কর্মীদের চাপে ক্যাম্পাস ছাড়লো মাহমুদুল-সবুজ

10

আসাদুজ্জামান রিপন

ভর্তির সময় অতিরিক্ত দামে খাম নিতে বাধ্য করে টাকা আদায়, পিকনিকের টাকার ভাগ ভাটোয়ারা নিয়ে কয়েক গ্রæপে বিভক্ত হয়ে পড়েছে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগ। দ্বন্দ্বের জের ধরে কয়েকটি উপগ্রুপ একত্রিত হয়ে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি মাহমুদুল করিম ও সাধারণ সম্পাদক সুভাষ মল্লিক সবুজকে ক্যাম্পাসে অবাঞ্চিত ঘোষণা করেছে। কলেজ ক্যাম্পাস থেকে এই দুই নেতার ছবিসহ সকল ধরনের ব্যানার-পোস্টার সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা বলেন, কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি মাহমুদুল করিম যুবলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর ও সাধারণ সম্পাদক সুভাষ মল্লিক সবুজ চকবাজারের কাউন্সিলর নুর মোস্তফা টিনুর আশীর্বাদে এতদিন ক্যাম্পাসে রাজনীতি করতেন। সম্প্রতি দুই নেতার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠায় দুইজনের উপর বিরক্ত হন বাবর-টিনু। সুযোগটি ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছেন মাহমুদুল-সুভাষ বিরোধীরা। যদিও মাহমুদুল-সুভাষ দুজনই বলছেন, তাদের নেতা শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল।
জানা যায়, চাঁদাবাজির ভাগ ভাটোয়ারা, বড় ভাইকে সালাম দেয়া, প্রেমঘটিত ঠুনকো বিষয় নিয়ে গত পাঁচ বছরে সতের বার সংঘর্ষে জড়ায় চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগ। বেশিরভাগ সংঘর্ষে দুই পক্ষে নেতৃত্বে ছিলেন মাহমুদুল-সুভাষ। সর্বশেষ গত ৯ মে দুই গ্রুপের মারামারিতে আহত হয় সাতজন। এরপর টাকার ভাগ ভাটোয়ারাকে কেন্দ্র করে চাঁদাবাজির অভিযোগে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে কলেজ ক্যাম্পাসে অবাঞ্চিত ঘোষণা করেছে একটি পক্ষ। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দেয়ায় কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। তবে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ পেলে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।
ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ও মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর বলেন, চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ বেশ পুরানো। আমরা বিষয়টি সম্পর্কে অবগত। কারো বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির প্রমাণ পেলে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাছাড়া কমিটির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। নতুন কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শিক্ষামন্ত্রীর অন্যায় প্রশ্রয় দেয় না, অন্যায় সহ্য করতে পারে না। কেউ অপকর্ম আড়াল করতে তার নাম ব্যবহার করে সেটা তিনি বরদাস্ত করবে না।
কলেজের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ফর্ম পূরণ কিংবা সনদ নেওয়া সব কাজে নির্দিষ্ট একটি চাঁদা দিতে হয় বিভাগের বড় ভাইদের। কলেজের যেকোন কাজ করতে হলে টাকা দিতে হয়। ইনকোর্সের নম্বর দেওয়ার কথা বলে বিভাগের নেতারা টাকা নেয়। টাকা না দিলে কলেজে আসতে না দেওয়ারও হুমকি দেয়। তাদের ভয়ে কেউ মুখ খুলে না। তাছাড়া সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে কলেজ রোডের প্রতিটি টং দোকান থেকে চাঁদা তোলা হয়। টং দোকান থেকে প্রতিদিন ২০ থেকে ৫০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়। এ টাকা তোলে তার অনুসারী কলেজ কমিটির উপ ত্রাণ ও দুর্যোগ বিষয়ক সম্পাদক হাবিব উল্লাহ রিয়াদ। সর্বশেষ রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ৪র্থ বর্ষের এডমিট কার্ড আটকিয়ে রাখার অভিযোগ উঠেছে সাধারণ সম্পাদকের অনুসারীদের বিরুদ্ধে।
