ইসলামে শিক্ষকের মর্যাদা ও সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ

9

এমরান চৌধুরী

আমাদের সমাজ থেকে শ্রদ্ধাবোধ কি লোপ পেতে বসেছে? এরকম প্রশ্ন গত বছর কয়েক ধরে ঘুরপাক খাচ্ছে আর এ বছরের আগস্ট মাসে এসে তা যেন সীমা ছাড়িয়ে গেছে। যে মানুষটিকে আপনাআপনি কদমবুচি করার কথা তাঁকেই আজ নানাভাবে নাজেহাল হতে হচ্ছে তাঁরই হাতে গড়া পরমপ্রিয় শিক্ষার্থীদের হাতে। যেখানে শিক্ষকের চোখে চোখ রেখে কথা বলার ন্যুনতম সাহস থাকার কথা নয়, সেখানে সেই শিক্ষকগণ হচ্ছেন অপমানের শিকার। মা-বাবার পরে যাঁদের স্হান তাঁরা কেন এভাবে অসম্মানিত হবেন। বিষয়টি যুগপৎ দুঃখ ও লজ্জার। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিক্ষার্থী কর্তৃক শিক্ষক-শিক্ষিককে অপমান করা, জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করার বিবিধ ভিডিং চোখে পড়ছে। এসব ভিডিও’র ঘটনা যদি শতকরা চল্লিশভাগও সঠিক হয় তাহলে বুঝতে হবে আমাদের শ্রদ্ধা তথা বিনয়ের জায়গায় ফাটল ধরেছে।
এই কথা কখনো জোর দিয়ে বলা যাবে না শিক্ষকের কোনো ভুল নেই। মানুষমাত্রই ভুল করে। শিক্ষকদেরও ভুলত্রæটি থাকতে পারে। একইভাবে শিক্ষার্থীরা এসব ঘটনা নিজেরা করছে নাকি পেছনে কারো প্ররোচনা আছে তাও খতিয়ে দেখার বিষয়? ঢালাওভাবে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের দোষারুপ করার কোনো অবকাশ নেই। কোনো শিক্ষকের প্রতি যদি কোনো অভিযোগ থাকে তাঁর বিরুদ্ধে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ করা যেতে পারে। কর্তৃপক্ষ বিধিমোতাবেক ব্যবস্থা নেবেন। শিক্ষার্থীদের এখতিয়ার নয় তাদের শিক্ষককে পদত্যাগে বাধ্য করা। এটা একদিকে যেমন দেশের প্রচলিত আইনের লংঘন, অন্যদিকে ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি ঘটানোর অশুভ পাঁয়তারা। এটি দেশ, সমাজ ও পরিবারের জন্য অশনি সংকেত। কারণ শিক্ষক শ্রদ্ধার পাত্র। কোনো কারণে যদি শ্রদ্ধাবোধের জায়গাটা আলগা হয়ে যায় বা ফাটল ধরে তাহলে একজন শিক্ষকের পক্ষে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পাঠদান সম্ভব নয়। একইভাবে শিক্ষার্থীদের পক্ষেও পাঠে মন বসানো কষ্টকর হয়ে পড়বে। উভয় পক্ষের জন্য বিষয়টি বিব্রতকর।
আমরা জানি, শিক্ষকমাত্রই মানুষ গড়ার কারিগর। আর শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড।একজন শিক্ষার্থীর মানুষের মতো মানুষ রূপে গড়ে ওঠার পেছনে বাবা-মায়ের যেমন নিরন্তর চিন্তা, শ্রম ও ঘাম থাকে, তেমনি শিক্ষকেরও থাকে বিরাট ভূমিকা। এই দুয়ের আদরে কদরে আর শাসনে গড়ে উঠে একজন চরিত্রবান, আদর্শ নাগরিক। পরম করুণাময় আল্লাহপাক মা-বাবাকে যেমন সন্তানদের প্রতি যথাযথ সম্মান করার নির্দেশ দিয়েছেন, তেমনি শিক্ষকদেরও আলাদা মর্যাদা দিয়েছেন। তাদের সম্মানে ভূষিত করেছেন।
ফলে মুসলিম সমাজে শিক্ষকমাত্রই বিশেষ মর্যাদা ও সম্মানের ব্যক্তি।
শিক্ষকতা একটি মহান পেশা, যার প্রতিদান বিশাল। শিক্ষা ও শিক্ষককে উঁচু মর্যাদা দিয়েছে ইসলাম। শিক্ষকের সঙ্গে কোনো পরিস্থিতিতেই বেয়াদবি কিংবা খারাপ আচরণ করা উচিত নয়। সবসময় শিক্ষকদের সম্মান করা উচিত। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় অনেক ছাত্র বুঝে অথবা না বুঝে শিক্ষকের সঙ্গে বেয়াদবি করে ফেলে। যা গর্হিত কাজ। যার মধ্যে আল্লাহ ভীতি থাকে, তার দ্বারা কখনো কোনো মানুষকে বিনাদোষে অপমান অথবা বেয়াদবি করা সম্ভব নয়। তবে সামাজিক অবক্ষয় এবং ইসলামী মূল্যবোধ না থাকার দরুণ আজকাল সমাজে অনেক সময় এই ধরনের বাজে ঘটনা সংগঠিত হয়ে থাকে। শিক্ষকতার পদকে মহানবী (সা.) গৌরবের বলে উল্লেখ করেছেন। মহানবী (সা.) বলেছেন , ‘দুই ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কারো পদ-গৌরব লোভনীয় নয়। ১. ধনাঢ্য ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ ধন-সম্পদ দান করেছেন এবং তা সৎ পথে ব্যয় করার ক্ষমতা দিয়েছেন। ২. ওই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ বিদ্যা দান করেছেন এবং সে অনুসারে সে কাজ করে ও অপরকে শিক্ষা দেয়।’ আমরা অনেক সময় দেখি সমাজে অনেকে শিক্ষকদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে এবং অনেকে সুযোগ পেলে বেয়াদবি করার চেষ্টা করতে। অথচ এই ধরনের কাজ শুধুমাত্র নির্বোধ এবং নিকৃষ্ট শ্রেণীর মানুষের পক্ষে করা সম্ভব।
