কাঠবাগানে হরিণছানা

55

 

অনেক আগের কথা। তখন উঁচুনিচু টিলায় সাজানো রাংটিয়ার গারো পাহাড়। পাহাড়ের বুকজুড়ে গজারি, গামার, চাপালিশ আর বেতসলতা। কুলকুল শব্দ করে বয়ে চলে পাহাড়ি সোমেশ্বরীর জলধারা। নদীর পাড়ে যত বুনো হরিণের পদচারণা।
একদিন এক মা হরিণ তার ছানাকে রেখে পানি পান করতে নদীতে নেমে যায়। তখন হরিণ ছানাটা উল্টো দিকে মুখ রেখে টিলার ভাঁজে পাতার ফাঁকে একাই বসেছিল। হঠাৎ দূর থেকে সে একটা ছোট্ট বাঘকে দেখতে পেল। ছানাটা আগে কখনই বাঘ দেখেনি। তাই সে খুব সুন্দর ডোরাকাটা বাঘটা দেখেই এগিয়ে গেল। কিছুটা কাছে যেতেই ছানাটা বুঝতে পারলো- তার বাঘকে দেখতে চাওয়াটা খুবই ভুল হয়েছে। বাঘটাও এতদিন মায়ের শিকারে আহার করত। সে মায়ের থেকে জেনেছে- যে বাঘ প্রথম শিকার হরিণ দিয়ে শুরু করে, সে হয় বাঘের রাজা। ভীষণ রাগী আর ভয়ানক বাঘটাকে দেখে হরিণছানা প্রাণ ভয়ে দিল এক ভোঁদৌড়। তখন পিছুপিছু বাঘটাও দৌড়াতে লাগলো। দৌড়াতে গিয়ে এক বানরের সাথেও দখা হল। তবুও সে দৌড়ে চলল। একসময় হরিণ ছানা আর বাঘ এক বাড়িতে ঢুকে গেল। বানরও এক ডাল থেকে অন্য ডালে লাফ দিয়ে কাঁঠালচাঁপার ডালে এসে বসল। বাড়িতে ঢুকেই বাঘ হাতিকে দেখে ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল। বাঘকে দেখে হাতিটা জোরে জোরে আওয়াজ করতে থাকায় হরিণছানা ভয়ে ফুলবাগানে ঢুকে গেল। তখন বাগানে বাড়ির মালিক আর তাঁর ছোট্ট ছেলে ফুল গাছের যত্ন নিচ্ছিল। ছোট্ট ছেলেটা হরিণ ছানাটাকে দেখে খুব খুশি হয়ে বলল, ‘বাবা, দেখো কী সুন্দর হরিণছানা! বাবা, ও যে বন ছেড়ে এখানে চলে এলো, ওর মা খুঁজে না পেয়ে কাঁদবে না?’
‘নিশ্চয়ই কাঁদবে। আহারে, কতোই না বিপদে পড়ে এখানে এসেছে! আমরা ওকে বনে রেখে আসব।’ বাবা জবাবে বললেন।
এবার হরিণ ছানার মনে শান্তি এল। সে রঙ্গন গাছের নিচ থেকে বেড়িয়ে এসে বলল, ‘চাচ্চু, আমি তো পথ ভুলে গেছি! এতবড় বনের কোথায় ঢুকবো?’
এবার কাঁঠালচাঁপার গাছ থেকে বানরটা নেমে বলল, ‘হরিণেরা হল আমাদের বন্ধু। তাই তোমার পিছুপিছু আমিও এসেছি। আমি ঠিক মতোই পথ চিনি। আমিই পথ দেখিয়ে দেব।’
তখন বাড়ির মালিক বললেন, ‘তোমরা সবাই আমার হাতির পিঠে উঠে এসো।’
তখন হরিণ ছানা বলল, ‘পথে যদি বাঘ বের হয়…?’
হাতি বাঘের চেয়ে শক্তিশালী। হাতি তার শুঁড় দিয়ে বাঘকে শূন্যে তুলে ছুঁড়ে মারতে পারে। ইচ্ছে করলেই বাঘকে পা দিয়ে চাপ দিয়ে ফানুষের মতো ফুটিয়ে ফেলতে পারে।’ বাড়ির মালিক বললেন।
এরপর তারা সবাই হাতির পিঠে চড়ে বনের গভীরে রওনা হল। একসময় সবাই সেই হরিণ মায়ের ঝোঁপের কাছে পৌঁছাল। কৃতজ্ঞতায় হরিণ মা বলল, ‘ভালো মানুষদের ফুলের মতো একটা মন থাকে। তাই তারা কখনোই কারোর ক্ষতি করে না। তাদের জন্যই হয়তো আজও এই পৃথিবীটা টিকে আছে।’
এরপর থেকে মাঝে মাঝেই বনের হরিণ ছানারা উপকারীর কাঠবাগানে এসে ছুটোছুটি করতো। ওরা ওদের পিঠে সেই ছোট্ট ছেলেটাকে বসতেও দিত। আর বানরটা ছেলেটাকে মজার মজার বুনোফল দিয়ে যেত।