ঋণখেলাপিরা সমাজে এত সমাদৃত কেন ?

2

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

সভ্য সমাজের ইতিহাস পর্যালোচনায় এটি স্পষ্ট যেকোন ধরনের অপরাধই শাস্তিযোগ্য। রাজনৈতিক সংস্কৃতির মোড়কে স্বাধীন বাংলাদেশেও এটি প্রশংসনীয় পর্যায়ে ছিল। অপরাধী যেই হোক না কেন আইনের শাসন সুরক্ষায় তার বিচার অবধারিত। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকেই চোরাকারবারী-মজুতদারী-দুর্বৃত্তায়ন দেশে অসহনীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী রাষ্ট্র-সমাজ চিন্তা-চেতনা বরাবরই জনগণের সুখ-সমৃদ্ধির লক্ষ্যেই স্থির ছিল। এর মূলে ছিল অসাম্প্রদায়িক, সমাজতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা। জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র-সমাজ ব্যবস্থার টেকসই সমৃদ্ধি নিশ্চিতে বঙ্গবন্ধু গণবিরোধী কার্যক্রমকে উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে বিবেচনা করেছেন। রাষ্ট্রযন্ত্রের সকল ক্ষেত্রে দুর্নীতিমুক্ত শাসন পরিচালনায় তাঁর অঙ্গীকার ছিল নিখাঁদ। দুর্নীতি নিধনকল্পে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা ছিল অত্যন্ত যৌক্তিক, যুগপোযোগী এবং খোলামেলা। অকপটেই তিনি এসব বিষয়কে জনগণের সম্মুখে প্রকাশ এবং এর প্রতিকারে সহযোগিতার আহবান করেছেন।
ঘুষ-সুদখোর, মজুতদার, চোরাকারবারী, চোরাচালানী, অন্যের জমি-বাড়ি দখলদারদের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু কঠোর ভাষায় বহুবার সাবধান করেছেন। তাদের আইনের আওতায় আনার হুশিয়ারী উচ্চারণও ছিল অতি জোরালো। ১৯৭২ সাল ঐতিহাসিক ৭ই জুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “তাদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলতে চাই, যারা শহরে সরকারি বাড়ি, গাড়ি দখল করে আছ, যারা দোকান বা অন্যের জমি দখল করে আছ, যারা মজুদ করছো, জিনিসপত্র বিক্রয় করছো না, জিনিসের দাম বাড়াবার চেষ্টা করছো, তাদের রেহাই নাই। আমি ভিক্ষা করে দুনিয়ার নানা দেশ থেকে জিনিসপত্র আনছি আমার গরীব দুঃখিদের জন্য। সেই জিনিস যারা লুটপাট করে খাচ্ছো, তাদেরও রক্ষা নাই।” ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ সালে জাতীয় সংসদে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আজ দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, কালোবাজারি নতুন পয়সাওয়ালা- এদের কাছে আমার আত্মাবিক্রি করতে হবে, এদের অধিকারের নামে আমাদের এদেরকে ফ্রি-স্টাইলে ছেড়ে দিতে হবে। কখনো না। কোনো দেশ কোনো যুগে তা দেয় নাই। দিতে পারে না। যারা আজকে আমার মাল বিদেশে চালান দেয়, চোরাকারবারি করে, যার দুর্নীতি করে, এদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করতে হবে।’
বর্তমান প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে চোরাকারবারি-মজুতদারিদের বেপরোয়া অভিপ্রায় সহজেই অনুমেয়। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার কতিপয় কর্মকর্তা বা অসাধু রাজনীতিবিদদের পৃষ্ঠপোষকতা তাদের শক্তির মূল উৎস রূপে প্রতিষ্ঠিত । সিন্ডিকেট কারসাজিতে অত্যন্ত সিদ্ধহস্ত এসব মাফিয়াচক্র পুরোদেশকেই জিম্মি করে ফেলেছে। নিত্যপণ্যের বাজার, অবৈধ আমদানি-রপ্তানি, অর্থপাচার, ঋণখেলাপি, অসৎ ঠিকাদারি এমন কোন হীন কাজ নেই যাতে তারা সংশ্লিষ্ট নয়। অর্থলোভী হিংস্র দানবরূপী এসব মানুষগুলো কেন জানি সবার কাছে প্রিয়। মসজিদ-মন্দির-স্কুল-কলেজ-দাতব্যচিকিৎসালয় নির্মাণ-আর্তমানবতার সেবা ইত্যাদি কর্মযজ্ঞে তাদের আসল চরিত্র আড়ালে চলে যাচ্ছে। অনৈতিক-অবৈধ রাজনীতির ক্ষমতা দখলের কদর্য সংঘাত প্রতিনিয়তই জনগণ উপলব্ধি করতে পারছে। শহর-বন্দর-গ্রামীণ জনপদ ও দেশের প্রত্যেক অঞ্চলে নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিরূপে তাদের