শিক্ষাকে যাবতীয় উন্নয়নের চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই চালিকাশক্তির মূল কারিগর হচ্ছেন শিক্ষক। এক্ষেত্রে শিক্ষকের ভূমিকা অপরিসীম। বলতে গেলে এর বিকল্প নেই।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘পড়! তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন একবিন্দু জমাট রক্ত থেকে। পড়! আর তোমার প্রতিপালক পরম সম্মানিত। যিনি কলমের দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন, যা সে জানত না। ’ (সুরা আলাক, আয়াত ১-৫)
মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা জ্ঞান অর্জন করো এবং জ্ঞান অর্জনের জন্য আদব-শিষ্টাচার শেখো। এবং যার কাছ থেকে তোমরা জ্ঞান অর্জন করো, তাকে সম্মান করো। ’ (আল হাদিস,৬১৮৪)
প্রাচীনকাল থেকে সমাজে শিক্ষকদের সম্মানের দৃষ্টিতে দেখার ঐতিহ্য ও রীতি চলে আসছে । শিক্ষা অনুযায়ী মানবচরিত্র ও কর্মের সমন্বয় সাধনই হচ্ছে মহানবী (সা.)-এর তাগিদ। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘আল্লাহর পরে, রাসূলের পরে ওই ব্যক্তি সর্বাপেক্ষা মহানুভব যে জ্ঞানার্জন করে ও পরে তা প্রচার করে। ’ (মিশকাত শরিফ)
জায়েদ ইবনে সাবেত (রা.) একবার তার বাহনে ওঠার জন্য রেকাবে (সিঁড়িতে) পা রাখলেন। তখন ইবনে আব্বাস (রা.) রেকাবটি শক্ত করে ধরলেন। এ সময় জায়েদ ইবনে সাবেত (রা.) বললেন, ‘হে রাসুল (সা.)-এর চাচাতো ভাই, আপনি হাত সরান। উত্তরে ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, না, আলেম ও বড়দের সঙ্গে এমন সম্মানসূচক আচরণই করতে হয়।’
খোলাফায়ে রাশেদিনের যুগ থেকে প্রত্যেকের জন্য শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। শিক্ষাকে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে তখন শিক্ষকের জন্য সম্মানজনক পারিশ্রমিকও নির্ধারণ করা হয়েছিল। যদিও তখন দ্বীনি শিক্ষাঙ্গনের শিক্ষকরা কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জ্ঞান বিতরণ করতেন। এ যুগে শিক্ষকগণ যাতে নিজেদের জীবিকার পেছনে ব্যতিব্যস্ত সময় পার না করেন, শান্ত-সৌম্য মস্তিষ্কে জ্ঞান বিতরণের পবিত্র কাজে আত্মনিয়োগ করেন, সেজন্য তৎকালীন খেলাফত ব্যবস্থা তাদের সম্মানে অভিষিক্ত করেছিলেন। তাদের জ্ঞান বিতরণের এ মহৎ কাজকে সম্মান জানিয়ে তাদের পরিবার-পরিজনের যাবতীয় আর্থিক খরচ বহন করেছিলেন। যেন জীবনের তাগিদে শিক্ষকদের ভিন্ন কোনো পথে পা বাড়াতে না হয়।
হযরত ওমর ফারুক (রা.) ও হযরত ওসমান (রা.) তাদের শাসনামলে শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তাঁরা শিক্ষক ও ধর্মপ্রচারকদের জন্য বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা করেছিলেন। আবদুর রহমান ইবনুল জাওজি (রহ.) তার বিখ্যাত ‘সিরাতুল উমরাইন’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.), হযরত ওসমান ইবনে আফফান (রা.)-এর যুগে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও শিক্ষকদের সরকারি ভাতা দেওয়া হতো।
আমরা আশা করব, শিক্ষকের সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখার স্বার্থে সমাজের সচেতন মানুষ, এলাকার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ এগিয়ে আসবেন। মনে রাখতে হবে যে শিক্ষক অপমানিত বা অপদস্ত হচ্ছেন তিনি কারো না কারো বাবা-চাচা-ভাই। এমনও হতে পারে তিনি আমার/আপনার আত্মীয়, বন্ধু কিংবা প্রতিবেশি। প্রতিবেশির অপমান কিন্তু পাশে যিনি আছেন তারও অপমান। গত ২৭ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারিকৃত এক পত্রে সকল জেলা প্রশাসককে ‘বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের সার্বিক সুষ্ঠু পরিবেশ বজায়’ রাখার’ তাগিদ দেওয়া হয়েছে। আশা করা যায় এর ফলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আগের মতো শান্তি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে পাঠদান অব্যাহত থাকবে।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক