এখনও উপেক্ষিত শ্রমিকদের অধিকার ও মর্যাদা

5

এম. নুরুল হুদা চৌধুরী

মে দিবস দিন পঞ্জিকায় এটি একটি নিছক দিবস মাত্র নয়। বিশ্বের শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের ঐক্য, সংহতি, সংগ্রাম এবং বিজয়ের মধ্য দিয়ে ইতিহাস রচিত হয়েছিল এই দিনে। অতিমাত্রায় মুনাফালোভী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অমানবিক নির্যাতনের শিকার শ্রমজীবী মানুষের সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে অব্যাহত সংগ্রামের দৃষ্টান্ত হচ্ছে এই মহান মে দিবস। শোষণ, বৈষম্য ও জুলুমের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ শ্রমিকের ঐতিহাসিক বিজয়ের দৃষ্টান্ত মে দিবস। যুগে যুগে সারা বিশ্বে শ্রমজীবী মানুষকে অনন্য প্রেরণা যুগিয়েছে মে দিবস। প্রত্যেকটি শ্রমিককে তাদের শ্রম এবং ঘামের সম্পূর্ণ সম্মান যেন দিতে পারি সেই চেষ্টাই আমাদের করতে হবে। আত্মত্যাগ ও বলিদানকে স্মরণীয় রাখার জন্যই এই মে দিবস। নবী করিম (স.) এর অমীয় বাণী- শ্রমিকের ঘাম শুকানোর পূর্বে তার মজুরি দিয়ে দাও।
১৮০০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল নবজাগরণের জয় জয়কার। চারিদিকে গড়ে উঠেছে নতুন নতুন শিল্প। কিন্তু সে হিসেবে শিল্প কারখানায় শ্রমিকদের বেতন ছিল খুবই কম এবং কর্মঘন্টা ছিল প্রায় ২০ ঘন্টা। ১৮০৬ সালে শ্রমিকরা অমানবিক নিপীড়ন ও শোষণের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে। প্রথমে তারা মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে প্রতিবাদ করে। পাশাপাশি তাদের ছিল কর্মঘন্টা কমিয়ে আনা। অর্থ্যাৎ ২০ ঘন্টার পরিবর্তে তারা চেয়েছিল ১০ ঘন্টা শ্রম দিতে। ১৮২০ সাল থেকে ১৮৪০ সাল পর্যন্ত শ্রমিকদের অসংখ্য ধর্মঘট ও প্রতিবাদ অনুষ্ঠিত হয়। ১৮২৭ সালে দৈনিক ১০ ঘন্টা কাজ করার নিয়ম চালু করার জন্য মেকানিকরা গঠন করে ট্রেড ইউনিয়ন। এটি ছিল বিশ্বের প্রথম ট্রেড ইউনিয়ন। ১৮৬৬ সালে এভাবে গঠিত ৭টি ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিনিধিরা একযোগে মিলিত হয় তৈরি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়ন। সেখানে তাদের প্রাথমিক চাহিদা ছিল ৮ ঘন্টা কাজের প্রস্তাব। এ বছর জেনেভা কনভেনশনেও প্রস্তাবটি গৃহিত হয়। ১৮৮৪ সালে ৮ ঘন্টা কাজ করার দাবিতে আন্দোলনের গতি তীব্রতা পায়। ১৮৮৬ সালে তৈরি হয় আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার ইউনিয়ন। এ সংগঠনটি সে বছর পহেলা মে তারিখ থেকে ৮ ঘন্টা কাজের দাবিতে সকল শ্রমিকদের ধর্মঘট করার জন্য বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
সকল মেহনতি জনগণ শোষণহীন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কোন বিকল্প নেই। ১লা মে মহান আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসে আমাদের সকল প্রকার শ্রেণি বৈষম্যের ব্যবস্থা ধ্বংস করে শোষণহীন সমাজ গড়ার লক্ষ্যে সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ বিরোধী শ্রমিক-কৃষকের গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসতে হবে। আন্ত:সাম্রাজ্যবাদীর তীব্র দ্ব›েদ্বর অনিবার্য পরিণতি সম্ভাব্য বিশ্বযুদ্ধের বিরুদ্ধে বিশ্বের সকল শ্রমিক শ্রেণি ও নিপীড়িত জাতি ও জনগণের যুদ্ধ বিরোধী সকল শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী ব্যবস্থা উচ্ছেদ করে চিরস্থায়ী বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়া জরুরি। মহান মে দিবস হচ্ছে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। এই দিনটিতে শ্রমিকের বুকের তাজা রক্ত ও প্রাণ বিসর্জনের মাধ্যমে শ্রম দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙ্গে মুক্তির লাল সূর্য্য ছিনিয়ে আনার শপথের দিন। ১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে ৮ ঘন্টা কাজ, ৮ ঘন্টা বিশ্রাম ও ৮ ঘন্টা বিনোদনের দাবিতে সংগ্রামরত ৫ লক্ষেরও অধিক শ্রমিকদের (বামপন্থীদের নেতৃত্বে জোর ছিল বেশি) উপর আমেরিকার বুর্জোয়া শাসকগোষ্ঠি নির্বিচারে বর্বরোচিত গুলি বর্ষণ ও হামলায় প্রথমে ৬ জন শ্রমিক নিহত হন ও আহত হন অনেকেই। শ্রমিক নেতাদের মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করে প্রহসনমূলক বিচারের মাধ্যমে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা এবং কয়েকজন নেতাকে যাবতজীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়। কিন্তু এতো কিছুর পরও শ্রমিকরা তাদের আন্দোলনকে আরো বেশি তীব্রতর করে তুলে। এই আন্দোলন শুধু আমেরিকাতেই সীমাবদ্ধ থাকে না ইউরোপসহ পুঁজিবাদী বিশ্বে তথা বিশ্ব আন্দোলনে রূপ নেয়। আন্দোলনের তীব্রতায় পুঁজিপতি শ্রেণি ও তাদের সেবাদাস রাষ্ট্র শ্রমিকদের দাবি মেনে নিয়ে আইন প্রণয়ন করতে বাধ্য হয়। যার ফলশ্রুতিতে দীর্ঘ ৩ বছর পর ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই ফ্রান্সের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে পহেলা মে-কে বিশেষ দিন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সেই থেকে পহেলা মে পৃথিবীর সব দেশে ‘মে দিবস’ ‘শ্রমিক দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। ১৮৯০ সালে বিশ্বে একযোগে মে দিবস পালন করা হয়। ৮ ঘন্টা কাজ, ৮ ঘন্টা বিশ্রাম, ৮ ঘন্টা বিনোদন আজ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত শ্রম অধিকার। ১মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে শ্রমিক শ্রেণির মহান শিক্ষক মহামতি এঙ্গেল্স বলেন “শুধু ৮ ঘন্টা শ্রম দিবসের জন্য মে দিবসের সমাবেশ নয়, তাকে অবশ্যই সমাজটাকে পরিবর্তনের মাধ্যমে শ্রেণি বৈষম্য ধ্বংস করে শ্রমিক শ্রেণির দৃঢ় সংকল্প গ্রহণের সমাবেশে পরিণত করতে হবে।
আমরা যখন মে দিবস পালন করতে যাচ্ছি, সে সময় সমগ্র পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থা গভীর সামগ্রিক সংকটে জর্জরিত। ২০০৮ সালে সৃষ্ট মন্দা থেকে উত্তরণ ঘটানোর সকল প্রয়াস ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। অ-সমাধান যোগ্য মন্দা ও সামগ্রিক সংকট তাদেরকে নিপতিত করেছে চরম অস্থিরতা ও নৈরাশ্যে। পুঁজিবাদের অসম বিকাশের নিয়মে শক্তির অনুপাত পরিবর্তিত হওয়ায় বাজার ও প্রভাব বলয় নিয়ে ক্রমবর্ধমান আন্ত:সাম্রাজ্যবাদী দ্ব›দ্ব মুখোমুখী অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। একদিকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ ও জাপানসহ অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদ। প্রতিপক্ষ হিসাবে সামনে দাঁড়াচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী চীন ও রাশিয়া। প্রযুক্তি, লগ্নী পুঁজি ও পণ্যের বাজার