মো. দিদারুল আলম
সাধারণত জুলাই ও আগস্ট মাস হচ্ছে গাছের চারা লাগানোর উপযুক্ত সময়। এ সময় আলো-বাতাস, অনুকূল তাপমাত্রা, বৃষ্টি পর্যাপ্ত থাকে বলে চারাও সুন্দরভাবে প্রকৃতির মধ্যে বেড়ে ওঠে। বর্ষার শুরু অথবা শেষের দিকের সময়টা গাছ লাগানোর জন্য ভালো সময়। গাছ রোপণের সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করলে সারা বছরই চারা-কলম লাগানো যায় বলে জানিয়েছেন কৃষিবিদরা। তাঁদের মতে প্রথম বৃষ্টির পরপরই চারা লাগানো উচিত হবে না। কারণ প্রথম কয়েকদিন বৃষ্টির পরপরই মাটি থেকে গরম গ্যাসীয় পদার্থ বের হয়, যা চারা গাছের জন্য খুবই ক্ষতিকর এমনকি চারা মারা যায়। বলা হয়, যে কোনো গাছের চারা রোপণ করার সর্বোত্তম সময় দিনের শেষভাগে অর্থাৎ পড়ন্ত বিকেল বেলায়। বৃক্ষরোপণের বিষয়ে সোচ্চার হলেও কোথায় কী ধরনের বৃক্ষরোপণ করা উচিত, আমরা অনেকেই জানি না। ফুল গাছ সৌন্দর্যবর্ধক, তাই বাড়ির সামনের খোলা জায়গায় অনেকেই ফুল গাছ লাগান।মূলত জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে এ ধরনের বনায়ন করা উচিত।পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফুল গাছ নান্দনিকতা বাড়ায়। তবে ফলদ গাছ হলে তা পাখিসহ অন্যান্য প্রাণির জন্যও আশ্রয় ও খাবারের উৎস হয়ে উঠবে। এছাড়া রেল লাইনের পাশে আকারে বড় হয়, এমন গাছের চারা লাগালে, গাছের শেকড় লাইনের মাটির নিচে ঢুকে লাইনটিকে অসমতল করে তোলে।
এতে দুর্ঘটনার শংকা থাকে। তাছাড়া, দূর থেকে রেলপথ দেখতে না পাওয়াও ঝুঁকিপূর্ণ। এসব কারণেব্রিটিশ শাসনামলেরেল লাইনের পাশে ওই ধরনের বৃক্ষরোপণ নিরুৎসাহিত করা হতো।বাংলাদেশে চারা রোপণের উৎকৃষ্ট সময় হিসেবে সাধারণত বিবেচনা করা হয় বর্ষাকালকে। অর্থাৎ জুন, জুলাই ও আগস্ট মাস গাছের চারা রোপনের সবচেয়ে উপযুক্ত সময়।
গ্রিন হাউসের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করে, প্রয়োজনীয় খাদ্যের জোগান দেয়, অক্সিজেন সরবরাহ করে, বাতাসের অতিরিক্ত কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণের মাধ্যমে পরিবেশ নির্মল রাখে, ক্ষতিকর দূষিত বাতাস শোধন করে জীবজগৎকে রক্ষা করে, সুশীতল ছায়া দেয়, মাটির ক্ষয় রোধ করে, মাটিতে জৈব পদার্থ যোগ করে মাটির উবর্রতা রক্ষা করে, মাটিতে উপযুক্ত পরিমাণ পানি ধরে রাখে, জ¦ালানি সরবরাহ করে, জীবন রক্ষাকারী মূল্যবান ওষুধের কাঁচামালের যোগান দেয়, পশু-পাখি ও অন্যান্য বণ্যপ্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল হিসেবে কাজ করে।
প্রাকৃতিক দুযোর্গ ঝড়-ঝঞ্ঝা জলোচ্ছ্বাস বন্যা রোধ করে, বাড়ি তৈরিতে ও দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় শৌখিন ও মূল্যবান আসবাবপত্র তৈরিতে, লবণাক্ততা রোধ করে, মানুষের আপদকালে বীমাতুল্য কাজ করে, মাটির ক্ষতিকর বিষাক্ত পদার্থ শোষণ করে নিয়ে মাটিকে বিশুদ্ধ ও পরিষ্কার রাখে, বাতাস পরিষ্কার রাখে, বায়ুমন্ডলের তাপ কমিয়ে আবহাওয়া ঠান্ডা রাখে, বায়ু দূষণকারী পদার্থযেমন-কাবর্ন মনোক্সাইড, সালফার ডাইঅক্সাইড শোষণ করে এবং গাছের পাতা ঝড়-বাতাসের গতিকে রোধ করে, বৃষ্টির সৃষ্টি করে ও মরুময়তা রোধ করে, প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি প্রকৃতিকে মায়াময় ও সৌন্দযর্ময় রূপে সাজিয়ে তোলে।
