ওয়াজ মাহফিলের নামে পরশ্রীকাতরতা বন্ধ হোক

13

নেছার আহমেদ খান

ফেসবুকে মধ্যরাত পর্যন্ত তরুণ প্রজন্মের ছেলেরা জনপ্রিয় সেলিব্রিটি হুজুরদের প্রতিপক্ষকে গালিগালাজ, পরনিন্দা ও নানারকম উত্তেজকপূর্ণ বক্তব্যের ভিডিও দেখে ধর্মীয় জ্ঞান চর্চায় বিভ্রান্ত হচ্ছে। ইসলামি জ্ঞানের মূল উৎস হুলো কোরআন এবং হাদিস। কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত গীবতের যে অর্থ আমরা পাই, তার বাংলা ভাবার্থ হলো, কোনো লোকের অনুপস্থিতিতে তার দোষের কথা প্রকাশ করা, তার বদনাম ও তার নিন্দা করা, সমালোচনার মাধ্যমে তার সুনাম খর্ব করা, লোকসমাজে তাকে হেয় প্রতিপন্ন করা ইত্যাদি।
হযরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা কি জান, গীবত কি? সাহাবাগণ বললেন, ‘আল্লাহ ও তার রাসূল ভালো জানেন।’ তিনি বললেন, ‘গীবত হচ্ছে এই যে, তুমি নিজের ভ্রাতার কথা এমনভাবে উল্লেখ করো যে, যা সে পছন্দ করে না।’ অতঃপর তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘বলুন, আমি যে কথাটি বলছি তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে থেকে থাকে?’ তিনি বললেন, ‘এটাই তো গীবত, যা তুমি বলছো। তার মধ্যে তা থাকলেই গীবত। আর যদি যে কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে তা না থাকে তা হলে তুমি তার ওপর অপবাদ (বোহতান) আরোপ করেছ।’ গীবত ও বোহতান সম্পর্কে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার বর্ণিত ব্যাখ্যার পর আর কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় না।
কোরআনের সূরা ‘হুমাযাহ’ এর প্রথম আয়াতেই আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘দুর্ভোগ প্রত্যেকের যে পশ্চাতে ও সম্মুখে লোকের নিন্দা করে।’
আল্লাহ বলেন, ‘হে মোমেনগণ! তোমরা অধিকাংশ অনুমান হতে দূরে থাকো, কারণ অনুমান কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাপ এবং তোমরা একে অপরের গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না এবং একে অপরের পশ্চাতে নিন্দা করো না। তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভ্রাতার গোশত খেতে চাইবে। বস্তুত: তোমরা তো এটাকে ঘৃণ্যই মনে করো। তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। আল্লাহ তাওবা গ্রহণকারী পরম দয়ালু।’ (সূরা হুজুরাত, আয়াত-১২)। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, ‘দুই ব্যক্তি জোহর অথবা আছরের নামাজ আদায় করে এবং তারা দুই জনই রোজা রেখেছিল। রাসূলুল্লাহ (সা.) নামাজ শেষ করার পর তাদেরকে বললেন, ‘তোমরা পুনরায় অজু করো এবং আবার নামাজ পড়ো এবং রোজা পূরণ করো। তবে তা অপর কোনো সময় কাজা হিসেবে আদায় করবে।’ তারা উভয়ই বলল, ‘হুজুর! এর কারণ কি?’
তিনি বললেন, ‘তোমরা অমুক ব্যক্তির গীবত করেছিলে।’ অপর এক বর্ণনায় আছে, মানুষ তওবা করলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু গীবতকারীকে ক্ষমা করেন না, যতক্ষণ না যার গীবত করা হয়েছে সে ক্ষমা করে দেবে। এই হলো, পরনিন্দাকারীদের সম্বন্ধে কোরআন হাদিসের আলোকে বর্ণনা ও পরিণতি। কিন্তু আমরা দেখতে পাই, আমাদের দেশের অধিকাংশ ওয়াজমাহফিলে বেশ কিছু আলেম অনর্গল মত ও আদর্শ বিরোধী লোজদের সম্বন্ধে পরনিন্দা তথা গীবত করে থাকেন। ইদানিং কিছু অর্ধেক আধুনিক আর অর্ধেক ননআধুনিক হুজুরকে দেখা যায় তাঁরা নেচে কুদে ভেংচি কেটে অন্যদের খাটো করে ওয়াজ করে থাকেন। ইউটিউবে এরকম কিছু ওয়াজ দেখা যায়। এঁরা আবার খুব জনপ্রিয়।
মহান আল্লাহ বলেন, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের পথে মানুষকে আহ্বান করো হেকমত ও প্রজ্ঞার সঙ্গে এবং সর্বোত্তম উপদেশাবলির মাধ্যমে, আর কখনও বিতর্কে লিপ্ত হলেও অশ্লীল বাক্যালাপ পরিহার করে চলবে (১৬:১২৫)। সুতরাং ইসলামের দাওয়াত দিতে হয় মধুরভাবে। মানুষের মনে কষ্ট দিয়ে মানুষকে পরিবর্তন করা যায়না, বরং মানুষকে আরো বিপদগামী হতে সাহায্য করা হয়।
সুতরাং আমাদের ওয়াজগুলো হোক উত্তম এবং অনুকরণীয়। ওয়াজকারীগণ হবেন অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। মানুষ তাঁদের জোকার হিসেবে নিতে পারবেনা, এই কথাটি ওয়ায়েজদের স্মরণে রাখতে হবে। জনপ্রিয়তার মোহ আমাদের যেন গাফেল করে না ফেলে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য, আমরা মূলত মিলাদ মাহফিলে পক্ষে, গীবতের বিপক্ষে। ইদানীং নবীজির নবুয়াত প্রকাশ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করছে আহলে হাদিস নামের কিছু মাওলানা। যা নিন্দনীয়। মুসলমানদের ঈমান ওই নবীর উপর যিনি নবী হয়ে দুনিয়াতে আগমন করেছেন। মহান আল্লাহ আমাদের বিভ্রান্ত ও ভন্ডামী থেকে হেফাজত করুন।
লেখক: সমাজকর্মী লেখক ও কলামিস্ট