এবং বাণিজ্যের ভরকেন্দ্র এসে দাঁড়িয়েছে ইন্দো-প্যাসিফিকসহ তৎসংলগ্ন অঞ্চলসমূহে। এ প্রেক্ষিতে কেন্দ্রিভূত হচ্ছে মার্কিন নেতৃত্বে ন্যাটো এবং অকাস, কোয়াড, আইপিএসসহ মার্কিনের সাথে দ্বিপাক্ষিক, বহুপাক্ষিক সংস্থা গড়ে তোলার প্রক্রিয়া। বিপরীতে সাম্রাজ্যবাদী চীন ও রাশিয়ার নেতৃত্বে এসসিও, সিসটো, র‌্যাটস, ব্রিকস, বিআরআইসহ সামরিক, অর্থনৈতিক সংস্থাসহ দ্বিপাক্ষিক-বহুপাক্ষিক সংস্থা সমূহ। এভাবেই এই দুই প্রতিপক্ষ স্ব-স্ব বলয়ে ভূ-রণনীতি ও রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলকে কেন্দ্রিভূত করতে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে চলেছে। এরই প্রতিফলনে স্থানীয় ও আঞ্চলিক যুদ্ধ ক্রম স¤প্রসারিত হয়ে পারমাণবিক যুদ্ধের বিপদ ও বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনাকে বৃদ্ধি করছে। যার প্রতিক্রিয়া হিসেবে সামনে এসেছে ইউক্রেন যুদ্ধ। চীন-তাইওয়ান প্রণালী নিয়ে দ্ব›দ্ব, ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরাইলের বর্বর ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যা, ইসরাইল-ইরানের হামলা, পাল্টা হামলার পরিস্থিতি ৩য় বিশ্বযুদ্ধের অনিবার্যতাকে সামনে নিয়ে আসছে। আর এই পরিস্থিতি সামাল দিতে তাদের অর্থনীতি ক্রমান্বয়ে ডুবতে চলেছে সংকটের অতল গহŸরে। এর থেকে রেহাই পাওয়ার কোন বাস্তবতা তাদের হাতে নাই। বাণিজ্যযুদ্ধ, মুদ্রাযুদ্ধ, বাণিজ্য অবরোধ, স্যাংশান ইত্যাদি নিয়তই তাদের জড়িয়ে ফেলছে নতুন নতুন সংকটের ঘূর্ণাবর্তে। এর ফলে ক্রমাগত নতুন নতুন আকীর্ণ যুদ্ধজনিত পরিস্থিতি ২য় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে গড়ে উঠা গোটা বুর্জোয়া ব্যবস্থাকে ঠেলে দিচ্ছে ভাঙ্গনের দিকে। এতে সৃষ্টি হচ্ছে অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা। যা নৈরাজ্যিক পরিস্থিতিকে সর্বব্যাপী করে তুলছে। ভেঙ্গে পড়ছে বিশ্ববাণিজ্যের সাপ্লাই চেইন। ডলার কেন্দ্রিক বাণিজ্য বিনিময় থেকে বিকল্প মুদ্রা ও দ্বিপাক্ষিক মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থা স¤প্রসারিত হয়ে ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে ডলারের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা। আর এই পরিস্থিতিই বিশ্বযুদ্ধের অনিবার্যতাকে সামনে আনছে। ফলে সাম্রাজ্যবাদ ও স্ব-স্ব বলয়ভুক্ত দেশসমূহে প্রতিরক্ষা ব্যয়ে উল্লম্ফন ঘটছে ক্রমাগত। সকলেই সুসজ্জিত হচ্ছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন যুদ্ধাস্ত্র ও পারমানবিক প্রযুক্তির যুদ্ধাস্ত্র দ্বারা। আর এর প্রতিফলন পড়ছে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে। পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী দেশে উগ্রজাতীয়তাবাদ ও বর্ণবাদকে উস্কে দিয়ে জোরদার করে চলেছে ফ্যাসিবাদ। আর অন্যদিকে এদের বলয়ভুক্ত নয়া ঔপনিবেশিক আধাসামন্তবাদী রাষ্ট্রসমূহে উগ্রজাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাকে হাতিয়ার করে কেন্দ্রিভূত করছে স্বৈরচারী ব্যবস্থা। অপরদিকে ধনবাদী দেশ সমূহে শ্রমিক শ্রেণি এবং নিপীড়িত রাষ্ট্রগুলোর জাতি ও জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের সকল সংকটের বোঝা, বাড়ছে