কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত

0

 

কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত, বিশ শতকের চল্লিশের দশকে সেসমস্ত তরুণ কবি বাংলা আধুনিক কবিতায় নতুন পথের সূচনা করেন তাঁদের অন্যতম কবি ছিলেন। ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা করেও তিনি কলকাতা কেন্দ্রিক আধুনিক সাহিত্যের বাইরে গিয়ে মূলত তৎকালীন পূর্ব বাংলার নিজস্ব প্রগতিশীল সাহিত্যের ধারক ও বাহক ছিলেন।
কিরণশঙ্কর সেনগুপ্তর জন্ম বৃটিশ ভারতের অধুনা বাংলাদেশের ঢাকায়। পিতা বিজয়শঙ্কর সেনগুপ্ত ছিলেন ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ভূগোলের শিক্ষক আর মাতা ছিলেন বঙ্কিম-সুহৃদ ‘সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস’ লেখক, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রজনীকান্ত গুপ্তর কন্যা মায়াময়ী। স্কুলে পড়ার সময় কিছু দিন তিনি অনিল রায়ের শ্রীসংঘ নামের সন্ত্রাসবাদী সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামী দলে যুক্ত হয়ে ছিলেন। তিনি ঢাকা কলেজ থেকে বি.এ ও পরে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজীতে এম.এ. পাশ করে ঢাকা প্রিয়নাথ স্কুলে শিক্ষকতা করেন। পরে নারায়ণগঞ্জে কাকার ব্যবসায় যুক্ত হয়ে ছিলেন।
ছাত্রাবস্থাতেই কিরণশঙ্কর লেখালেখি শুরু করেন। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে তার কবিতা প্রকাশিত হয় বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায়। ওই বছরেই পরিচয় পত্রিকায় কবিতা ও ঢাকার সাপ্তাহিক ‘সোনার বাংলা’য় তার প্রথম প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। তার লেখা গল্প প্রকাশিত হয় ‘অগ্রগতি’ ও ‘স্বদেশ’ পত্রিকায়। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা থেকে প্রকাশিত তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘স্বপ্নসাধনা’ য় ভূমিকা লিখেছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ। ঢাকা কলেজে বি.এ পড়ার সময় তিনি ঢাকা হলের পত্রিকা ‘শতদল’ এর সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৩৯ – ৪১ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা থেকে প্রকাশিত মাসিক সাহিত্য পত্রিকা শান্তি’ র সহ-সম্পাদক ছিলেন। তাছাড়া তিনি লীলা রায় (নাগ) ও অনিল রায়ের পত্রিকা জয়শ্রী সহ অনেক পত্র পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাল্যবন্ধু সোমেন চন্দের) আহবানে ‘ঢাকা প্রগতি লেখক সংঘ’-এ যোগ দেন এবং আজীবন যুক্ত থাকেন। ঢাকা প্রগতি লেখক সংঘের উদ্যোগে ঢাকা জেলা সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি” গড়ে উঠলে তিনি তার যুগ্ম সম্পাদক হন। এই সমিতি ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে আক্রান্ত সোভিয়েতের উপর সংগৃহীত ছবি, ফটো, শতাধিক পোস্টার ইত্যাদি নিয়ে এক অভিনব প্রদর্শনীর আয়োজন করে। এর উদ্বোধন করেছিলেন ড. মহম্মদ শহীদুল্লাহ। এই সমিতি ঢাকায় ফ্যাসিবাদ বিরোধী সম্মেলনেরও আয়োজন করে। এই সম্মেলনে যোগদানের জন্য রেল শ্রমিকদের একটি শোভাযাত্রা পরিচালনার কালে প্রতিশ্রুতিবান লেখক সোমেন চন্দ বিরোধীদের নৃশংস ভাবে নিহত হন। এই ঘটনার পরে প্রকাশিত পাক্ষিক প্রতিরোধ’ পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন তিনি। তার সম্পাদনায় ‘সাহিত্য চিন্তা পত্রিকা তার মৃত্যুকাল পর্যন্ত প্রকাশিত হয়। ১৯৪৩-৪৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য হন ও সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের দায়িত্ব নেন। পরে অবশ্য সদস্যপদ নবীকরণ করেন নি, তবুও তিনি আত্মগোপনকারী নেতাদের পাকিস্তান আমলে দমন পীড়নের মাঝেও আশ্রয় দিয়েছেন। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে সোমেন চন্দের মাসিমা বীণা বিশ্বাসকে রেজিস্ট্রি করে বিবাহ করেন এবং ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পুনর্বাসন দপ্তরে কাজ নেন। বন্ধু সোমেন চন্দের বন্ধুত্ব, সাহিত্য ও আত্মত্যাগ কিরণশঙ্করকে আজীবন আচ্ছাদিত করে রেখেছিল। পশ্চিমবঙ্গে তারই প্রচেষ্টায় পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি থেকে ‘সোমেন চন্দ স্মৃতি পুরস্কার’ প্রদান সম্ভব হয়। তার উদ্যোগে এবং পবিত্র সরকারের সম্পাদনায় পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি থেকে ‘সোমেন চন্দ গল্প সংগ্রহ প্রকাশিত হয়েছে। কিরণশঙ্করের বহু কবিতা ইংরাজী ও বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং তিনি নিজেও ইংরাজী হতে বিভিন্ন দেশের কবিতা বাংলায় অনুবাদও করেছেন। তার রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল-
* স্বর ও অন্যান্য কবিতা (১৯৫৩) * মানুষ জীবন (১৯৫৪) * দিনযাপন * নতুন আঁচড় * ভেতরে বাইরে * সময় ও সাহিত্য * এই এক সময় * কবিতার রূপ রূপান্তর * রুক্ষদিনের কবিতা * বৃষ্টি এলে * মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরকাল * কবিতার মানবিক উচ্চারণ ও অন্যান্য ভাবনা * সোমেন চন্দের জীবনী * চল্লিশ শতকের ঢাকা (সরদার ফজলুল করিমের সঙ্গে)* এক শতাব্দী শতক (প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে) * রজনীকান্ত: ব্যক্তিত্ব ও মনীষা (জ্যোৎস্না সিংহরায়ের সঙ্গে) * সোমেন চন্দের সুনির্বাচিত গল্প * সোমেন চন্দ স্মারক গ্রন্থ-আগুনের পাখি, আগুনের অক্ষর (পবিত্র সরকারের সঙ্গে)
কবি কিরণশঙ্কর ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে কবিতার জন্য কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত পুরস্কার এবং নির্বাচিত কবিত গ্রন্থের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রবীন্দ্র পুরস্কার লাভ করেন।
কবি কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দের ১লা মে পরলোক গমন করেন।
সূত্র : উইকিপিডিয়া