একজন গোলাম রহমান চৌধুরী’র ক্ষণ বিদায়

8

লিটন দাশ গুপ্ত

তিনি মীরসরাই উপজেলা থেকে এলেন, বোয়ালখালী উপজেলায় বছর খানেক ছিলেন, অতঃপর মানুষের মন জয় করে সীতাকুন্ড উপজেলায় বদলী হয়ে চলে গেলেন। বলছিলাম একজন সৎ তরুণ মানবিক দক্ষ অভিজ্ঞ শিক্ষা কর্মকর্তার কথা, যাঁর নাম গোলাম রহমান চৌধুরী। আমি সাধারণত কোন স্বাভাবিক ব্যক্তিকে নিয়ে কিছু লিখি না। অনেকে অনুরোধ করে তাঁদেরকে নিয়ে কিছু লেখার জন্যে, কিন্তু ভিতর থেকে লেখা আসেনা বলে লিখতে পারিনা। কিন্তু আরিফ স্যারের এমন কিছু অসাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা অনেকের কাছে অনুকরণীয় ও অনুসরনীয় হতে পারে। তাই আজকে তাঁকে নিয়ে না লিখে পারলাম না। এখানে ‘আরিফ’ স্যার মানে ‘গোলাম রহমান চৌধুরী’ মহোদয়ের কথা বলছি, যাঁর ডাক নাম আরিফ।
এখানে আরো উল্লেখ না করলে নয়, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, অধিনস্ত কোন কর্মকর্তা কর্মচারী একইসাথে কর্মরত থাকা অবস্থায় কর্তৃপক্ষের সুনাম গুণগান করে থাকে। যতটা নয় তার চেয়ে বেশি কিছু বাড়িয়ে বলে নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্যে। যেটাকে অনেকে ‘তেল’ দেয়া বলে থাকে! বলতে গেলে অনেকটা চাওয়া পাওয়া থেকে মিথ্যাকে সত্য বানিয়ে কালোকে সাদা বলে কিছু আদায়ের জন্যে। গোলাম রহমান চৌধুরী সাহেব অন্যত্র বদলী হয়ে গেছেন। তাই এখানে আমার কোন প্রকার চাওয়া পাওয়া থাকার কথা নয়। কেবল সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলার অভ্যাস থেকে নিঃস্বার্থে ভালো মানুষকে নিয়ে কিছু বলা।
গোলাম রহমান চৌধুরী স্যার একজন সৎ আন্তরিক নিষ্ঠাবান ব্যক্তি। তাঁর আদর্শিক ব্যক্তিত্ব, সাংগঠনিক নেতৃত্ব, প্রশাসনিক কর্তৃত্ব চিন্তাশীল ব্যবস্থাপনায়, আর শিক্ষক ও শিক্ষার প্রতি অনুরাগ থাকার কারণে তাঁর উপজেলাধীন শিক্ষার মানোন্নয়ন স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাধ্য। বিস্ময়ের বিষয় হলো, যেখানে প্রজাতন্ত্রের অনেক চাকুরীজীবীর বিরুদ্ধে ঘুষ দুর্নীতি স্বজনপ্রীতির কথা শোনা যায়; বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেকে ভয়ে ভিতু হয়ে আছেন; সেখানে গোলাম রহমান চৌধুরী মুক্ত আকাশে স্বাধীন বিহঙ্গের মত উড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন নিজ কার্যালয়ে, স্কুল থেকে স্কুলে। আমরা গণমাধ্যমে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাধারণত দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মচারীর নাম, সম্পদ অর্জনের কথা প্রকাশ ও প্রচার হতে দেখি। কিন্তু যাঁরা সততার ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করে জনগণকে নিঃস্বার্থ সেবা দিয়ে যাচ্ছেন, তাদের কথা প্রকাশিত বা প্রচারিত হতে দেখিনা বা কম প্রচার হতে দেখি। এমনই প্রচার বিমুখ বোয়ালখালীর নিঃস্বার্থ এক ক্ষণ বিদায়ী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা গোলাম রহমান চৌধুরী আরিফ।