শোষণ-লুন্ঠন। মূল্যস্ফীতি, মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, চাকরিচ্যুতি, ক্ষুধা, দারিদ্র ও নিপীড়নকে সর্বব্যাপী করে তোলা হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে বিশ্বের শোষিত শ্রমিক শ্রেণি ও নিপীড়িত জাতি ও জনগণ প্রতিনিয়ত স্বত:স্ফুর্ত আন্দোলন, ধর্মঘট, প্রতিবাদ ও বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে। এমনই এক পরিস্থিতিতে এবারের মহান মে দিবস এক নতুন তাৎপর্য নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে।
মহান ১লা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বাংলাদেশের শ্রমিক কৃষকসহ সর্বস্তরের মেহনতি জনগণের জন্যও এক তাৎপার্য নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। বাংলাদেশ হল একটি নয়াঔপনিবেশিক আধাসামন্তবাদী রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্র ব্যবস্থা হলো সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ, আমলা, দালাল পুঁজি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সুতরাং এই রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যে সরকার ক্ষমতায় আসে তাদের দায়িত্ব হলো সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনায় সাম্রাজ্যবাদ ও তার এ দেশীয় দালাল সামন্ত আমলা মুৎসুদ্দি পুঁজির স্বার্থ বাস্তবায়ন করা। বাংলাদেশে নিষ্ঠার সাথে এই তিন শোষণ শাসনের স্বার্থের সেবা করে চলেছে। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার সামগ্রিক অর্থনৈতিক সংকট ও ভূ-রাজনীতিতে যে আন্ত:সাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্ব চলছে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে তার প্রতিফলন পড়ছে তীব্রভাবে। ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় মার্কিনসহ তাদের মিত্ররা এবং প্রতিপক্ষ সাম্রাজ্যবাদ চীন-রাশিয়া উভয়েই স্ব-স্ব স্বার্থে তারা তাদের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসী যুদ্ধে বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত করতে গভীর ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তে লিপ্ত। বাংলাদেশের সাম্রাজ্যবাদ ও দালালদের বেপরোয়া শোষণ লুন্ঠন জোরদার করে জনজীবনকে করে তুলছে দুর্বিষহ। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দ্রæত বাড়ছে। ফলে শ্রমিক তার প্রকৃত মজুরি থেকে বঞ্চিত, কৃষক পায় না কৃষি পণ্যের ন্যায্য মূল্য। অন্যান্য শ্রেণি পেশার মানুষ আয় আর ব্যয়ের ভারসাম্যহীনতায় জীবন নির্বাহে বিপর্যস্ত। তার উপর প্রতিনিয়ত যোগ হচ্ছে অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতি, মুদ্রাস্ফীতি, বিদ্যুৎ, গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধিতে প্রতিটি শ্রেণি পেশার জনগণকে নাকাল হতে হচ্ছে। অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে শাসন ব্যবস্থায় জোরদার করেছে দূরভিত্তায়ন কুশাসন। আইন, বিচার ব্যবস্থা, প্রশাসন, ব্যাংক-বীমা, শিল্পক্ষেত্র, শিক্ষাঙ্গন, প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রিক মিডিয়াসহ সর্বত্র নিরুঙ্কুশ অবৈধ প্রভাব করে জগদ্দল পাথরের মত চেপে যাচ্ছে জন-জীবনে। লক্ষ্য হলো শ্রমিক কৃষকসহ সর্বস্তরের জনগণ যেন তাদের অধিকার রক্ষার আন্দোলন সংগ্রামে নামতে না পারে। এজন্য কিছু স্বার্থন্বেষী