এবারের গ্রীষ্মে আমরা যে প্রচন্ড তাপদাহে অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছি, তার অন্যতম কারণ গাছের পরিমাণ কমে যাওয়া! দুঃখের বিষয় হলো, প্রতিবছর গ্রীষ্মে যখন গরমে হাঁসফাঁস করতে থাকে মানুষ, তখনই বৃক্ষ নিধন নিয়ে বিলাপ, আর বেশি বেশি গাছ লাগানোর পরামর্শ চলতে থাকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বৃক্ষ রোপণের আন্দোলন চলে। আমরা জানি, সূর্যের প্রখর রোদ আর শুষ্ক গরম বাতাস থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়, আমাদের চারপাশটা গাছগাছালির সবুজে ভরিয়ে দেওয়া। তবে এর অর্থ এই নয় যে, যখন তখন গাছ লাগিয়ে ভরিয়ে দেব। তবে তাপদাহের মধ্যে গাছ লাগালে সেই গাছ বাঁচানো খুবই কষ্টকর।
প্রতিটি জীবই তার জীবন ধারণ ও সুষ্ঠু বৃদ্ধির জন্য খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। উদ্ভিদের জীবন চক্র সম্পন্নের জন্য বিভিন্ন প্রকার খাদ্যের প্রয়োজন হয়। উদ্ভিদ মাটি ও বাতাস থেকে তার খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। মাটিতে অবস্থিত বিভিন্ন খাদ্য উপাদান পানির সাথে মিশে উদ্ভিদের গ্রহণ উপযোগী হয়। সাধারণত উদ্ভিদ মাটি থেকে মূল দ্বারা খাদ্য উপাদান গ্রহণ করে এবং তা পাতার ক্লোরোফিলের দ্বারা সূর্যালোকের সাহায্যে নিজের খাদ্য তৈরি করে।
পরিবেশ সুরক্ষায় ২০১৯ সালে একদিনে এক কোটি ৩০ লাখ গাছ লাগিয়েছে তুরস্ক। এর মধ্যে এক ঘণ্টায় সর্বোচ্চ বৃক্ষরোপণ বিচারে ইন্দোনেশিয়াকে হারিয়ে নতুন বিশ্বরেকর্ড গড়েছে তারা। এর আগে ইন্দোনেশিয়া এক ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২ লাখ ৩২,৬৪৭টি চারা রোপণ করে রেকর্ড গড়েছিল। অন্যদিকে তুরস্ক এক ঘণ্টায় রোপণ করে ৩ লাখ ৩,১৫০টি চারা। জানা যায়, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া এক পোস্টের জেরে এ কর্মসূচি পালিত হয়। সরকারি পর্যায়ে এই ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পাওে এবং তা জরুরি।
দেশে গত ২০ বছরে ৪ দশমিক ১ শতাংশ প্রাথমিক বনাঞ্চল কমেছে। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে ৩ শতাংশই কমেছে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। যদিও ব্যাপকভাবে বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে ট্রি কভার (ক্যানোপি) বাড়ছে বলে দাবি করছে সরকার। দুঃখের বিষয় হলো, বন রক্ষা এ দেশে সামাজিক আন্দোলনে রূপ নিতে পারেনি। প্রতিবছর গ্রীষ্মে যখন গরমে হাঁসফাঁস করতে থাকে মানুষ, তখনই বৃক্ষ নিধন নিয়ে বিলাপ, আর বেশি বেশি গাছ লাগানোর নছিহত চলতে থাকে। অথচ গাছ লাগানোর উপযুক্ত সময় হচ্ছে জুন-জুলাই মাসে।
গাছের ছায়াতলেই গঠে উঠেছে মানবসভ্যতা। তাই গাছ ছাড়া মানুষের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। এক কথায় গাছ মানুষের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে জড়িত। মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব রোধ ও প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষাসহ নৈসর্গিক শোভাবর্ধনে গাছের গুরুত্ব অপরিসীম। ক্রমবর্ধমান এই তাপমাত্রাকে সহনীয় পর্যায় নিতে হলে সারা দেশে প্রচুর গাছ রোপণ করতে হবে। দেশের অন্তত ৩০ ভাগ বনভূমি করতে হলে প্রতিনিয়ত বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি চলমান রাখতে হবে। পশু-পাখি, পরিবেশের ভারসাম্যের জন্য গাছ যে কত বড় উপকারি তা এখনকার গরমে আমরা সবাই উপলব্ধি করছি। বৃক্ষরোপণের জন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা করা দরকার। প্রয়োজনে সারাদেশে বৃক্ষরোপণের জন্য একদিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করা যেতে পারে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও কলেজ শিক্ষক