একই এলাকার সব জায়গায় বৃষ্টি না হওয়ার কারণ কী?

8

বিবিসি বাংলা

এপ্রিলজুড়ে টানা তাপপ্রবাহের পর অবশেষে গতকাল দোসরা মে রাতে স্বস্তির বৃষ্টি হয়েছে ঢাকায়। যদিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে বলছেন, ঢাকার সব জায়গায় গতকাল রাতে বৃষ্টি হয়নি। এমনকি, কেউ কেউ বলছেন যে একই এলাকার কোথাও বৃষ্টি হয়েছে, কোথাও আবার একদমই বৃষ্টি হয়নি।
ঢাকার সব এলাকায় আবহাওয়া অফিসের পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র না থাকায় তারা পুরোপুরি সুনির্দিষ্টভাবে জানাতে পারেননি যে কোন কোন এলাকায় বৃষ্টি হয়েছে, কোন কোন এলাকায় হয়নি। অথবা, একই এলাকার কোন অংশে বৃষ্টি হয়েছে, কোন অংশে একদমই বৃষ্টির দেখা মেলেনি। তবে আবহাওয়াবিদরা এটি নিশ্চিত করেছেন যে বজ্রবৃষ্টির সময় একই এলাকার কিছু অংশে বৃষ্টি হলেও অপর অংশ বৃষ্টিহীন থাকার মতো ঘটনা ঘটতেই পারে। কারণ এটাই ‘বজ্রবৃষ্টির ধর্ম’।
আকাশে যখন তীব্র বজ্রমেঘ তৈরি হয়ে যায়, তার গঠন থাকে ত্রিমাত্রিক। ঢাকার সব জায়গায় বৃষ্টি না হওয়ার সাথে ঢাকা শহরের আয়তন ও বজ্রমেঘের এই ত্রিমাত্রিক গঠন সম্পর্কিত।
আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক জানান, একটি তীব্র বজ্রমেঘের দৈর্ঘ্য সাধারণত ২২ থেকে ২৪ কিলোমিটারব্যাপী হতে পারে। এর চওড়া বা প্রস্থ হতে পারে ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার পর্যন্ত। এছাড়া, মাঝারি বা ছোট বজ্রঝড়ের উচ্চতা হয় আট থেকে ১২ কিলোমিটার। বড় বজ্রঝড়ের উচ্চতা ১৮ থেকে ২২ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে।
ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের আয়তন ১৭৮ বর্গ কিলোমিটার। সেইসাথে, শহরের দক্ষিণ থেকে উত্তর পর্যন্ত দূরত্ব আনুমানিক ২২ কিলোমিটার এবং পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকের দূরত্ব প্রায় ১২ কিলোমিটার। সাধারণত বজ্রঝড়ের গতিবেগ পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে, অথবা উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে হয়।
বজ্রঝড়ের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো- এটি সরল পথে না, আঁকাবাঁকা পথে চলে। যেহেতু সে জিগজ্যাগ বা স্পাইরাল মুভমেন্ট করে এবং শহরের মাঝে অনেক স্থাপনা থাকার কারণেবা পাহাড় থাকলে বাতাস বিভিন্ন জায়গায় বাধাপ্রাপ্ত হয়ে দিক পরিবর্তন করে; তাই, বজ্রঝড় অগ্রসর হওয়ার সময় সে কোনও এলাকাকেই পূর্ণরূপে কভার করতে পারে না। সেই কারণে, কোথাও কোথাও তাÐব কম হয়, কোথাও বেশি হয়। কোথাও বৃষ্টিপাত বেশি, কোথাও বৃষ্টিপাত হয় না। ভূমিরূপ বা টপোগ্রাফি অব দ্য আর্থ সারফেস এখানে গুরুত্বপূর্ণ, যোগ করেন মল্লিক।