আরিফ স্যার নিয়মিত বিদ্যালয় পরিদর্শনে যেতেন; তবে খালি হাতে নয়। তিনি নিয়ে যেতেন বিভিন্ন মূল্যবান পুরস্কার ও উপহারসামগ্রী। অনেকক্ষেত্রে বিদ্যালয় পরিদর্শনের সময় দেখা যায়, পরিদর্শক মহোদয় প্রধানশিক্ষক বা প্রতিষ্ঠান প্রধানের চেয়ারে বসে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় রেজিস্টার ও কাগজপত্রের সাথে অপেক্ষাকৃত কম প্রয়োজনীয় বা অপ্রয়োজনীয় কাগজপত্র অদৃশ্য কারণে দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সেখানে আরিফ স্যারের ভিন্ন পরিদর্শন অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তিনি পরিদর্শনে সরাসরি শ্রেণিকক্ষে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সাথে আন্তরিক কথাবার্তা বলে মিশে যেতেন, আপন করে নিতেন। তারপর ধীরে ধীরে প্রশ্নোত্তর পদ্ধতিতে পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে মূল্যায়ন প্রক্রিয়া শুরু করতেন। অবস্থা বুঝে একেবারে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অভীজ্ঞ শিক্ষকের মত পদ্ধতিগতভাবে শিক্ষাদান প্রক্রিয়া শুরু করে দিতেন। আর শিক্ষার্থীর মূল্যায়নে ১ম, ২য়, ৩য় হওয়া শিক্ষার্থীকে তাঁর নিজ টাকায় কেনা, সাথে নিয়ে যাওয়া সেই উপহার বা পুরস্কার সামগ্রী করতালির মাধ্যমে বিতরণ করে উৎসাহ দিতেন। পরিদর্শনে সাধারণত কচিকাঁচা শিশু অপরিচিত ব্যক্তি দেখে ভয়ে উত্তর দিতে চায় না, কিন্তু আরিফ স্যারের পরিদর্শনে দেখা যায় খুশিতে উচ্ছ¡াস হয়ে শিশুরা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সক্রিয় থাকে। যাবার সময় শিশুরা হ্যান্ডশেক করে, সালাম প্রণাম করে শ্রদ্ধা জানায়, আবার আসতে বলে। এই যেন এক অন্য জগতের শিক্ষাব্যবস্থায় ভিন্ন রকমের পরিদর্শন! শুধু শিক্ষার্থীদের নয়, বিভিন্নপর্যায়ে তাঁর চিন্তাপ্রসূত শিক্ষকদের নিয়ে গঠিত ক্রীড়া, সংস্কৃতি, ইউনিয়ন প্রতিনিধি কিংবা উন্নয়নমূলক দল গঠন করে, তাদেরকে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে স্বীকৃতি স্বরূপ পুরস্কৃত করতেন। অগ্রগামী শিক্ষকদেরকে উৎসাহিত করার জন্যে তিনি নিজ উদোগে নিজ খরচে ফুলফল কিনে, কেক কেটে জন্মদিন পালন করতেন, কখনো অফিসে এনে সারপ্রাইজ হিসাবে, কখনো বিদ্যালয়ে পরিদর্শনে গিয়ে।
কিছু পরিদর্শক যখন ‘পুলিশ’ হয়ে শিক্ষকদেরকে ‘চোর’ হিসাবে দেরীতে আগমন প্রস্থান ধরার জন্যে বা দেখার জন্যে নিজেকে অন্তরালে নিরবে কোথাও দাঁড়িয়ে থাকেন, তখন আরিফ স্যারের কৌশলগত যাদুকরী কথার বাণে শিক্ষক প্রেষিত হয়ে নিজ দায়িত্বে যথাসময়ে বিদ্যালয়ে আসা যাওয়া করতেন। তিনি অর্šÍদৃষ্টি দিয়ে শিক্ষকদের অন্তভাব বুঝতে পারতেন। যেমন- প্রতিমাসের ১১ তারিখ সমন্বয় সভা হবার কথা। অনেক সময় অনিবার্য কারণে যথাসময়ে অনুষ্ঠিত করা সম্ভব হয়না। এদিকে নিয়ম অনুযায়ী ১১ তারিখের আগে বা পরে সমন্বয় সভা করতে হলে নির্দিষ্ট সময়ে শিক্ষকদের অবহিত করতে হয়। কিন্তু অনেক সময় দেখা, রাতে সংশ্লিষ্টদের গ্রæপে নোটিশ একটা দিয়ে দিল, আগামীকাল সকাল ১০ টায় সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত হবে। অবশেষে শিক্ষকগণ বাধ্য হয়ে সুবোধ বালকের মত চলে আসে। কারণ কর্তায় ইচ্ছায় কর্ম! এই অবস্থায় পরের দিন বিদ্যালয়ে প্রধানশিক্ষকের সভা বা বিভিন্ন কাজের পরিকল্পনা স্থগিত বা বাতিল করতে হয়। এই বাতিল বা স্থগিত হবার কারণে প্রতিষ্ঠান প্রধানকে এলাকায় নানামুখী সমস্যায় পড়তে হয় এমনকি জবাবদিহি করতে হয়। শুধু সমস্বয় সভা নয়, এই রকম অনেক তথ্য অনেক কিছু আছে ২০/৩০ মিনিটের মধ্যে অফিসে পৌঁছাতে হবে। কিন্তু আরিফ স্যার বিষয়গুলো চিন্তা করতেন। তাই যোগ্য শিক্ষকদের সাথে পরামর্শক্রমে সিদ্ধান্ত নিয়ে সকল শিক্ষককে অবহিত করার দায়িত্ব দিতেন। আবার অফিসে উদ্দেশ্যসত্ত¡া নিয়ে ‘ভবঘুরে’ তথাকথিত যোগ্য শিক্ষকদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতেন। আর প্রত্যেকটা বিষয় বিবেচনা ও যাচাই বাছাই করে শিক্ষার কল্যাণে তাৎক্ষণিক সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে বা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারতেন। কথায় আছে ‘বস ইচ অলওয়েজ রাইট’। মানে বস-এ যদি বলে সূর্য পশ্চিম দিকে উঠে, অধঃস্তন কর্মচারী ইয়েস স্যার, জ্বী হুজুর; আপনি সঠিক বলেছেন; এভাবে বলার রীতি দীর্ঘদিন যাবৎ চলে আসছে। কিন্তু শিক্ষক দুঃখ পেয়ে শিক্ষা কর্মকর্তাকে খুশি করানো আরিফ স্যার মোটেই পছন্দ করতেন না। শিক্ষক খুশি হলে তিনি খুশি হতেন। তাই নিজেই কোন বিষয়ের সারসংক্ষেপ অনুধাবন করে, সংখ্যাগরিষ্ট শিক্ষকদের মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। এই জন্যেই তাঁকে শিক্ষকবান্ধব শিক্ষা কর্মকর্তা বলা হয়ে থাকে। চাকুরী জীবনে এমনও অনেক জনকে দেখেছি, যারা অন্যকে মেরে নিজে বেঁচে থাকার প্রবণতা, কিন্তু গোলাম রহমান স্যার প্রয়োজনে নিজে মরে অন্যকে বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টা, যা সচরাচর দেখা যায়না। এই জন্যেই বদলী হয়ে চলে যাবার পরেও তিনি শিক্ষকসহ সর্বস্তরের মানুষের মনের মণিকোঠায় স্থান পেয়েছেন।
গোলাম রহমান চৌধুরী মহোদয় ফেনী জেলার ফুলগাজী উপজেলার হাসানপুর গ্রামে এক ঐতিহ্যবাহী চৌধুরী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। সম্ভবত তাই, কথাবার্তায় আচার আচরণে চলা ফেরায় ‘চৌধুরী’ বংশের ঐতিহ্য পরিলক্ষিত হয়। হাসানপুর গ্রামে তাঁদের পুকুর দিঘী বৃক্ষরাজিসমৃদ্ধ ও ফুলেফলে ভরা তাঁদের প্রকান্ড বাড়ি। বাড়ি থেকে আসার সময় শিক্ষকদের জন্যে নিয়ে আসতেন অনেক কিছু। তাঁর শিক্ষার প্রতি এহেন উদারতা ও আন্তরিকতার স্বীকৃতিস্বরূপ ইতিমধ্যে দুই বার বিভাগীয় শ্রেষ্ঠ শিক্ষা অফিসার নির্বাচিত হয়েছেন। আগামীতে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষা কর্মকর্তা হিসাবে দেখতে চায় সংশ্লিষ্ট অনেক ব্যক্তি শিক্ষক অভিভাবক।
সবশেষে আরো একটা কথা না বললে নয়। অনেকে এই লেখার প্রতিক্রিয়ায় অনেক কিছু করতে পারে, বলতে পারে ভাবতে পারে। তবে এটাও সত্য একজন মানুষ সকলের প্রিয় হতে পারেনা। অনেকে অনেক কিছু ভেবে নিজের স্বার্থে, অন্যের ভালো খারাপ দিক খোঁজার চেষ্টা করে! যেমন- কোন সুযোগসন্ধানী যদি সুযোগ না পেয়ে বিপরীতমুখী কথা বলে, তাতে কিছু যায় আসেনা। কিংবা সরকারি আদেশ ও নিয়মনীতি পালন করতে গিয়ে যদি কাউকে বিভাগীয় মামলার সুপারিশ করা হয়, তার কাছে তো আর আরিফ স্যার ভালো হতে পারেনা! বিবেক আবেগহীন কিছু মানুষ আছে যারা নিজ স্বার্থের কথা বিবেচনা করে, নিজের ক্ষুদ্রজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে অন্যের ইতিবাচক নেতিবাচক দিক চিহ্নিত করার চেষ্টা করে। এই মুহূর্তে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামে এক কবিতার অংশ বিশেষ মনে পড়ে গেল- ‘হেথা সবে সম পাপি; আপন পাপের বাটখারা দিয়ে, অন্যের পাপ মাপি।’ তবে আমি বিশ্বাস করি আমার ভালো লাগা মানে ৯৫ শতাংশ মানুষের ভালো লাগা। তাই পরিশেষে বলতে হয়, ‘মি. গোলাম রহমান স্যার, ইউ আর রিয়াল্যি গ্রেট। ইউ আর রেয়ার ইন আওয়ার সোসাইটি!

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট