ির কোন প্রয়োজন নেই। হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ সুখ ও সম্মানের কোন গ্যারান্টি নয়। এতোটা নজিরবিহীন দুর্নীতির কোনই প্রয়োজন ছিলো কী?! চাকরি থেকে বেতন-ভাতা-পেনশন বাবত যা পেয়েছেন সেগুলো দিয়ে বাকি জীবনটা সম্মানজনক ভাবে কাটিয়ে দিতে পারতেন। জীবন তো একটাই। এক জীবনে এতো সম্পদের পাহাড় লাগবে কেন? একজন শ্রমজীবী মানুষ হাড়ভাংগা পরিশ্রমের সৎ উপার্জনে কোন এক বস্তির ছোট্ট কোন ঝুপড়ি ঘরে বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে পরম প্রশান্তিতে ঘুমাতে পারে। অথচ ৪৫ কোটির ডুপ্লেক্স, অসংখ্য বিলাসবহুল ফ্ল্যাট আর হাজার কোটি টাকার সম্পদ ফেলে জন্মভূমি থেকে আপনাকে গোপনে পালাতে হলো। ‘সেকেন্ড হোম’এর খোঁজে রিফুজি ভিসায় ঘুরতে হচ্ছে পৃথিবীর দেশে দেশে। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে দার্শনিক সক্রেটিসের সেই উক্তিটি আপনার নজরে না আসার কথা নয় যেখানে সক্রেটিস বলেছিলেন How many things can I do without? সামগ্রীর বাহুল্য জীবনকে সুখী-সুন্দর করে না বরং অপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর বর্জনের মাধ্যমেই জীবনে প্রকৃত সুখ অনুভব করা যায়। সক্রেটিসের বিখ্যাত এই বাণীর মর্মার্থ অনুধাবন করা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। আপনিও পারেন নি। তাই আপনার কাছে অঢেল টাকা আর সম্পদের পাহাড়ই ছিলো সুখের সামগ্রী।
অভিসপ্ত, অস্থির জীবনের এই দুঃসময়ে দু’মিনিট সময় নিয়ে একটু ভেবে দেখার চেষ্টা করবেন- কী ছিলেন!….. কোথায় নিপতিত হলেন! আপনাকে অবলম্বন করে যারা নিজেদের আখের গুছিয়েছিলো তারাও এখন আপনার সাথে নেই। যারা একটু সান্নিধ্য পেতে কিংবা কোন অজুহাতে আপনার সাথে একটা সেলফি নিতে মরিয়া হয়ে চেষ্টা করতো তারাও এখন আপনার পরিচয় ব্যবহার করতে লজ্জাবোধ করছে। মানুষের ঘৃণার বন্যায় আপনি এখন আকণ্ঠ নিমজ্জিত। আপনাকে ব্যবহার করে যারা নিজেদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করেছিলো তাদের কাছেও আপনি এখন ব্যবহৃত টয়লেট টিস্যু। তারাও এখন আপনাকে বিচারের আওতায় আনতে (অন্ততঃ বক্তৃতা-বিবৃতিতে হলেও) তৎপর। আপনি এখন শহরের সবচেয়ে দুর্গন্ধময় আবর্জনার স্তুপে নিক্ষিপ্ত।
দুনিয়ার সীমিত জীবন শেষে একদিনতো মরতেই হবে। দুদকের তদন্ত ও ইহকালের বিচার প্রক্রিয়া নানা কারণে বাস্তবায়িত নাও হতে পারে। তবে পরকালের বিচার শতভাগ নিশ্চিত। শেষ বিচারের সেই কঠিন দিনে অবৈধভাবে হাতিয়ে নেয়া হাজার কোটি টাকার সম্পদের পাহাড় গলায় ঝুলানো অবস্থায় মহান সুবিচারক আল্লাহর দরবারে জবাবদিহি করতে পারবেন তো!
লেখক: নিউইয়র্ক প্রবাসী