একটি কম শক্তিশালী বজ্রমেঘের গতিবেগ সাধারণত ঘণ্টায় ৪৫ থেকে ৬০ কিলোমিটার হয়ে থাকে। মাঝারি আকারের বজ্রঝড়ের গড় গতিবেগ ৬০ থেকে ৮০ কিলোমিটার। যেটি আবার তীব্র বজ্রঝড়, তার গতিবেগ ৮০ থেকে ১৮০ কিলোমিটার পর্যন্তও হয়ে থাকে। বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকায় যে বজ্রঝড় হয়েছে, তার গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৪০ থেকে ৪৫ কিলোমিটার।
আবহাওয়াবিদ ড. মল্লিক বলেন, ধরা যাক, আগারগঁ^াও বরাবর বজ্রঝড় সৃষ্টি হলো। সে যাবে পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব দিকে। সেক্ষেত্রে সে গুলশান, বনানীতে আঘাত হানতে পারে। কিন্তু সে তো মিরপুরের দিকে আঘাত হানবে আনুভূমিক যাত্রা যেদিকে, সেদিকেই ঝড় হয়। অন্যদিকে হয় না।
এই আবহাওয়াবিদ আগেই বলেছেন যে বজ্রঝড় সাধারণত পূর্ব দিকেই ধাবিত হয়। এর কারণও তিনি ব্যাখ্যা করেন, বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ভারতের অভ্যন্তরে যে পশ্চিমা লঘুচাপ তৈরি হয়, সেটি বাংলাদেশ পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। লঘুচাপ সৃষ্টি হওয়া মানে বায়ুচাপ কম থাকা। এছাড়া, এসময় ঊর্ধ্ব আকাশে যে বাতাস প্রবাহিত হয়, তা পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়। বাংলাদেশে মে মাসে সাধারণত গড়ে ১৩ দিন বজ্রঝড় হয়।
আবহাওবিদ ড. মল্লিক জানান যে বাংলাদেশে মে মাসে সাধারণত গড়ে ১৩ দিন বজ্রঝড় হয়। এখন পর্যন্ত এই মাসে সর্বোচ্চ ১৮ দিন পর্যন্ত বজ্রঝড় হওয়ার রেকর্ডও আছে। তাই, এবছর মে মাসে গড়ে বজ্রঝড়ের সংখ্যা ১৩’র আশেপাশে থাকবে বলে আশা করছি, তিনি বলেন। তিনি আরও জানান, মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সাগরে একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হয়ে ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে। এই মাসে তাপমাত্রা অনেকটা কমলেও দেশের কোনও কোনও অঞ্চলের ওপর তাপপ্রবাহ বয়ে যাবে। কিন্তু এই চলমান তাপপ্রবাহের মধ্যেই সিলেট অঞ্চলে বন্যার পূর্বাভাসও পাওয়া যাচ্ছে।
তবে তাপপ্রবাহের সময় ছায়ায় আশ্রয় নেওয়া ও পর্যাপ্ত পানি পান করা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না সাধারণ মানুষের। বন্যার সময়ও নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। তবে একটু সতর্ক হলেই বজ্রঝড়ের সময় প্রাণের ঝুঁকি অনেকটাই এড়ানো সম্ভব। বর্তমান আবহাওয়ায় বজ্রঝড় শহুরেদের জন্য স্বস্তির হলেও প্রান্তিক মানুষের জন্য তা দুশ্চিন্তার কারণ।
বজ্রঝড় মানে তার সাথে বজ্রপাত থাকবে। প্রতিবছর বজ্রপাতে বাংলাদেশে অনেক মানুষ মারা যায়। তাই, বর্তমান আবহাওয়ায় বজ্রঝড় শহুরেদের জন্য স্বস্তির হলেও প্রান্তিক মানুষের জন্য তা দুশ্চিন্তার কারণ। বাংলাদেশে সাধারণত এপ্রিল থেকে মে মাসে সর্বোচ্চ বজ্রপাত হয় এবং ২০২১ সালের এক হিসাব অনুযায়ী এতে প্রতিবছর গড়ে দেড়শো মানুষ মারা যান। সুতরাং, বজ্রপাতে মৃত্যু বা হতাহত হবার ঘটনা এড়াতে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।