এতদিন হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর এবং চকবাজার ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূর মোস্তফা টিনুর আশীর্বাদের কারণে তাদের বিরুদ্ধে ভয়ে কেউ কথা বলত না। তাদের আশীর্বাদ না থাকার সুযোগটি ভালোভাবে কাজে লাগিয়েছে কলেজ ছাত্রলীগের সহসভাপতি মনিরুল ইসলাম। গতকাল মনিরের নেতৃত্বে কলেজ ক্যাম্পাসের প্রশাসনিক ভবনের সামনে শীর্ষ দুই নেতার ছবি পুড়িয়ে অবাঞ্চিত ঘোষণা করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এরপর ছাত্রসংসদ থেকে তাদের ছবি সরিয়ে ফেলা হয়। এসময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ক্যাম্পাসে দুই চাঁদাবাজের ঠাঁই নেই বলে স্লোগান দেয়। গত ঈদের আগে থেকে মাহমুদুল করিমকে ক্যাম্পাসে দেখা যায়নি। গতকাল থেকে সুভাষ মল্লিক সবুজকেও ক্যাম্পাস ছাড়ার হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে।
এসব বিষয়ে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি মাহমুদুল করিম বলেন, ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক কারণে গত রমজান থেকে একদিনের জন্যও কলেজে যাই নাই। এ সুযোগে জামায়াত-বিএনপির সহযোগিতায় ক্যাম্পাসকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। চাঁদাবাজির সাথে আমার বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। কলেজ থেকে ছাত্রলীগের রাজনীতি উৎখাত করতে সব জায়গা থেকে ষড়যন্ত্র হচ্ছে।
চাঁদাবাজির বিষয়ে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সুভাষ মল্লিক সবুজ বলেন, কারো কাছ থেকে টাকা নিয়েছি এরকম প্রমাণ কেউ দিতে পারবে না। আন্দোলন করে আমরাই লিফট চালু করেছি। টাকার জন্য কেন আটকে রাখব? এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এসব কথা আপত্তিকর। টাকা দিয়ে বহু নিউজ করা যায়। সভাপতির সাথে দ্বন্দের কারণে একটা পক্ষ এ অভিযোগ করছে। সার্বিক বিষয়ে আমার নেতা শিক্ষামন্ত্রী আবগত আছেন। তিনিসহ সিনিয়ররা এসব বিষয়ে কথা বলতে মানা করেছে।
কলেজ ছাত্রলীগের চারজন নেতার সাথে আলাপ করে জানা যায়, ছাত্রলীগের সভাপতি আর সাধারণ সম্পাদকের কাছে জিম্মি চট্টগ্রাম কলেজ। কলেজের যেকোন কাজ করতে গেলে নির্দিষ্ট অংকের টাকা তাদের হাতে পৌঁছে দিতে হয়। টাকা না দিলে সে কাজ বন্ধ থাকে। তাদের কারণে ভবন হওয়ার পরও দীর্ঘদিন ভবনে লিফট চালু করা সম্ভব হয়নি। যেকোন উন্নয়নমূলক কাজ করতে গেলে চাঁদা দিয়ে করতে হয়।
কলেজ ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মনিরুল ইসলাম বলেন, ক্যাম্পাসের প্রতিটি উন্নয়নমূলক কাজ করতে গেলে তাদের চাঁদা দিতে হয়েছে। এদের ভয়ে অনেকে কথা বলে না। ভাগ ভাটোয়ারায় ঠিকঠাক না হলে সংঘর্ষে জড়ায়। ক্যাম্পাসে চাঁদাবাজির সংস্কৃতি তৈরি করেছে। কলেজ ক্যাম্পাস শিবিরের আমল থেকে বেশি খারাপ হয়ে গেছে। সংগঠনের সিনিয়র নেতৃবৃন্দকে মৌখিকভাবে বিষয়গুলো জানানো হয়েছে। কখনো লিখিত অভিযোগ দিই নাই। আমরা দুই চাঁদাবাজের নেতৃত্বে হওয়া ছাত্রলীগের কমিটি ভেঙে নতুন কমিটি গঠনের দাবি জানাচ্ছি।
চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মোহাম্মাদ মোজাহেদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, নেতৃত্বে জাহির করতে গিয়ে বারবার মারামারিতে জড়ায়। সবাইকে ডেকে বলেছি কলেজে যাতে কোন গন্ডগোল না করে। ক্লাস পরীক্ষা পুরোদমে চলতেছে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার বিষয়টি সম্পর্কে আমরা শুনেছি। হুট করে বন্ধ করে দিলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আমাদেরও অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। যেকোনো বিষয়ে আমরা প্রজ্ঞা এবং ধৈর্য্যরে সাথে মোকাবেলা করি।