মহল নানা কলকানুন করে শ্রমিকের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার, ন্যায্য মজুরি পাওয়ার অধিকারসহ সকল স্তরের জনগণের প্রতিবাদের কন্ঠকে চেপে ধরে রাখতে চাইছে। অন্যদিকে বেপরোয়া দুর্নীতি ও লুটপাট করে জাতীয় অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা বৈদেশিক ও দেশীয় ঋণের ভারে এবং নোট ছাপিয়ে জাতিকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে ফেলছে। কলকারখানা বন্ধ হচ্ছে, চাকরিচ্যুতি হচ্ছে, নতুন নতুন কর্মসংস্থান না হওয়ায় ক্রমাগত বাড়ছে বেকারত্ব। ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করে চলেছে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য। গ্রাম ও শহরে প্রভাব প্রতিপত্তির ছত্রছায়ায় এক শ্রেণি মানুষ দ্রুত আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে টাকা রাখার স্তান সংকুলান হচ্ছে না। অন্যদিকে খুন, ধর্ষণ, নিপীড়ন, নির্যাতন রূপ নিয়েছে স্বাভাবিক ঘটনায়। হাতে গোনা কিছু শ্রমক্ষেত্র আছে যেমন নির্মাণ, স’মিল, দোকানসহ ক্ষুদ্র কর্মক্ষেত্রে যে সকল কর্মচারী কর্মরত প্রত্যেকের অবস্থা দুর্বিষহ। বাজারদর অনুযায়ী মজুরি পায় না। নামমাত্র মজুরিতে কাজ করতে হয়। শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি নির্ধারণের কোনো নীতিমালা না থাকায় তারাও নিষ্পেষিত হচ্ছে। প্রবাসীদের অধিকাংশই হলো নিম্নজীবি ও দরিদ্র পরিবার থেকে বিদেশগামী। তারা রেমিট্যান্স পাঠিয়ে গোটা জাতির জন্য অনন্য অবদান রাখলেও যারা ব্যক্তিগতভাবে গৃহ নির্মাণ করছে তাদেরকে ভর্তুকীমূল্যে নির্মাণ সামগ্রীর জোগানে সরকারের কোন নীতিমালা নাই। তার উপর প্রতিনিয়ত নির্মাণ সামগ্রীর লাগামহীন মূল্য বৃদ্ধিতে এই সেক্টরের সংকটকে আরো গভীর করেছে। একইভাবে স’মিলসহ ক্ষুদ্র কর্মক্ষেত্রগুলোরও একই অবস্থা। এতে সবচেয়ে নিষ্পেষিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হল এসব ক্ষেত্রে যারা শ্রম দিয়ে থাকেন। এদের সংগঠিত হওয়াও সহজ নীতিমালা নাই। সুতরাং এ সকল সমস্যা হলো জাতীয় সমস্যার অধীন। সারাদেশের শ্রমিক-কৃষকসহ পেশাজীবি ও মেহনতি জনগণের মুক্তি অর্জনের পথ খুঁজে নিতে হবে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরে ১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পহেলা মে-কে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস হিসেবে রাষ্ট্রের অন্যতম দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ইতিপূর্বে এ দিবসে রাষ্ট্রীয় কোন ছুটি ছিল না। বঙ্গবন্ধুই এ দিবসটিতে ছুটির প্রথা চালু করেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা শ্রমিক বান্ধব সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে শ্রমিক-মালিক গড়বো দেশ, স্মার্ট হবে বাংলাদেশ – এই শ্লোগানকে ধারণ করে এবার বাংলাদেশে ১৩৮তম আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালিত হতে যাচ্ছে। মে দিবস দিচ্ছে ডাক- জাগরে শ্রমিক, জাগরে জাগ।
দুনিয়ার মজদুর এক হও, বাংলার মেহনতি মানুষ এক হও।

লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা,
সভাপতি, বাংলাদেশ নৌ-যান শ্রমিক ও কর্মচারী ইউনিয়ন চট্টগ্রাম জেলা শাখা,
সভাপতি, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও সাহিত্য চর্চা পরিষদ