স্বরূপ উন্মোচন নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। নানা গর্হিত পন্থায় উপার্জিত অর্থ দিয়ে সকল কিছু তারা দখলে নিচ্ছে। যখন-যেখানে-যাকে দরকার তাকে অকাতরে ম্যানেজ করে চলছে। সম্প্রতি প্রস্তাবিত বাজেটে ১৫ শতাংশ কর প্রদান করে কালো টাকা সাদা করার সুযোগে ঘুষ-দুর্নীতিকে কোন যুক্তিতে বৈধ করা হচ্ছে তা মোটেও বোধগম্য নয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, আইন-আদালত-আইনজীবী প্রায় প্রত্যেক কিছুই তাদের অর্থের কাছে পরাভূত। বাহিনীভিত্তিক বড় ভাইয়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে কিশোর গ্যাং গঠন, মাদক-অস্ত্র ব্যবসা এর অন্তর্ভুক্ত। বহুতল ভবন নির্মাণ, বড় মাপের সরকারি-বেসরকারি অবকাঠামো, জলাশয় ভরাট করে ইটের ভাটা-শিল্প স্থাপনে এদের ভূমিকা চোখে পড়ার মত। ইত্যবসরে সাধারণ মানুষ হারাতে বসেছে সৎ উপায়ে কষ্টার্জিত জমি-ধনসম্পদ-পুকুর-জলাশয়-দোকান-ক্ষুদ্রব্যবসা নামীয় প্রায় সবকিছু। নিরীহ জনগণ চরম হতাশাগ্রস্ত হয়ে শুধু নির্বাক তাকিয়ে থাকছে। অর্থ-ক্ষমতার প্রভাবের কাছে তারা সম্পূর্ণ নতিস্বীকারে বাধ্য হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই প্রচার-সংবাদ মাধ্যমসমূহের চিত্রে মানুষের হাহাকার-আর্তনাদ-কতারতা প্রকাশিত। সামান্য প্রতিবাদ করার বাকশক্তিও হারাতে বসেছে। ফলাও করে তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সংস্থার কার্যক্রম প্রায় প্রচারিত হচ্ছে। এতসব প্রকাশ কোনভাবেই দুর্বৃত্তায়নকে রোধ করতে পারছে বলে মনে হয় না। কার্যকর কোন আইনি ব্যবস্থা এদের বিরুদ্ধে পরিলক্ষিত নয়। পক্ষান্তরে অনেকক্ষেত্রে নির্দোষ-অসহায়-নিরীহদের নানা কারসাজিতে ফাঁসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। উদ্ভট দেশ যেন জংলী-জঙ্গি সমাজের বশীভূত।
জনশ্রুতি মতে, এদের অধিকাংশই ঋণ খেলাপির কর্ণধার। অনিয়ম-কেলেঙ্কারি-দুর্বল কর্পোরেট গভর্ন্যান্স ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যথাযথ পর্যবেক্ষণের অভাবে ঋণ খেলাপি বেড়েছে। ৬ জুন ২০২৪ গণমাধ্যমে প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে ৩৬ হাজার ৩৬৭ কোটি বেড়ে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। যা পূর্বের তিন মাসের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেশি। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত মোট বিতরণকৃত ঋণ ছিল ১৬ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে বিতরণকৃত ঋণের ১১ দশমিক ১১ শতাংশই খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে। উল্লেখ্য সংস্থার প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, রাষ্ট্র পরিচালিত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ৩ লাখ ১২ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে মার্চ ২০২৪ পর্যন্ত খেলাপি হয়েছে ৮৪ হাজার ২২১ কোটি টাকা। সর্বাপেক্ষা বেশি মন্দ ঋণ কেলেঙ্কারিতে ক্ষতিগ্রস্ত জনতা ব্যাংকের। যার পরিমাণ ৩০ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা। এটি মোট বিতরণ করা ঋণের ৩১ শতাংশ। অগ্রণী ব্যাংকের মন্দ ঋণ ২০ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা বা বিতরণকৃত ঋণের ২৮ শতাংশ। বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মন্দ ঋণ ৮৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা যা তাদের বিতরণ করা ঋণ ১২ লাখ ২১ হাজার ১৬৬ কোটি টাকার ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। এছাড়াও বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোতে তাদের বিতরণকৃত ঋণের বিপরীতে খেলাপি ঋণ যথাক্রমে ৫ দশমিক ২০ ও ১৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদদের মতে, যদি অবলোপনকৃত-পুনঃনির্ধারিত ঋণ এবং আদালতে নিষেধাজ্ঞা আছে এমন ঋণ বিবেচনা করা হয় তবে মন্দ ঋণের প্রকৃত সংখ্যা হবে ৫ লাখ কোটি টাকার বেশি। বাংলাদেশে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক গণমাধ্যমে বলেন, ‘খেলাপি ঋণের এই পরিসংখ্যান নতুন নয়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তের কারণে এটি এখন সামনে এসেছে। প্রায় ২৫ শতাংশ ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে। এতে মন্দ ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা। অনেক মন্দ ঋণ আছে যেগুলো এখনো প্রকাশ হয়নি। ভবিষ্যতে সেগুলো প্রকাশ করা হবে। উচ্চ মন্দ ঋণের কারণে ব্যাংকিং খাত দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং ভালো ঋণগ্রহাতাদের উপর এর প্রভাব পড়ছে।’ ব্যাংক সংশ্লিষ্টদের দাবি, একদিকে বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থার অজুহাত দেখিয়ে ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে ঋণ পরিশোধ থেকে বিরত থাকার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অপরপক্ষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বেশিরভাগ ঋণই অনিয়ম ও জালিয়াতির মাধ্যমে নেওয়া হয়েছে। তাই সেসব ঋণ আদায় করা কঠিন। তাছাড়া ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ কম দেখাতে বাছবিচার ছাড়াই ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতেও অনেক ঋণ খেলাপি পুনঃতফসিলের আশ্রয় নেয়।
ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে প্রচলিত নিয়ম ছিল; ব্যাংকগুলো নিজ পর্ষদে এ সংক্রান্ত প্রস্তাব পাস করে সেটি অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠানো হত। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যাচাই-বাছাইয়ের পর ঋণ পুনঃতফসিলের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করত। কিন্তু ২০২৩ সালের জুলাই মাসে প্রজ্ঞাপন জারি করে সে ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর হাতে ছেড়ে দেয়। ফলশ্রুতিতে ব্যাংকগুলো নিজেদের ইচ্ছামতো ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ পায়। খাত সংশ্লিষ্ট অনেকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই উদারনীতিকে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলে উল্লম্ফনের প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচনা করছেন। প্রাসঙ্গিকতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন বলেন, ‘দেশের ব্যাংক খাতের সুশাসন অনেক আগেই ভেঙে পড়েছে। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে ঋণের নামে জনগণের অর্থ লুন্ঠন হয়েছে। এ কারণে পুনঃতফসিল নীতিমালা সহজ করা সত্তে¡ও ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। দেশের ব্যাংকগুলোয় দৃশ্যমান খেলাপি ঋণের চেয়ে ধামাচাপা দেয়া খেলাপি ঋণ অনেক বেশি। ব্যাংক খাত ভঙ্গুর হয়ে পড়ার প্রভাব অর্থনীতির সবক্ষেত্রে এখন দৃশ্যমান।’ যদিও সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৬ সালের মধ্যে মন্দ ঋণ রাষ্ট্রপরিচালিত ব্যাংকগুলোতে ১০ এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলাতে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই নীতির কার্যকারিতর উপর নির্ভর করছে খেলাপি ঋণ অপসংস্কৃতির মডেল রচনা। মোদ্দাকথা চিহ্নিত ঋণ খেলাপিদের পরিচিতি-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান-অনৈতিক পন্থায় পদ-পদক-পদায়ন অর্জন জনসন্মুখে প্রচার অতি জরুরি হয়ে পড়েছে। দুর্ভাগা জনগণ এদের কুৎসিত চরিত্র সম্পর্কে যৎসামান্য অবহিত হবে। সমাদরের বিপরীতে সমাজ এদেরকে ঘৃণার চোখে দেখলে কিছুটা হলেও এর প্রতিকার প্রত্যাশিত।

লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী, সাবেক উপাচার্য চ.বি